যখন আমি উত্তরে যাই তখন আমার দেখা যুদ্ধ ময়দান, বাংকার বা অস্ত্র শস্ত্র যতটা নজর কেড়েছে তার চেয়ে বেশি মনে আছে সেখানে আমেরিকানদের ধ্বংসযজ্ঞ। দক্ষিণ ভিয়েতনামে দেখা সেই জাদুঘরটি এখনও আমার চোখে বিভীষিকাময়। নাপাম বোমার পর চারদিকে কুণ্ডলি পাকানো ধোঁয়ার ভেতর উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় নেমে আসা ভিয়েতনামীদের ছবি আপনাকে হতবিহ্বল করবেই। চাইলেই কি তা ভোলা যায়?
আমি দেখেছি পর্যটকদের ভেতর আমেরিকানদের বিবর্ণ চেহারা। তারা জোর করে মুখে হাসি ঝুলিয়ে কথা বললেও, তাদের মনে মনে পরাজয়ের গ্লানি এখনো প্রবাহমান। অন্যদিকে বদলে যাওয়া ভিয়েতনামের নতুন প্রজন্মের ভেতর চীনের চেয়ারম্যানের চাইতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি জনপ্রিয় হলেও তারা ইতিহাস ভোলেননি। তাদের জাতীয়তাবোধ আর জন্মপ্রক্রিয়া এখনও তাদের গর্ব। যা আমি কম্বোডিয়াতেও দেখেছি। পলপটের মতো গৃহশত্রুর বিরুদ্ধে তাদের কঠিন মনোভাব আজও সমান সক্রিয়।
একাত্তরে পরাজিত জামায়াত দমেনি। আমাদের যুদ্ধ কেবল পাকিস্তানিদের সাথে ছিলনা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের ঘরের দুশমন, দালাল-রাজাকারেরাও যুদ্ধ করেছিল। তারা নিজ দেশের মা বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করা, লুণ্ঠনে সহায়তা করার পাশপাশি দেশের সাথে বেঈমানি করতে ভুল করেনি। কোনও মাফ বা মার্জনায় কাজ হয়নি। সময় বুঝে তারা আধুনিক মুসলিম লীগ, বিএনপির সাথে মিলে এদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর ধান্দায় আছে। সময়, শেখ হাসিনা আর শাহবাগ তা হতে দেয়নি। সে কারণে তাদের ক্রোধ। তারা নানাভাবে অপকৌশল চালানোর চেষ্টা করে যদিও ব্যর্থ।
কিন্তু আজ আবার তাদের সামনে নিয়ে আসছে এককালের আওয়ামী লীগার নামে পরিচিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন। এ লজ্জা রাখার জায়গা নাই। তিনি মুখে যাই বলুন না কেন, নিজেই ভালো জানেন কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাকে সামনে আনা হয়েছে। গণতন্ত্র যদি বিষয় হতো তা তিনি নিজেই সামলাতে পারতেন। বিষয় ভিন্ন।
সে কারণে কামাল হোসেন আবার জামায়াত প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে এসেছেন। একটা বিষয় পরিষ্কার, নিবন্ধন বাতিল হোক, আর যাই হোক জামায়াত আছে।
এদিকে খবরে দেখলাম বিএনপি বলছে, তারা জামায়াতকে ছেড়ে যাবেনা। যদি না জামায়াত তাদের ছেড়ে যায়। আহারে পীরিতি! এ যেন মধুর প্রেমের টেস্ট। কে কাকে ছেড়ে যায় দেখি তো- এই টাইপের। আসলে সবকিছুর মূলে হিসেব- ভোটের হিসেব। বাংলাদেশ যেকোনও সময়ই সবার মতে সঠিক, গ্রহণযোগ্য বা সর্বজন স্বীকৃত ভোট হলে এই হিসেবের দরকার পড়বে। বিএনপির আর আওয়ামী লীগের সাথে এঁটে ওঠার সময় নাই। দীর্ঘকাল গদির বাইরে, দেশ শাসনের বাইরে থাকাতে, তাদের অর্থবল কমে গেছে। জনবলও তাই কমতির দিকে। ক্যাডার বা দলের মারমুখো নেতারাও এখন 'সাইজড'। এমন অবস্থায় তাদের রুখে দাঁড়ানো খালি মাইক্রোফোনে আর মিডিয়ায়। তাই তারা জামায়াতকে ছাড়বে এমন কথা জান গেলেও উচ্চারণ করবেনা।
অন্যদিকে ঝামেলায় আছেন কামাল সাহেব। সারাজীবন আওয়ামী লীগের খেয়েপড়ে শেষ বয়সে ব্যক্তিক্রোধ আর বঞ্চনার ঝাল মেটাতে সবার প্রিয় হবার জন্য যে পথ বেছে নিয়েছেন তার প্রথমপর্ব খতম। খামোশ বা সংলাপ কোনওটাই কাজে আসেনি। নিজে তো ভোটেই গেলেননা। যে দুজন জিতে এলো তাদেরও ঝুলিয়ে রেখেছেন। ড. কামাল হোসেনের মনে যাই থাক, মুখে তিনি জামায়াতের হয়ে কিছু বলতে পারেননা। বললে তার সাথে কাদের সিদ্দীকির আর কী তফাৎ থাকলো? কাজেই এই বয়সেও তিনি 'ঝুট-কে সাচ্চা' বলে চালাতে চাইছেন। একজন প্রবীণ বয়োবৃদ্ধ মানুষ কিভাবে বলেন যে তিনি জানতেন না- বিএনপির ছায়ায় জামায়াত ইলেকশন করেছিল বা করবে? না জানার কী কোনও কারণ আছে?
তারা তো দেখি প্রায় রোজই জরুরি মিটিং এ বসেন। সেগুলোতে কী আলোচনা হয় তবে? অনেকে এখন বলছেন, রিটায়ার্ড নেতাদের বিলাস আর হতাশাকেন্দ্র- এইসব আলোচনার ঘর। সেখানে তারা সময় কাটান। আর এমন সব কথা বলেন, যাতে মাঠ গরম থাকে। ড. কামাল হোসেন যে কারণেই হোক জামায়াত প্রসঙ্গ এনে আরও একবার মানুষের মনে প্রশ্ন আর বিরক্তি উসকে দিলেন । জবাব তাকেই দিতে হবে। একেই বলে শাঁখের করাত। সাফ সাফ বলতে না পারলে এমন তো হবেই। কেন আপনি মেরুদণ্ড সোজা করে বলতে পারছেন না, জামায়াত থাকলে আমরা নাই? আর যদি চান আপনার তরফ থেকে বিভেদরেখা মুছে যাক- তাই বলুন। তা না করলে এমন দোটানায় শেষে ব্যক্তি ইজ্জতও খোয়াবেন।
জামায়াত আছে কী নাই, এই প্রসঙ্গ বারবার ফিরে এসে প্রমাণ করে- আমাদের দেশে এখনও মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির দিন শেষ হয় নাই। প্রমাণ করে, এখনো দেশবিরোধী স্বাধীনতা বিরোধীদের রক্তবীজ রয়ে গেছে। তাই থামার সুযোগ নাই। আছে সাবধানতা আর সতর্কতার প্রয়োজন। শেষ বয়সে ড. কামাল হোসেন কোনদিকে ডিগবাজী খেয়ে ইতি টানেন সেটাই এখন দেখার বিষয় ।