যাত্রাপালা চন্দ্রগুপ্ত-১১

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 20 Jan 2019, 12:12 PM
Updated : 20 Jan 2019, 12:12 PM

যে নির্বাচন মহাসংগ্রামের কথা চন্দ্রগুপ্ত যাত্রাপালায় একাধিকবার উল্লেখিত হইয়াছে, যে মহাসংগ্রামে বিজয়লাভের দুশ্চিন্তায় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত শাক্যহসৈন মৌর্যবের ঠিকঠাকমতো নিদ্রা হইতেছিল না, সেই মহাসংগ্রাম যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হইয়াছে। সম-দান-ভেদ-দণ্ড- চাণক্যের এই চতুরঙ্গ কূটনীতি সুচারুরূপে প্রয়োগ করিয়া সম্রাট শত্রুদিগের আস্যদেশে এমন উত্তমরূপে বিভূতি ঠাঁসিয়া দিয়াছেন যে তাহারা হতভোম্বল হইয়া গিয়াছে।

তৈন্তলকগণকে দান দিয়া সম্রাট পূর্বেই তাহাদিগের সহিত জমৈতের ভেদ সৃষ্টি করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। প্রাচীনযুগে শত্রুরাজার গৃহে বিষকন্যা পাঠাইবার রীতি ছিল। বিষকন্যার অপ্রতিরোধ্য রূপে ও ছলাকলায় মুগ্ধ মূর্খ শত্রুরাজ বিষকন্যার সহিত সঙ্গমে মিলিত হইবামাত্র মৃত্যুমুখে পতিত হইতেন। এই রীতি অনুসরণ করিয়া সম্রাট নির্বাচনের আগে দুই বিষ-মানব: ফকৈরুল ও কমৈল হসৈনকে শত্রুশিবিরে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন বলিয়া আর্যাবর্তে গুজব রটিয়াছে। এই দুই জন পেশাদারিত্ব ও মুন্সিয়ানার চরম পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া হ্যামেলিনের বংশীবাদকের ন্যায় শত্রুপক্ষের বালক ও মুষিকদিগকে ভুলাইয়া নিয়া আসিয়া নির্বাচন মহাসমুদ্রে চিরতরে ডুবাইয়া দিয়াছেন।

জমৈতের পায়ের নিচের মাটি সরিয়া গিয়াছিল বহু আগেই, তাহারা অতলে তলাইয়াই যাইত, যদি না নির্বাচন-সমরে আজন্ম বান্ধব বনৈপি শেষ সময়ে তাহাদিগকে আশ্রয় দিত। কিন্তু তাহাতেও শেষ রক্ষা হয় নাই, বনৈপিতো ডুবিয়াছেই, সঙ্গে ডুবাইয়াছে জমৈতকে। অর্ণবপোত যখন জলের অতলে নিমজ্জিত হয়, তখন পোতের মাস্তুলে অবস্থানরত মুখপোড়া হনুমান কি কদাপি রক্ষা পায়? নির্বাচনে ভরাডুবি হইয়া এই দুই দলের নেতাকর্মীগণের মাতম করিবার মতো শক্তিও অবশিষ্ট আছে বলিয়া মনে হইতেছে। বনৈপী নেতা ফকৈরুল ইতিমধ্যে নিজ দলের দোষ স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। শোনা যাইতেছে, সম্রাট নাকি খোদ জমৈত দলটিকেই বিচারের কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান করিবেন। অদূরভবিষ্যতে তাহাদিগের কপালে যে কী 'মউ' আর কী 'দুধ' আছে তাহা তাহাদের স্বর্গবাসী স্বপ্নদ্রষ্টা গুরুদেব শ্রীল শ্রীমান মওদুঈদী মহোদয় জানিলেও জানিতে পারেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি প্রবাদ ছিল: 'মাওলানা মওদুদী; ইছামাছ দি কদুদি'। নির্বাচন মহাসমরে শোচনীয় পরাজয়ের পর এবং বিশেষত নির্বাচনের বর্ষপূর্বে আত্মসমর্পী ব্যাংক বেহাত হইবার পর, কদু (লাউ) কিংবা ইচামাছ (চিংড়িমাছ)-এর মতো অকিঞ্চিৎতর খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহের ক্ষমতাও হয়তো জমৈতের নাই।

বৎসরখানেকের বেশি নিজগৃহে স্বেচ্ছা-অন্তরীণ থাকার পর তক্ষশীলার সাবেক উপাধ্যক্ষ ঐরাবিণ আবার সভাসমিতিতে বক্তব্য রাখিতে শুরু করিয়াছেন। পুনরায় কি তাহার কপাল ফিরিল? যে সম্রাট একদা মধ্যনিশিতে ঐরাবিণকে কোনো এক খেয়ালবশত পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তিনিই কি আবার ইচ্ছা হইলে মধ্যদিবসে তাহাকে নতুন কোনো পদ দিয়া বসিতে পারেন না? পাগলে কী না বলে এবং সম্রাটে কী না করে। অর্বাচীন বাঙ্গালা ভাষায় প্রবাদ আছে: 'বড়র পীরিতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণেক চাঁদ।'

আর আকৈত্রজৈমন? 'আগের হাল য্যানে গেইয়ে, পিছের হালঅ হ্যানে যাইব।' চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রবাদ। ঐরাবিণ প্রথমে বিনা নির্বাচনে চারি বৎসর এবং তাহার পর নির্বাচনে যেনতেনভাবে জয় জবরদখল করিয়া আরও চারি বৎসর তক্ষশীলার উপাধ্যক্ষ ছিলেন। আকৈত্রজৈমনের বেলায়ও তাহার অন্যথা হইবে কেন। দাদাও যখন ফেল, তখন কনিষ্ঠ ভ্রাতা কোন দুঃখে পাস করিতে যাইবে? যাহারা বলিতেন, উচ্চারণে-আচরণে আকৈত্রজৈমনের কোনো 'ক্লাস' নাই, তাহারা এখন সম্ভবত ভাবিতেছেন: সম্রাট, অমাত্য, কায়স্থ, পৌলিশ, বিচারক, ব্যবসায়ী, সেনাপতি… উচ্চারণে-আচরণে আর্যাবর্তে কাহারই বা ক্লাস আছে? শিক্ষকগণের ক্লাস নাই শুধু নহে, তাহাদিগের মধ্যে অনেকে নাকি বছরের পর বছর কোনো ক্লাসই নেন না। এই সব দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়া বৃদ্ধ এবং নবীন ভামগণ নিশ্চিত হইয়াছেন, আর্যাবর্তে বিনাবিপ্লবে ইতিমধ্যে 'শ্রেণীহীন' সমাজ প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে।

আকৈত্রজৈমন সম্প্রতি সদ্যনির্বাচিত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে তাহার নক্ষৈলপাড়ার কর্মভবনে গিয়ে পুষ্পায়িত করিয়া আসিয়াছেন। না করিলে চলিবে কেন? ভেংচি ও তিড়িংবিড়িং নৃত্যরত শাখামৃগ কি কদাপি তাহার মাদারিকে উপেক্ষা করিতে পারে? আর্যাবর্তে পরিচলন পদ্ধতিতে তৈলের প্রবাহ সাম্রাজ্যের উপর হইতে নীচ, নীচ হইতে উপরে স্বতঃপ্রবহমান। লালিমা আকৈত্র, চৈতকা হৈলম প্রমূখ মজলিশে সুরার সদস্যগণতো বটেই, ঐরাবিণের সিপাহসালারগণ, যেমন সফৈল ঐলম, রহৈমতুল্য ইদানিং আকৈত্রজৈমনের কর্মকক্ষে গিয়া তাহাকে ঘিরিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনভাগে শিকড় গাড়িয়া বসিয়া থাকেন যেন তাহাদিগের অন্য কোনো কর্তব্য, কোনো ক্লাস (উভয়ার্থে) নাই। পূজা ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে মানুষ দেবতার কাছে ধর্ণা দিয়া পড়িয়া থাকে? 'পূজা' নামক কর্মটিতে দুইটি বিষয় থাকে: প্রশংসা ও প্রার্থনা। 'ওগো তুমি অনেক বড়! সুতরাং আমারেও বড় কর! তোমার অনেক আছে। কিছু দিলে প্রাণটা বাঁচে!' – যে কোনো ধর্মের প্রার্থনায় ইহাই মূল কথা। এইসব শুভলক্ষণ দেখিয়া আকৈত্রজৈমন নিশ্চিত হইতেই পারেন যে তক্ষশীলার উপাধ্যক্ষের সিংহাসনে তিনি আপাতত টিকিয়াই গেলেন। আকৈত্রজৈমন প্রথম দিকে তেমন বিদূষক-প্রিয় ছিলেন না। কিন্তু কাঁচা লৌহে যেমন মরিচা পড়িবেই পড়িবে, তেমনি কাঁচা ক্ষমতাবানের চতুর্দিকে বিদূষক-চামচার দল ভিড় করিবেই করিবে। মরিচা মানিয়া লওয়া ছাড়া লৌহের যেমন গত্যন্তর নাই, তেমনি আকৈত্রজৈমনও পক্ষীয় ও বিপক্ষীয় চামচাগণকে সহ্য করিতে বাধ্য হইতেছেন এবং সম্ভবত তাহাদের তৈলসিঞ্চনে ভিতরে ভিতরে পুলকও অনুভব করিতেছেন আর মনে মনে ভাবিতেছেন:'দেখরে শ্যালক ও শ্যালিকাগণ, আজ কোথায় তোরা, আর কোথায় আমি!'

ঐরাবিণের সিপাহশালারগণকে মাঝে-মধ্যে খাজাঞ্চি কমলৈদ্দনের কর্মকক্ষে সাবেক হলধর নজম্য সৈহনের সহিত আড্ডারত দেখা যায়। তাহারা কি ঐরাবিণ স্বর্ণযুগের স্মৃতিচর্বন করিতে করিতে হতাশার অতলে ডুবিয়া যান, নাকি আকৈত্রজৈমনের উচ্চারণ-আচরণের ছিদ্রান্বেষণ করিয়া অদূর ভবিষ্যতের দুরাশায় বুক বাঁধেন তাহা সর্বজ্ঞ ঈশ্বর বলিতে পারেন, অথবা বলিতে পারেন আকৈত্রজৈমনও, যদি উপাধ্যক্ষ ভবনের মতো কমলৈদ্দনের কর্মকক্ষে তাহার অনুপস্থিতিতে গোপন ক্যামেরা স্থাপনের ব্যবস্থা হইয়া থাকে। তবে আর্যাবর্তে গুপ্তচরবৃত্তি এই পরিমাণ উন্নত হইয়াছে বলিয়া মনে করিবার কোনো কারণ নাই।

শ্রীমতি চৈতকা হৈলম ইদানিং জৈমনের প্রশংসায় পঞ্চমুখরা: 'আমার বিরুদ্ধে উপাধ্যক্ষ ভ্রাতার কান ভারি করিবার চেষ্টা করিয়াছে অনেকেই, কিন্তু মহান তিনি কাহারও কথায় কর্ণপাত করেন নাই! যাবতীয় বিপদে পার্শ্বে থাকিয়া ঠেস না দিলে কোন কালে আমি 'ষড়যন্ত্রের ঝমাঝম রেলগাড়ির নিচে পড়িয়া পা পিছলাইয়া আলুর দম' হইয়া যাইতাম!' ডৈন নির্বাচন সমাগত। সুতরাং কাজতো কিছু দেখাইতেই হইবে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের উচ্চতা বৃদ্ধি করিতে ব্যস্ত চৈতকা। গবেষণা ও শিক্ষণের উচ্চতা বৃদ্ধি যেহেতু তাহার এবং তাহাদিগের সাধ্যের বাহিরে, ভবনের উচ্চতাই সই।

ডৈনগণ মাঝেমধ্যে নিজ নিজ অনুষদের শিক্ষকগণকে (অর্বাচীন যুগের বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়) আর্যাবর্তেও 'দূরে কোথাও, দূরে দূরে…' লইয়া গিয়া আলোচনায় বসেন, কারণ তাহারা মনে করেন, তক্ষশীলার কোনো মিলনায়তনের গর্ভগৃহই তাহাদিগের আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বীর্য ('শক্তি' অর্থে) ধারণ করিবার মতো উপযুক্ত সুপরিসর নহে। শিক্ষক, বিচারক হইতে শুরু করিয়া আর্যাবর্তে সকলেই জনগণের অর্থ অপচয় করিতে সিদ্ধহস্ত হইলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে কেবলমাত্র আমলাদিগের উপরই অপচয়ের দোষারোপ করা হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি প্রবাদ আছে: 'হক্কল মাছে কু (স্পর্শ বর্ণেও উচ্চারণ ঘোষ হইবে!) খায়, পাঁইস্যার নাম', যাহার প্রমিত অনুবাদ হইবে: 'সকল মৎস্যে বিষ্ঠা ভক্ষণ করে, যদিও দুর্নাম হয় পাঙ্গাসের।' তবে ইহাও ঠিক যে পাঁচটা কিংবা দশটা (কী? কিছু একটা হবে!) অনায়াসে ভক্ষণ করিতে পারিলেও তক্ষশীলার মহান শিক্ষকগণ বিশটা ভক্ষণ করিবার মতো রুচি ও উদরের অধিকারী নহেন।

যাত্রাপালা চন্দ্রগুপ্ত-১১। একাদশ অঙ্ক। প্রথম দৃশ্য।

উপাধ্যক্ষের কর্মকক্ষ। আকৈত্রজৈমন খোশমেজাজে আরাম-কেদারায় বসিয়া আছেন। সন্মুখে উপবিষ্ট শশৈরক ও হলধর সফুঈল্ল। আলোচনার বিষয়বস্তু ককেশীয় কিংবা চৈনিক জাতির সুরাপান।

আকৈত্রজৈমন (উপবিষ্ট হলধর সফুঈল্লের দিকে অপাঙ্গে দৃষ্টিপাত করিয়া): শুনিয়াছি, বীয়র পান করিলে অভূতপূর্ব একটি মুত্রবেগ অনুভূত হয়। কিন্তু সুরা নামক বস্তুটি মনুষ্য কেন পান করে? উহা পান করিয়া কি মনুষ্য অমর হইবার আকাক্সক্ষা করে? অধ্যাপক শশৈরক, আপনিতো বহু বর্ষ ফরাসিস দেশে কাটাইয়াছেন। আপনিই বলুন।

শশৈরক: আর্য, সুরাপানে অমরত্ব অর্জন অসম্ভব কার্য নহে। অদ্যাপি মরি নাই বলিয়া স্বচক্ষে দেখিবার সৌভাগ্য হয় নাই, কিন্তু মৃত্যুর পর স্বর্গবাসীগণ সুরার নহরে উপুর হইয়া চুমুক দিয়া মুফতে ইচ্ছামতন সুরা পান করে বলিয়া শুনিয়াছি। সুরাপান করে বলিয়াই তাহারা সুর, সুর মাত্রেই অমর এবং অমরদের বাসস্থান বলিয়া স্বর্গের অন্য নাম অমরাবতী।

তুরানী ভাষার অধ্যাপক নুদশ-নাদুশ সফুঈল্ল জর্দা সহযোগে গুয়াপর্ণ চিবাইতেছিলেন। বিন্দুমাত্র বাক্যব্যয় না করিয়া জর্দার মৌতাত উপভোগ করিতে করিতে নীরবে শশৈরকের প্রতি তিনি অপলক দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিলেন, যে দৃষ্টি হইতে কোনোমতেই বুঝিবার উপায় নাই উপাধ্যক্ষ কিংবা শশৈরকের সহিত তিনি একমত কি দ্বিমত। সফুঈল্লের নারকেলী বড়ই-সদৃশ মুখম-লে গ-দেশের হনু ও উত্তম-অধম দন্তপাটির উত্থান-পতন হইতে অনুমান করা যাইতেছিল যে দন্তমূলে লেপটাইয়া থাকা গুয়াপর্ণের কর্তিত কুচি জিহ্বাদ্বারা মুখগহ্বরের অন্যত্র স্থানান্তরিত করিতে করিতে তাঁহার মস্তিষ্ক গোপন কোনো অ-সুর প্যাঁচ কষিতে ব্যস্ত ।

যাত্রাপালা চন্দ্রগুপ্ত-১১। একাদশ অঙ্ক। দ্বিতীয় দৃশ্য।

সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের নক্ষৈলপাড়ার কর্মভবন। সম্রাট শাক্যহসৈন নিজ কর্মকক্ষে বসিয়া দূরালাপনীযোগে গুরুদেব চাণক্যের সহিত আলাপরত।

চাণক্য: বৎস, নির্বাচন-মহাসমরে তোমার অভূতপূর্ব বিজয় দেখিয়া অন্য সকলের ন্যায় আমিও হতবাক হইয়া গিয়াছি। ফলপ্রকাশের রাত্রিতে ভয় হইতেছিল, তিন শতের অধিক আসনে জিতাইয়া আমলক দলের অতিউৎসাহী সমর্থকেরা না তোমাকে আবার জাতি ও বিশ্বের নিকট হাস্যস্পদ করিয়া তোলে!

চন্দ্রগুপ্ত: গুরুদেব, জিতিবার সকল আঁটঘাট শক্ত করিয়া বাঁধিবার পরেও সেনাপতির মনে অজানা সন্দেহ থাকিয়া যায়: যদি, যদি…! নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে প্রতিপক্ষের সমর্থকগণের মুখে মুখে ছিল যে ভোটবিপ্লব, সেই বিপ্লব যদি হইয়াই যাইত, তবে কী অঘটন ঘটিতে পারিত, একবার চিন্তা করুন গুরুদেব! মহাভারতে দুর্যোধন বলিয়াছিলেন: 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যাগ্র মেদিনী', সুঁইয়ের অগ্রভাগের কথা তিনি কেন বলিয়াছিলেন? কারণ সামান্য সুঁই ঢুকাইতে দিলে প্রতিপক্ষ যদি অসামান্য ফাল হইয়া বাহির হইতে চেষ্টা করে!

কোনো শিক্ষার্থী যদি এক শতে নব্বই নম্বর পাইবার প্রস্তুতি নেয়, তবে তাহার পক্ষে শতভাগ নম্বর পাওয়া আশ্চর্যের কী? গুরুদেব! তীরে ধনুকের জ্যা-আরোপন করিয়া যত জোরেই টান দেওয়া হউক না কেন, তীর কতদূর যাইবে কিংবা কত জোরে প্রতিপক্ষকে আঘাত করিবে তাহা তীরন্দাজের শক্তি ও ধনুর্বিদ্যা শিক্ষার উপর অনেকটা নির্ভর করিলেও সবটা নির্ভর করে না। বায়ুপ্রবাহ যদি প্রতিকূল হয়, তীরের ভর ও ওজন যদি কমবেশি হয়, প্রতিপক্ষ যদি উপযুক্ত বর্ম দ্বারা সুরক্ষিত হয়, তবে আশানুরূপ ফল নাও আসিতে পারে। সাম্প্রতিক নির্বাচন মহাসমরে আমলক দলের অস্বাভাবিক বিজয়ের পিছনে আমার অপ্রতিরোধ্য প্রস্তুতি অবশ্যই ছিল, কিন্তু অনুকূল বায়ুপ্রবাহ, শত্রুর দুর্বলতা এবং তাহাদিগের নির্বাচন-সমরকালীন অপ্রস্তুতি… এই সকল বিষয়ও অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করিয়াছে।

চাণক্য: বৎস চন্দ্রগুপ্ত, উন্নত সমর-প্রকৌশলের কারণে সেনাপতিগণ যেমন প্রতিপক্ষকে গো-হারান হারায়, তেমনি তুমিও নির্বাচন-প্রকৌশল অবলম্বন করিয়া অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করিয়াছ, কিংবা প্রতিপক্ষও তোমার অবস্থানে থাকিলে তুমি যাহা যাহা করিয়াছ ঠিক তাহা তাহাই করিত- তোমার ইত্যাকার যুক্তি যদি নির্বিচারে গ্রহণও করি, তবুও একটি সন্দেহ থাকিয়া যায় বৈকি! নির্বাচন কর্মকর্তাগণ কোনো না কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কোনো না কোনো ব্যাংকের কর্মকর্তা কিংবা সরকারি কায়স্থ। তাহাদিগকে উৎকোচ প্রদান করিয়া নির্বাচনের পূর্বযামিনীতে মোহরযুক্ত সমর্থন-পত্র দিয়া সমর্থন-ভাণ্ড পূর্ণ করিয়াছ বলিয়া তোমার প্রতিপক্ষ অভিযোগ করিতেছে। আমলক দলের বাহুবলীগণ বিপক্ষ দলের সমর্থকগণের বাড়ি বাড়ি গিয়া নির্বাচনের পূর্বরাত্রিতে নাকি বলিয়া আসিয়াছে: 'আপনাদিগের জানুদ্বয় যদি স্বস্থানে এবং আরও কিছু দিন কর্মক্ষম রাখিতে চাহেন তবে কষ্ট করিয়া আপনাদিগের সমর্থনকেন্দ্রে যাইবার প্রয়োজন নাই।' তোমার পক্ষের ব্যক্তিগণও এই সকল অভিযোগের প্রতিবাদ করিতে গলায় ঠিক জোর পাইতেছে না। এই সকল দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাগণ ও যুবকগণ যদি নিজ নিজ কর্মস্থলে গিয়া নব নব দুর্নীতি ও অপকর্মে লিপ্ত হয়, তবে তাহাদিগকে বাধা দিবার মত নৈতিক বল কি তোমার থাকিবে, বৎস? যে একেকটি স্তম্ভের উপর দেশ নামক কল্পিত কাঠামোটি দণ্ডায়মান থাকে, সেই স্তম্ভগুলি হইতেছে দেশের একেকটি প্রতিষ্ঠান। সেই স্তম্ভগুলিকে যদি তুমি নিজ স্বার্থে দুর্বল করিয়া তোল কিংবা যদি তাহাদিগের নৈতিক ভিত্তি চিরতরে ধ্বংস করিয়া দাও, তবে কাঠামোটি যে অদূর ভবিষ্যতে মুখ থুবরাইয়া পড়িবে না সেই নিশ্চয়তা কে দিবে? সুদীর্ঘ শাপলা সেতু দৃশ্যমান করিয়া কিংবা উন্নত সড়ক নির্মাণ করিয়া কি সেই মহাপাপ তুমি স্খালন করিতে সক্ষম হইবে?

যাত্রাপালা চন্দ্রগুপ্ত-১১। একাদশ অঙ্ক। তৃতীয় দৃশ্য।

দক্ষিণ পাটলিপুত্রে অবস্থিত তক্ষশীলা কারাগারে খলৈদার অপরিসর কারাকক্ষ। একটি অতি সাধারণ চৌকিতে উপাধানে কনুই রক্ষা করিয়া খলৈদা আধশোয়া। সাক্ষাৎ করিতে আসা বনৈপি নেতা ফকৈরুল সন্মুখস্থ একটি নিম্নতর আসনে জোরহস্তে এবং মস্তক যথাসম্ভব অবনত করিয়া উপবিষ্ট।

খলৈদা (বিলাপ করিতে করিতে): আর্য ফকৈরুল, বহু বর্ষ পূবে, বিংশ শতকের পঞ্চসপ্ততি সনে, যখন আমার স্বামী জৈয়হর্মনকে মহান শাক্য মৌর্যবের হত্যায় নীরব সম্মতি প্রদান করিতে দেখিয়াছিলাম, তখনই আমি নিশ্চিত হইয়াছিলাম যে জয় আমাদিগের হইবে না। জ্যেষ্ঠপুত্র তরৈক যখন দাড়িম্ব-বোম্ব নিঃক্ষেপ করিয়া চন্দ্রগুপ্ত শাক্যহসৈনকে সবান্ধব, সপারিষদ হত্যার পরিকল্পনা করিয়াছিল, তখনই আমি নিশ্চিত হইয়াছিলাম যে জয় আমাদিগের হইবে না। শাক্য হসৈনের উপর দাড়িম্ববোম্ব নিঃক্ষেপের অপরাধে স্বরাষ্ট্র-অমাত্য বব্বর হস্তিসেতুর নিকটবর্তী এক সাইবার ক্যাফে-বিপনী হইতে পার্থ নামক এক নিরপরাধ কিশোরকে কারারুদ্ধ করিয়া অকথ্য অত্যাচার করিলে তাহার অসহায় পিতা-মাতাকে ভূমিতে লুটাইয়া করুণ বিলাপ দেখিয়া আমি নিশ্চিত হইয়াছিলাম যে জয় আমাদিগের হইবে না। আমি আপনাকে অনুরোধ করিব, সেই পার্থকে খুঁজিয়া বাহির করুন এবং আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ হইতে তাহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন, নতুবা আমার পরিবারের সদস্যগণের কপালে আরও দুঃখ আছে।

ইহার পর জজ মিয়া নামক এক অর্ধ-উন্মাদকে বলির পণ্টক (পাঁঠা) বানাইয়া বব্বর যখন তাহার উপর দাড়িম্ব-বোম্ব নিঃক্ষেপের সকল দায় চাপাইয়া দিবার চেষ্টা করিল, তখনই আমি নিশ্চিত হইয়াছিলাম যে জয় আমাদিগের হইবে না। আমার জ্যেষ্ঠপুত্র তরৈক যখন বায়ু-ভবনে বসিয়া রাজ্যের দুর্নীতিতে নিমগ্ন হইয়াছিল, বিদ্যুত-স্তম্ভের মত অকিঞ্চিৎকর বস্তু সরবরাহ হইতেও সবান্ধবে উৎকোচ গ্রহণ করিতেছিল, তখনই আমি নিশ্চিত হইয়াছিলাম যে জয় আমাদিগের হইবে না। আমার দ্বিতীয় শাসনামলে যখন একসপ্ততি সনের যুদ্ধাপরাধীগণকে অমাত্য পদ দিয়া বাঙালি জাতিসত্তাকে ইচ্ছা করিয়া চরম অপমান করিয়াছিলাম তখনই আমার নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল যে জয় আমাদিগের হইবে না। যখন ষড়যন্ত্র করিয়া গজাগার বিদ্রোহ ঘটাইয়া আমলক সরকারকে বেকায়দায় ফেলিবার চেষ্টা হইল, শত শত সেনা কর্মকর্তা খুন করা হইল, তখনই আমি নিশ্চিত হইয়াছিলাম যে জয় আমাদিগের হইবে না। ইচ্ছা করিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করিয়া আমলকদলকে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ দিয়া, তাহাদিগকে বেকায়দায় ফেলিবার জন্য যখন আমার দলের কর্মীগণ রাত্রির অন্ধকারে গণশকটে অগ্নিবোমা নিঃক্ষেপ করিয়া নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে খুন-জখম করিতেছিল, তখনই আমি নিশ্চিত হইয়াছিলাম যে জয় আমাদিগের হইবে না। তরৈক যখন পশ্চিম সাগরপারে বসিয়া পরীক্ষিত নেতাগণকে বাদ দিয়া যাহাকে-তাহাকে মনোনয়ন দিয়া স্বস্বার্থে অর্থসংগ্রহ করিতেছিল, তখনই আমি নিশ্চিত হইয়াছিলাম যে জয় আমাদিগের হইবে না। যখন নিদারুণ নেতৃত্বসঙ্কটে পড়িয়া দুই আমলক চর, এক বিভীষণ আপনি এবং অন্য জন আমলকপন্থী কমলহৈসনকে নির্বাচনের সকল দায়িত্ব দিতে বাধ্য হইলাম, তখনই আমি নিশ্চিত হইয়াছিলাম যে জয় আমাদিগের হইবে না। সর্বশেষে, গত নির্বাচনে যখন স্বাধীনতা-বিরোধী জমৈত দলের নেতৃবৃন্দকে (হিন্দুধর্মের লক্ষ্মীদেবীর পবিত্র) ধান্যশীর্ষ চিহ্ন লইয়া নির্বাচন করিতে দিলাম, তখনই আমি নিশ্চিত হইয়াছিলাম যে জয় আমাদিগের হইবে না।

ফকৈরুল: হে আমিরা-উল-মুমেনিনা! জয় আমাদিগের হইতেই পারে না, কারণ জয় সম্রাট শাক্য হসৈনের একমাত্র পুত্র। আমাদের দলে সে আসিবে কী করিয়া? জয় কমলহৈসন কিংবা কাগজীয়া ব্যাঘ্র কদৈর সৈদ্দকী নহে যে চুন হইতে পান খসিলেই ডিগবাজী দিয়া দলবদল করিবে। যাহা হউক,আপনি অবশ্যই অবগত আছেন যে আমি উত্তর কৈশোরে কিংবা প্রাগ যৌবনে কর্মনষ্ট কিংবা ভামপন্থী শিক্ষার্থী সঙ্ঘের সদস্য ছিলাম। তখন অল্প-বিস্তর লেখাপড়া করিবার সুযোগ আমার হইয়াছিল। আপনার দলে যোগ দিবার পর আকাট মূর্খপরিবৃত হইয়া লেখাপড়া আর করি নাই, প্রয়োজনও হয় নাই। মুহতারিমা! আপনার 'বিলাপ' শ্রবণ করিয়া আমি যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত হইয়াছি এই কারণে যে সহস্রাধিক বৎসর পূর্বে রচিত মহাভারতের একটি চরিত্র বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাহার দলের সমূহ পরাজয়ের পর পুত্রের একেকটি কুকর্মের উল্লেখ করিয়া আপনার মতই বিলাপ করিয়াছিলেন। প্রতিটি শ্লোকের শেষে 'ন বিজয়ায় সংশয়ে, সঞ্জয়!' অর্থাৎ 'হে সঞ্জয়, তখনই বিজয়ের আশা পরিত্যাগ করিয়াছিলাম!' কথাযুক্ত মহাভারতের এই বিশেষ অংশটি 'ধৃতরাষ্ট্র বিলাপ' নামে খ্যাত। আপনার আজিকার বিলাপ 'খলৈদা বিলাপ' নামে বিখ্যাত হইলে আমি আশ্চর্য হইব না। আপনার মতই বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র পুত্র স্নেহে অন্ধ ছিলেন। আপনার জ্যৈষ্টপুত্র তরৈকের মতই প্রতিপক্ষকে সবংশে হত্যা করিবার ব্যর্থ চেষ্ঠাসহ হেন দুষ্কর্ম নাই যাহা ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্টপুত্র দুর্যোধন আশৈশব করে নাই এবং আপনার মতোই প্রতিটি দুষ্কর্মে তাহার পিতা ধৃতরাষ্ট্রের সরব কিংবা নীরব সমর্থন ছিল।

যাত্রাপালা চন্দ্রগুপ্ত-১১। একাদশ অঙ্ক। চতুর্থ দৃশ্য।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের বিশ্রম্ভাগার। ফহৈমদ ও শশৈরক আলোচনারত। চতুপার্শ্বে বনৈপি, জমৈত ও বামপন্থী শিক্ষকগণ আমলক দলের বিজয়ে হতবিহ্বল হইয়া মাতমের সুরে ছিঃ ছিঃ করিতেছেন। অস্থিরপন্থী ফহৈমদ সেই ছিঃছিঃ কারে যোগদান করিয়া অধ্যাপক শশৈরকের প্রতি তাহার অবস্থান জানিবার জন্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিপাত করিলে শশৈরক কহিলেন:

শশৈরক: দ্বাদশ বর্ষ ধরিয়া অব্যবহৃত পুরনো গাদা বন্দুকে জঙ ধরিয়া গিয়াছিল এবং বহুদিন কোনো গুলিও ক্রয় করা হয় নাই। তবু (পঞ্চসপ্ততি সনের গোলাবিহীন ট্যাংকের ন্যায়) সেই গুলিবিহীন বন্ধুকখানিও সঙ্গে না নিয়া ভাঙা, বহুছিদ্রযুক্ত, গুলাবী রঙের জাতীয়তাবাদী ছত্রখানি হস্তে ধারণপূর্বক দুই মনভোলানো হ্যামেলিনের বংশীবাদককে অনুসরণ করিয়া নির্বাচনের সুন্দরবনে হাজির হবার দুঃসাহস করিয়া বেঘোরে আহত-নিহত হইবার পর কেহ যদি এই বলিয়া হাহুতাশ করে যে গোপালীয় শার্দুলমহোদয় কেন আগেভাবে নেইলকাটার দিয়া তাহার নখকর্তন করিয়া রাখেন নাই কিংবা আমলক ব্যাঘ্রমামার দন্ত হঠাৎ এমন অস্বাভাবিক ধারালো হইবার কারণ কী, তবে তাহাকে সান্তনা দিবার ভাষা আমার জানা নাই।