আমাদের প্রকাশনা জগতের ভেতরে ও বাইরে

আনিসুর রহমান
Published : 14 Jan 2019, 12:23 PM
Updated : 14 Jan 2019, 12:23 PM

আমাদের দেশে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বই নিয়ে বর্ণাঢ্য ডামাডোল শুরু হয়ে যাবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে। আমি পুরো ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার কথাই বলছি। আমি এ লেখায় বইমেলা নিয়ে কথা তেমন একটা বলব না। আমি বরং আমাদের দেশে বই প্রকাশনার হালচাল নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই।

তার আগে আমরা জেনে নিই বিগত ২০১৮ বছরের গ্রন্থমেলা বিষয় মোক্ষম কয়েকটি তথ্য। গেল বছর বইমেলায় নতুন বই এসেছিল চার হাজারের মতো। মোট চারশ'র কাছাকাছি প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়েছিল। মোট বিক্রি হয়েছিল প্রায় ষাট কোটি টাকা।

এখন কথা হলো ষোল কোটি মানুষের দেশে বই বিক্রি হল ষাট কোটি টাকার। তার মানে মাথাপিছু চার টাকারও কম। এই হিসাব থেকেই প্রতীয়মান হবে সারা বছরে বিক্রির চিত্রও যে সুখকর নয়। এর পরের প্রশ্ন হলো বিক্রিবাট্টার অবস্থা যদি এই হয় তাহলে একজন প্রকাশক লেখককে টাকা দিবেন কিভাবে? সেই সঙ্গে ছাপার খরচ, কাগজের দাম, প্রচ্ছদ শিল্পীর পাওনা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ আসবে কোত্থেকে? তবে বাস্তবতা হল শুধু আমাদের দেশে বলে নয়- জগতের কোনও দেশেই বইমেলার উদ্দেশ্য বই বিক্রি না। লক্ষ্য হল পাঠক, লেখক, প্রকাশক, ছাত্র শিক্ষক, গবেষক, অনুবাদকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের এক মিলন উৎসব। উদ্দেশ্য প্রকাশনার উৎকর্ষতা বৃদ্ধি, বিকাশ ও প্রসার।

বেশ! এবার প্রথমেই আসি লেখকদের সম্মানী প্রসঙ্গে। যৎসামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া মোটাদাগে বলে দেয়া যায় বাংলাদেশের প্রকাশকরা সাধারণত লেখকদের সম্মানী দেন না, সম্মানী দেয়ার প্রয়োজনবোধ আর তাগিদ অনুভব করার জন্যে যে মানসিক অবকাঠামোর দরকার সেটাও তাদের নাই। এ নিয়ে ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটু আধটু উচ্চবাচ্য হয়।

একতরফা বলাও ঠিক হবে না, লেখকের বই বিক্রি না হলে প্রকাশক টাকা দেবেন কোত্থেকে? মোক্ষম প্রশ্ন। কিন্তু তাই বলে কি একজন প্রকাশকের ব্যবসার লালবাতি জ্বলেছে? প্রকাশকদের সকলে না হলেও অনেকের অবস্থা যথেষ্ট রমরমা, বাড়ি গাড়ি, কোটি টাকার জোরে উচ্চবিত্ত ক্লাবের সদস্য। এর বিপরীতে প্রকাশনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বাঁধাই, মুদ্রণ এবং লেখক সকলের ত্রাহি অবস্থা। এই বৈপরীত্যের রহস্য কী? এসব বিষয়ে আমাদের খোলামেলা বিতর্ক ও পর্যালোচনার সময় এসেছে।

অনেক অভিযোগ অনুযোগ চালু আছে। লেখক প্রকাশককে টাকা দিয়ে বই ছাপেন, তাতেও দোষের কিছু না। এরকম চর্চা সারা দুনিয়াতেই তবে এর একটা নিয়মনীতি, মানদণ্ড আর স্বচ্ছতা থাকা বাঞ্চনীয়। তারপর সহজ সরল ঝামেলামুক্ত চুক্তির কোন চর্চাই এখন পর্যন্ত গড়ে উঠলো না। আমাদের দেশে শিক্ষাসহ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক জাতীয় নীতি থাকলেও আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি নীতি এবং জাতীয় প্রকাশনা নীতি নাই। আমরা এখনও জামাত-বিএনপি প্রণীত দায়সারা গোছের কাগজে দলিল জাতীয় সংস্কৃতি নীতি ২০০৬ আঁকড়ে ধরে আছি। প্রকাশনাকে ঘিরে ছলচাতুরির অজ¯্র দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। একটা উদাহরণ, একটা বইয়ের প্রকৃত মূল্যের হেরফের দেখিয়ে নানা কর্তৃপক্ষের বই ক্রয়ের তালিকায় নয়ছয় হয় কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। সবকিছু স্বচ্ছতার সঙ্গে হওয়া প্রয়োজন। সরকারের বই ক্রয়ের নীতিতে এমন কিছু শর্ত থাকতে হবে যেখানে বলা থাকবে লেখকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের দেনা পাওনা পরিশোধের বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ থাকবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, হুমায়ূন আহমেদ তার নিজের প্রাপ্য নেবার আগে প্রকাশকদের অনেকটা বাধ্যই করতেন প্রচ্ছদশিল্পীর পাওনাটা পরিশোধ করতে। এক্ষেত্রে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। প্রত্যেকটি প্রকাশিত বইয়ের স্বচ্ছ ডিজিটাল তথ্য ভাণ্ডার সংরক্ষণের ব্যাপারটাও জরুরি। প্রতি মাসে না হলেও প্রতি তিন মাসে বা ছয় মাসে প্রকাশিত বইয়ের কাগজে ছাপানো এবং ডিজিটাল ক্যাটালগ করা যুক্তিসঙ্গত এবং সময়োপযোগী।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে নিই। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি ছিল প্রতি উপজেলায় একটি করে গ্রন্থাগার হবে যেখানে সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠানাদির জন্যে একটা মানসম্মত মঞ্চ ও মিলনায়তনও থাকবে। তাতে অনুমান করা যায় বই নিয়ে একটা আশাব্যঞ্জক কর্মযজ্ঞ শুরু হবে। সেই কর্মযজ্ঞে বই নিয়ে নানা কর্পোরেটগোষ্ঠীর ফন্দিফিকির আর প্রকাশকদের রাখঢাক লেনদেন ঠেকাতে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে প্রয়োজনে পুনর্গঠন করা যেতে পারে।

দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সরকারের ক্রয় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রকাশিত ক্যাটালগ থেকে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহে রাখতে পারেন। বই ক্রয়ের নামে প্রকাশক আর কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গড়ে ওঠা দুই নম্বরী প্রবণতা ঠেকাতে কাজে আসতে পারে।

বই ক্রয়ের ব্যাপারে নীতিমালা না থাকলে যা হবার তাই হচ্ছে। হাল আমলে সাবেক এক অর্থমন্ত্রী আর সাবেক এক সংস্কৃতিমন্ত্রীর কৃপায় ঢাকার এক প্রকাশক সরকারের কাছে কয়েক কোটি টাকার রবীন্দ্র রচনাবলী বিক্রয়ের একক অধিকার সংরক্ষণ করতে পেরেছিল। তাও আবার সরকারি সিদ্ধান্তে। এটাও কি সম্ভব? এটাকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব? অন্য প্রকাশকদের বঞ্চিত করে সরকারি সিদ্ধান্ত দেবার অধিকার মন্ত্রীদ্বয় কোথায় পেলেন?

তারপর নানা ব্যক্তি নিজস্ব অবস্থান ও পদ ব্যবহার করে কোনো কোনো প্রকাশককে অযাচিত সুযোগ দিয়ে থাকেন। যে কারণে প্রকাশকরা প্রকৃত লেখকদের নিগৃহীত করে পদধারীদের পিছে লেগে থেকে নিজেদের অবস্থান রমরমা করতে পারেন। আমি ঢালাও অভিযোগ দিচ্ছি না। এরকম দৃষ্টান্ত কম নয়।
কোনও কোনও লেখকের বইয়ের মেধাস্বত্ত্বের সময়সীমা পার হয়ে যাবার ফলে ধ্রুপদী লেখকদের রচনাবলী অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ সম্পাদনা না করে প্রকাশ করছে। অনেকক্ষেত্রে ভুলভাবে এবং দুর্বলভাবে অনেক বইয়ের বা লেখার সংক্ষিপ্তসার ছাপাচ্ছে। দুই একটা উদাহরণও দেয়া যায়। ঢাকার এক প্রকাশক ঈশপের গল্প ছেপেছেন- অনেকটা ভুলভাবে, যথার্থহীন, অযোগ্যতা আর অবহেলার চূড়ান্ত ছাপ রেখে।

আরেকটা দৃষ্টান্ত দিতে চাই হুমায়ুন আজাদের 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না' বইটিকে বিশ্বসাহিত্যের একটা সেরা বই বলা যায়। সে বইটি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে যে মনোযোগ দরদ আর সম্মান দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছিল তার ঠিক বিপরীতভাবে প্রকাশ করেছে বইটির বর্তমান এক প্রকাশক।

আজকে প্রকাশকরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। অদূর ভবিষ্যতে পার পাবেন সে নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। সমূহ ঝামেলায় প্রকাশকরাই পড়বেন। তাই সকলের স্বার্থেই জাতীয় স্থিতিশীল মানবিক কল্যাণমূলক উন্নয়নের জন্যে মেধাশোষণের এই প্রবণতা বন্ধ হতেই হবে। তবে উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই, খোদ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে। নতুন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এম খালিদের অভিষেকে একটা আশাবাদ রাখতে চাই। তিনি জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতির আদলে একটা জাতীয় সংস্কৃতিনীতি আর জাতীয় প্রকাশনা নীতি প্রদানে উদ্যোগী হবেন।

প্রকাশকদেরও কিছু বক্তব্য রয়েছে। রয়েছে তাদের দাবি ও দফা। সেসবও মনোযোগের অধিকার রাখে। মোদ্দাকথা সকল পক্ষের কথা শুনা ও বলার খোলামেলা একটা বিতর্ক হতে পারে। এ বিষয়ে গণমাধ্যম যেমন এগিয়ে আসতে পারে, তেমনি ভূমিকা রাখতে পারে নবগঠিত জাতীয় সংসদও। তবে বড় ভূমিকাটি নিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয স্থায়ী কমিটিকে।

ইদানিং আমাদের দেশের প্রকাশকরা বিদেশের বইমেলায় অংশ নিচ্ছে। উৎসাহব্যাঞ্জক উদ্যোগ। তবে আমাদের দেশের প্রকাশকদের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হলে যে কাঠামোগত প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও অগ্রগতি দরকার তা কোনও প্রকাশকের আছে কিনা আমার জানা নাই। তার বড় কারণ হলো আমাদের দেশের প্রকাশকদের সম্পাদক নিয়োগ দেবার মতো সামর্থ্য ও আগ্রহ কোনটাই নাই।

হাল আমলে কোনও কোনও কর্পোরেট গণমাধ্যম নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা খুলে বসেছে। তাদের কারও কারও মাঝে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও সম্পাদকীয় রীতি উন্নয়নের আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তবে তাদের নিজস্ব গণমাধ্যমকে নিজ নিজ ব্যবসার জন্যে যখন জনসংযোগ কর্মকর্তার মতো ব্যবহার করে, তা বড়ই দৃষ্টিকটূ। প্রকাশনার সামগ্রিক উৎকর্ষতা ও রুচিশীল বিকাশের জন্যে এ প্রবণতাও ঠেকাতে হবে।

সব অভিযোগ ও সঙ্কট উতরে আমাদের প্রকাশনা জাতীয় উন্নয়নের সমান্তরালে অগ্রসর হবে এবং লেখাপলেখি ও প্রকাশনা জগতে বই বাঁধাইয়ের কর্মীটি থেকে শুরু করে লেখক, অক্ষর বিন্যাসের কর্মীটি এবং প্রচ্ছদ শিল্পীদের কেউ ভাতে মারা যাবে না, একই সঙ্গে প্রকাশকের ব্যবসাও মাঠে মারা পড়বে না, এমন আশাবাদ রেখে লেখাটি শেষ করছি।