স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আগে দেশ জামায়াত মুক্ত হতে হবে

স্বদেশ রায়
Published : 16 Jan 2019, 03:01 PM
Updated : 16 Jan 2019, 03:01 PM

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এখন আর বাংলাদেশের নিবন্ধিত কোনও রাজনৈতিক দল নয়। তবে তাদের সাংগঠনিক কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই। তা ছাড়া বিএনপি তাদের প্রধান প্রশ্রয়দাতা হওয়ায় তারা ব্যাপক আকারে সাংগঠনিক কাজ চালাচ্ছে বিএনপির ছদ্মাবরণে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী এভাবে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলে দেশের রাজনীতিতে বিভাজন থাকবেই। দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। দেশকে এ মুহূর্তে এগিয়ে নিতে হলে প্রথমেই দরকার দেশকে বিভাজন মুক্ত করা। ১৯৭৫ সালে ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে সামরিক শাসকদের ঘাড়ে চেপে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেশকে বিভাজন করেছে। তারা স্বাধীন দেশে একটি স্বাধীনতাবিরোধী ধারা দাঁড় করিয়েছে। এমনকি তাদের এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সংবিধানও পরিবর্তন করেছিল- যার শত ভাগ সংশোধন এখনও সম্ভব হয়নি। দেশের এই বিভাজন যত দ্রুত সম্ভব দূর করা দরকার। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে এসে এখন দেশে আর কোন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি থাকতে পারে না। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনীতির স্বার্থে নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার বিরোধী ধারায় মোটিভেট করছে। স্বাধীনতা বিরোধী ধারা রাজনীতিতে ও সমাজে না থাকলে জামায়াতের কোনও অস্তিত্ব থাকে না। তারা টিকেই আছে স্বাধীনতাবিরোধী ধারা বাঁচিয়ে রাখার কারণে। তাই দেশকে এক জাতি এক চেতনায় আনতে হলে সবার আগে দেশকে জামায়াত মুক্ত করতে হবে।
দেশকে জামায়াত মুক্ত করতে হলে প্রথমেই দরকার দেশের সাধারণ মানুষের ভেতর একটা ঐক্য গড়ে তোলা। আর সে ঐক্যের মূল সুর হতে হবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর যখন পালিত হবে তখন যেন দেশে স্বাধীনতার বিরোধী ধারায় কেউ তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ না পায়। এ জন্য প্রগতিশীল দলগুলোর রাজনৈতিক সততা, প্রজ্ঞা ও যোগ্যতা প্রয়োজন। যেমন কোটা আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল ইসলামী ছাত্র শিবিরের কাছে। নুরু, রাশেদ সবাই ইসলামী ছাত্র শিবিরের সদস্য। কিন্তু দুঃখজনক হলো প্রগতিশীল বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো শুধু আন্দোলন করার জন্য তাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। যা হোক, অতীতের ভুল বা জীবনের ভুল সব সময়ই বড় শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের তরুণদের তাই এই কোটা আন্দোলনের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, রাজনীতির নামে, আন্দোলনের নামে এমন কোন কিছু বাংলাদেশে নয়- যার ফাঁক দিয়ে জামায়াতে ইসলামী ঢুকে পড়তে পারে। এমনকি ওই আন্দোলন বা রাজনীতির ভেতর দিয়ে জামায়াতে ইসলামী বা কেউ যেন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী মনোভাব তৈরির সুযোগ না পায়।
পাশাপাশি বাংলাদেশের বাম রাজনীতির আরও একটি সমস্যা আছে। তারা বঙ্গবন্ধুকে ও আওয়ামী লীগকে বিরোধিতা করতে গিয়ে কখনও কখনও এমন পর্যায়ে চলে যায়, যার সুযোগ নেয় জামায়াতে ইসলামীসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো। এমনকি তাদের এই উগ্র বঙ্গবন্ধু বিরোধিতা ও আওয়ামী লীগ বিরোধিতার মানসিকতার ভেতর দিয়ে যে তরুণ প্রজন্ম তৈরি হয়, তাদের একাংশের চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর মানসিকতা মিলে যায়। বাস্তবে প্রগতিশীল রাজনীতি করার কাজটি খুবই কঠিন। প্রতিক্রিয়া বা রক্ষণশীলতা অনেকখানি সমাজের সহজাত ধারা। অন্যদিকে প্রগতিশীল ধারা বোধ দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে তৈরি করতে হয়। এটা কঠিন চর্চার বিষয়। বাম রাজনীতির ধারায় চর্চা আছে তবে সে চর্চায় দেশীয় ঐতিহ্য ও খোলা হাওয়া কম। যে কারণে তাদের চর্চা শতভাগ ফল পায় না। অথচ দেশের প্রয়োজনে তাদের চর্চার মাধ্যমে যে ধারা তৈরি হবে, সেখানে দেশের জন্যই হওয়ার সুযোগ বেশি। এটাই এখন তাদের ভাবতে হবে। কারণ, প্রগতিশীল এই বাম রাজনীতির ধারাটি উপমহাদেশে শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশেও তাদের বয়স বাংলাদেশের সমান। এই দেশ সৃষ্টিতে তাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আছে। এ কারণে এই দেশ থেকে স্বাধীনতাবিরোধী ধারা জামায়াতকে নিঃশেষিত করার দায়িত্বটি তারা এড়াতে পারে না।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে যেভাবে জামায়াত মুক্ত করার কাজ চলছে, তা এ দেশের ইতিহাসের অংশ। কারণ, শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও অভাবনীয় সাহস না হলে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হতো না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশকে জামায়াত মুক্ত করার কাজ অনেকখানি এগিয়েছে। তবে এখানে আওয়ামী লীগ যেন শতভাগ কৃতিত্ব না নেয়। এখানে তাদের ভাগ দিতে হবে দেশের বাম শক্তিকেও। তারা সংখ্যায় যাই হোক না কেন, সেদিন তারা তাদের শতভাগ দিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চে। আর শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে বাংলাদেশে জনমত তৈরি করতে গণজাগরণ মঞ্চ যে ভূমিকা রাখে, তাও আমাদের ইতিহাসের অংশ। সেদিন বাম শক্তিগুলোকে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ স্পেস দিয়েছিল বলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলায় বাম শক্তিগুলো তাদের সর্বশক্তি নিয়ে নামতে পেরেছিল। আজ যখন দেশকে জামায়াত মুক্ত করার একটি অনিবার্য সময় সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এ সময়ে দেশের প্রগতিশীল ছোট রাজনৈতিক দল ও বাম শক্তিগুলোকে সেই স্পেস দিতে হবে আওয়ামী লীগকে; যাতে তারা দেশকে জামায়াত মুক্ত করতে গণজাগরণ মঞ্চের মত এক সঙ্গে কাজ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনোত্তর শুভেচ্ছার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে গণভবনে আহ্বান করতে যাচ্ছেন। এই শুভেচ্ছা অনুষ্ঠানই সত্যি অর্থে 'শুভ ইচ্ছার' অনুষ্ঠান হতে পারে। এখান থেকেই শুরু হতে পারে এ পথ চলা যে, রাজনৈতিকভাবে মত-পথের যে পার্থক্য থাকুক না কেন অন্তত এই বিষয়ে সবাই এক যে, স্বাধীনতার ৫০ বছর যখন পালিত হবে তখন দেশে কোন জামায়াতে ইসলামী থাকবে না।
দেশকে জামায়াত মুক্ত করার এই পথ চলায় এ মুহূর্তে তাই চিহ্নিত করা প্রয়োজন বাস্তবে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর টিকে থাকার সহায়ক শক্তি কী কী? জামায়াতে ইসলামীর অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান আছে ঠিকই, তবে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে যদি জামায়াত টিকতে না পারে এবং আগামীতে যদি তরুণ প্রজন্ম আর বিভ্রান্ত না হয়, তাহলে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান খুব কাজে আসবে না। তাই এ মুহূর্তে চিহ্নিত করা দরকার জামায়াতকে টিকিয়ে রাখছে কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি? ২০১৮ এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে গেছে এ মুহূর্তে জামায়াতকে টিকিয়ে রাখতে কোন কোন রাজনৈতিক শক্তি ও সামাজিক শক্তি কাজ করছে। ২০১৮ এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে, বিএনপির ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি ড. কামাল, আ স ম আব্দুর রব, কাদের সিদ্দিকী আর এদের মানের না হলেও মাহমুদুর রহমান মান্না জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে এতদিন অস্পষ্ট থাকলেও এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে নয়া দিগন্ত ও সংগ্রাম যেমন জামায়াত বিএনপির মুখপত্র, তেমনি দেশের অন্যতম জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোও জামায়াত- বিএনপির মুখপত্র। এ ছাড়া জামায়াতের পক্ষে রয়েছে সুজনসহ কয়েকটি সামাজিক সংগঠন। তাই এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে, এতদিনে অস্পষ্ট থাকলেও এবার ড. কামাল ও তার সহযাত্রীরা জামায়াতের পক্ষ নিয়েছেন। আর দেশের একটি প্রভাবশালী দৈনিক জামায়াত ইসলামীর পক্ষ নিয়েছে। তবে ২০১৮ এর নির্বাচনের এটাও একটা বড় লাভ যে আরও কিছু মুখোশ খুলে গেছে।

বাস্তবে দেশ যতই গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করবে, সামরিক শাসকের উত্তরাধিকারের খপ্পর থেকে যতই বেরিয়ে আসবে, ততই অনেক মুখোশ খুলে যাবে। যা হোক, ড. কামাল বা সুজনের কুশীলবরা জামায়াতের পক্ষে থেকে খুব বড় কিছু করতে পারবে না। কারণ, এদের প্রভাব সমাজে খুবই কম এবং ২০১৮ এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে চিহ্নিত হয়ে গেছে। ড. কামাল অবশ্য বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে যাওয়া তার ভুল হয়েছে। তিনি নির্বাচনের আগে আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, তিনি জানতেন না যে জামায়াতকে মনোনয়ন দেয়া হবে। দেশের মানুষ দেখতে পাচ্ছিল, পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে জামায়াতের মনোনয়ন নিয়ে কথা হচ্ছিল, অথচ ড. কামাল জানতেন না! এটা কি দুগ্ধপোষ্য শিশুও বিশ্বাস করবে? বাস্তবে ড. কামাল দেশের মানুষকে বোকা মনে করেন। তবে ড. কামালকে নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। তিনি কোন্ মাপের তা 'খামোশ' ও 'জানোয়ার' বলার ভেতর দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এরা জামায়াতের পক্ষের। যে ব্যক্তি সাংবাদিককে খামোশ বলতে পারেন, পুলিশদের জানোয়ার বলতে পারেন, তার অবস্থান নিয়ে নিশ্চয়ই, আর কারও কোন প্রশ্ন নেই। বরং তিনি জামায়াত সম্পর্কে এসব কথা বলে প্রমাণ করছেন, তিনি অসত্যও বলেন। যা হোক, ভবিষ্যতের বাংলাদেশে তিনি বা তার সহযাত্রীরা দেশের কোন প্রয়োজনীয় অংশ নয়। এমনকি বিএনপিও এখন তার সম্পর্কে এ কথা বলতে শুরু করেছে। তাই এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে ড. কামালকে পাওয়া জামায়াতের কোন লাভ নয়, অন্যদিকে বিএনপি তো তাদের সঙ্গে আছে সব সময়। এ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে জামায়াতের সব থেকে বড় লাভ হয়েছে প্রথম আলোকে মুখপত্র হিসেবে পাওয়া। কারণ এই সংবাদপত্রটি তরুণ প্রজন্মকে ছদ্মবেশী জামায়াত হওয়াতে সাহায্য করছে ও করবে। তারা পরোক্ষভাবে এ দেশে জামায়াতী চিন্তা-ভাবনা, যা দেশকে বিভক্ত করে সেটা বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। তাই স্বাধীনতার ৫০ বছর পালনের আগে বাংলাদেশকে জামায়াত মুক্ত করতে হলে দৈনিক প্রথম আলো নিয়ে তরুণ প্রজন্মকে ভাবতে হবে। সচেতন হতে হবে তরুণদের অভিভাবকদেরও। এ ছাড়া যে সকল রাজনৈতিক শক্তি দেশকে জামায়াত মুক্ত করতে চায়, তাদেরও এ নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, আর যাই হোক দেশে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত থাকবে আর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে, এটা হতে পারে না। জামায়াত মুক্ত দেশেই পালিত হতে হবে স্বাধীনতার ৫০ বছর।