আত্মহত্যা ও আমাদের তরুণীরা

বিনয় দত্ত
Published : 10 Jan 2019, 12:33 PM
Updated : 10 Jan 2019, 12:33 PM

১.

'…কাঠগোলাপের সাদার মায়া মিশিয়ে দিয়ে ভাবি
আবছা নীল তোমার লাগে ভালো
তোমার জন্য নীলচে তারার একটু খানি আলো…'

গীতিকার সাহানা বাজপেয়ীর অসাধারণ লেখনীতে অর্ণব এই গানটা সুর করেছিল এবং গেয়েছিল। যখন এই গানটি প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল তখন এই গানটি আমি বন্ধুমহলে এতো বার বার গেয়েছিলাম যে, বন্ধুরা ভাবতো এইটা বুঝি আমার গান। আমি প্রতিবারই বলতাম এইটা অর্ণবের গান, আমার নয়। তখনো পর্যন্ত অর্ণব জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেননি।
কাঠগোলাপ ফুল মাথায় গুঁজে দেয়া হাস্যোজ্জ্বল এক কিশোরীর ছবি এবং তার গল্প এখন বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্ববাসী জানে। এই কাঠগোলাপের ছবি মাথায় গোঁজা দেখে আমার বার বার ওই গানের লাইনটি মনে পড়ছে। মনের অবচেতন ভাবনা কিশোরীকে দেখে এই গানটি উসকে দেয়। কষ্টে আমি মুষড়ে পড়ছি।

যে কিশোরীর ছবি সবাই দেখেছে সে এখন আর আমাদের মাঝে নেই। সে অনেক দূরে। এতো দূরে যে, তাকে আর কাছে টানার কোনো শক্তিই আমার বা আমাদের নেই। কিশোরীর নাম অরিত্রী অধিকারী। সে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। এখন সে বদনামের ভাগীদার হয়ে কোনো এক অজানা শহরে বসবাস করছে।

এই দেশে একটি মোবাইল চুরির জন্য আমরা জনসন্মুখে একটি বাচ্চাকে পিটিয়ে মেরেছিলাম। গণপরিবহনে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় আমরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাসের চাকায় পিষে মেরেছিলাম। রাতের আঁধারে আমরা এক সংগ্রামী তরুণীকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিলাম। কতটা অসহনশীল আমরা! কতটা নিষ্ঠুর আমাদের হৃদয়!

প্রতিবার আমরা এই ধরনের জঘন্য কাজগুলো করার পর ক্ষমা প্রার্থনা করি। বার বার এই ক্ষমা দেখে আমার প্রশ্ন জাগে। এই ক্ষমা কে করবে? মৃত ব্যক্তির বাবা-মা? নাকি তার আত্মীয়স্বজন? ক্ষমা করলেই কি আমরা তাকে ফেরত পাবো?

ক্ষমা চাওয়ার ধরনটা এমন যে, একটি ছোট্ট ভুল হয়ে গিয়েছে সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি। বিষয়টি কিন্তু আদৌ তা নয়, একটি জীবন, জলজ্যান্ত একটি মানুষের জীবন চলে যাওয়ার পর আমরা সেই ক্ষমাপ্রার্থী ব্যক্তিকে ক্ষমা করে কী করবো?

২.
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যারা প্রতিনিয়ত কথা বলেন বা যারা প্রতিনিয়ত লেখালেখি করেন তারা জানেন এই শিক্ষাব্যবস্থা কতটা মাজুল, কতটা ঠুনকোভাবে তা চলছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে পারিনি, এই শিক্ষাব্যবস্থায় সবাইকে 'গোল্ডেন এ প্লাস' পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেয়, এই শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা প্রতিবার মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর ব্যর্থ বা অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য করি, এই শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা মাধ্যমিক থেকেই সরকারি চাকরির পিছনে ছুটে বেড়ানোর জন্য লেলিয়ে দেয় আমাদের সন্তানদের।

যে শিক্ষাব্যবস্থা একটি শিশুকে সু-সন্তান তৈরি করতে সহায়তা করে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তারের মতো শিক্ষকের পদচারণায় ভরপুর। এই শিক্ষকরাই অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারীকে তার সামনে অপমান করেছেন। অভিভাবকের অপমান সইতে না পেরে হাস্যোজ্জ্বল সেই কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ তারা এই জঘন্য কাজটি করেছেন। আরো সহজভাবে বলতে গেলে, তারা অরিত্রীকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন।
আমার কথা হলো, এই শিক্ষক কি একদিনেই এই ধরনের উদ্ধত আচরণ করা শুরু করেছেন? নিশ্চয় উনি বা উনারা সকালের সূর্য দেখে এইধরনের কঠোর আচরণ করা শুরু করেননি। দীর্ঘদিনের চলমান কর্মকাণ্ডের ফল হলো আজকের এই আত্মহত্যা। আর যেহেতু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষক কমিটি আগে তাদের শনাক্ত করেনি তাই এই আত্মহত্যা ঘটেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার 'মেন্টাল হেলথ অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৩-২০'–এ কিশোর কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিতে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আজন্মগত মানসিক রোগের শুরু হয় ১৪ বছর বয়স থেকে।

এই বয়সে কিশোর-কিশোরীরা অনেক বেশি মাত্রায় নাজুক অবস্থায় থাকে। অভিভাবকদের সময় স্বল্পতার কারণে তারা এই সময়টাতে নিজেদের মতো করে একটা কল্পনার পৃথিবী গড়ে নেয়। যেই পৃথিবীতে তাদের ভালোলাগা, মন্দলাগাকে তারা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়। এই সময়টাই কোনো কারণে কষ্ট পেলে তারা এমন কিছু করে বসে যাতে আর কোনো সম্ভাবনার পথ খোলা থাকে না।

যেকোনো সন্তানের জন্য তার অভিভাবক অনেক পূজনীয়। সেই অভিভাবক যখন সন্তানের কারণে অপমানিত হন তখন সেই সন্তান তা সহ্য করতে পারে না। যেমনটি পারেনি অরিত্রী অধিকারী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশে এক গবেষণা পরিচালনা করে। আত্মহত্যার কারণসমূহ তারা বের করে। তাদের গবেষণার তথ্যানুসারে, পারিবারিক সমস্যা (৪১.২%) পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া (১১.৮%), বৈবাহিক সমস্যা (১১.৮%), ভালোবাসায় কষ্ট পাওয়া (১১.৮%), বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণ ও যৌন সম্পর্ক (১১.৮%), স্বামীর নির্যাতন (৫.৯%) এবং অর্থকষ্ট (৫.৯%) থেকে রেহাই পেতে মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রতি বছর 'গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং (জিইএম) প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বিষয়ে সম্প্রতি ইউনেস্কো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন বলছে, প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ৫০ শতাংশ। নেপাল, মিয়ানমার, মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুরে এ হার ৯০ শতাংশের বেশি। এছাড়া শ্রীলংকায় প্রাথমিক শিক্ষায় পাঠদানরত শিক্ষকদের ৮৫ শতাংশ, ভারতের ৭০ শতাংশ ও পাকিস্তানের ৮২ শতাংশেরই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ রয়েছে। এর বাইরে ভুটান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, জর্ডান ও থাইল্যান্ডে প্রাথমিক শিক্ষকদের শতভাগই প্রশিক্ষিত। যেখানে আমাদের অবস্থান খুবই শোচনীয়।

এই তথ্য পাওয়ার পর আমাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না, যে শিক্ষকদের উপর আমরা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিচ্ছি তাদের অবস্থান কোথায়? আর মানসিকভাবে শিক্ষার্থীদের মনোবল জোগানোর ক্ষেত্রে এই গ্রাফে আরো পিছিয়ে আছি আমরা।

৩.
ছোট হোক বা বড় হোক যে কোনও কারণে আমরা মানুষকে ছোট করে দেখি। এইটা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি বলা যায়। এই প্রবৃত্তি থেকে আমাদের বের হতে অনেক সময় লাগবে। যদি আমরা অরিত্রী অধিকারীকে তার দোষের জন্য বুঝিয়ে বলতাম তবে আজকে এই পরিণতি দেখতে হোত না।

শুধু ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ নয়, দেশের বেশিরভাগ স্কুল-কলেজে একই চিত্র হয়তো চলছে। যখন কেউ কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তখন আমরা সেই স্কুল বা কলেজের সকল দোষত্রুটি জেনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এইভাবে আসলে কখনো শিক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে না। শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগীতার ঘোড়া বানিয়ে আমরা যতই ছুটতে বলি না কেন তাতে আর যাই হোক মননশীল জাতি গড়ে উঠবে না। হয়তো সাময়িক ফলাফলের গ্রাফ ভালো পাওয়া যাবে।

সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন তাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গঠনমূলক কোনও পরিকল্পনা দাঁড় করান। যাতে শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতার ঘোড়া হয়ে নয়, সৃজনশীল-মননশীল হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। যাতে করে আর কোনও অরিত্রী অধিকারীকে আমাদের হারাতে না হয়।

যে সন্তান হারিয়েছে সে জানে সন্তান হারানোর কষ্টটা কতটা ভয়ানক, কতটা করুণ। সন্তান হারানোর পর গণমাধ্যমের সামনে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলে সেই সন্তান আর ফিরে আসে না। আমার বিশ্বাস, শিক্ষা নিয়ে আমরা এমন কোনো পরিকল্পনা করবো যাতে করে শিক্ষার্থীর প্রাণ যাওয়ার পর আর কাউকে ক্ষমা চাইতে না হয়, যাতে আর কোনো কাঠগোলাপ ফুল মাথায় গুঁজে দেয়া হাস্যোজ্জ্বল কিশোরীকে আমাদের বিদায় জানাতে না হয়। আমি সেই দিনের অপেক্ষায়।