হেলমেট, ফেইসবুক, ব্যক্তি

পলাশ দত্ত
Published : 10 Jan 2019, 12:02 PM
Updated : 10 Jan 2019, 12:02 PM

তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক লোক খারাপ। তিনি অযথা শো অফ করেন। যেমন? তিনি পাবলিককে দেখানোর জন্য মোটরবাইকে করে অফিসে চলে যান। সেই বাইকে চড়ার ছবি আবার ফেইসবুকেও প্রকাশ করেন! শুধু তাই নয়, পলক মন্ত্রী হয়েও আইন ভাঙেন! শো অফ করতে গিয়ে যখন বাইকে চড়েন, তখন মাথায় হেলমেট পড়েন না! এরকম খারাপ মানুষকে, তাও আবার মন্ত্রী, এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া যায়? যায় না। তাই বাংলার ফেইসবুকাররা তাকে তুলোধুনা করেন।

কারা? ফেইসবুকাররা। যারা রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে ভঙ্গি করে ছবি তুলে ফেইসবুকে দেন। যারা ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা দিতে দিতে সেই ছবি ফেইসবুকে দেন। যারা যেকোনও বিষয়ে নিজের বিশেষজ্ঞ মতামত ফেইসবুকে প্রকাশ করেন। যারা যেকোনো অপরাধে ফেইসবুকে প্রতিবাদ জানান, তবে রাস্তায় নামেন না। এরকম তালিকা করতে থাকলে সেটা দীর্ঘ হতেই থাকবে।

২.

এই যে যেকোনও মুহূর্তের ছবি বা স্ট্যাটাস ফেইসবুকে দেয়া। কেন দেন তারা? কেন দেই আমরা? শো অফ করার জন্যই কি? ফেইসবুকে মানুষ তার ব্যক্তিজীবন মুহুর্মুহু প্রকাশ করে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দুনিয়া জুড়ে খোঁজা হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরেই।

ফেইসবুক ব্যক্তিকে সমষ্টির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। এই জুড়ে দেয়ার ভেতর দিয়ে সমাজে পারস্পরিক যোগাযোগের ধারণাটিকেই বদলে দিয়েছে। যোগাযোগের এই সহজলভ্যতার ভাল দিক যেমন আছে খারাপও আছে তেমন। একইসঙ্গে মানুষের রিকগনিশন পাওয়ার যে চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা তার প্রকাশকে দিয়েছে উসকে। কবিতা/গল্প হোক না হোক, লিখে ফেইসবুকে ছেড়ে দিচ্ছে ব্যক্তি। সমাজ/রাজনীতি বুঝুক না বুঝুক নিজের মত ঝেড়ে দিচ্ছে, আত্মবিশ্বাসের সাথে।

এই যে ফেইসবুকের আমি। যখনই কিছু প্রকাশ করতে যাই আমার মাথায় থাকে যে এটা ফ্রেন্ডলিস্টের মানুষেরা দেখবে। এই লিস্টে বন্ধু থেকে শুরু করে অপরিচিত- সবাই আছে। ফেইসবুক সমষ্টির কাছে আমার কথা খুব সহজে পৌঁছে দিচ্ছে। সেই সুযোগ নিয়ে, সেই প্রযুক্তির ফাঁদে মনে-বদলে-যাওয়া আমি নিজের সবকিছুই ফ্রেন্ডদের সাথে শেয়ার করতে চাই, অর্থাৎ সমষ্টিকে জানাতে চাই আমার অস্তিত্ব।

আমাকে দেখাতে চাই। তাই স্ট্যাটাস দেই। তাই ছবি দেই। তাই ভিডিও দেই। আমার কোন গান শুনতে ভাল লাগে। আমার কোন চলচ্চিত্র দেখতে ভাল লাগে। আমার কোন খাবার খেতে ভাল লাগে। আমার মা-বাবা-ভাই-বোন-সন্তান-আত্মীয়-পরিচিত কে কেমন আছে। সমস্ত কিছু আমি শেয়ার করি ফেইসবুকে। কেন? ফ্রেন্ডরা জানবে। কতজন ফ্রেন্ড? সচরাচর হাজার হাজার, নিদেন পক্ষে শতশত।

এই আমির বাইরে রাজনীতিকরা ফেইসবুক ব্যবহার করেন তার কর্মকাণ্ড প্রচারের মাধ্যম হিসেবে। অবশ্য এ কাজে পশ্চিমা বিশ্বে টুইটারের ব্যবহার বেশি। বাংলাদেশেও গত ৪/৫ বছরে ফেইসবুকের রাজনৈতিক ব্যবহার গতি পেয়েছে। মন্ত্রী পলকও তার কর্মকাণ্ড প্রচারে ফেইসবুক ব্যবহার করেন।

৩.

পলক কেন মোটরবাইকে চড়লেন। কেন হেলমেট ছাড়াই চড়লেন। এসবের ব্যাখ্যা তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দিয়েছিলেন: "তাড়াহুড়ো করে যাওয়ার জন্য আমি যে বাইকের সাহায্য নিয়েছি, তার কাছে কোনো বাড়তি হেলমেট ছিল না। আর ওটা রাইড শেয়ারিংয়ের বাইকও ছিল না, ব্যক্তিগত বাইক ছিল।"

ওই বাইক যে রাইড শেয়ারিঙের নয় তা ছবি দেখেই যে কেউ বুঝতে পারার কথা। কারণ ঢাকায় যাত্রীর জন্য অতিরিক্ত হেলমেট নেই এমন রাইড শেয়ারিং বাইক এখন পাওয়া যায় না। এটা রাস্তায় চলাচলকারী সবাই জানে। তবু ফেইসবুকাররা একহাত নিয়েছে, নেবে। এটাই ইন্টারনেটের/ফেইসবুকের গণ-ক্ষমতায়ন: আমার ওয়ালে বা তোমার পাবলিক পোস্টে আমার মন যা চায় তাই আমি বলতে পারি!

কিন্তু পলক বাইকে চড়েছিলেন কেন? কারণ গাড়িতে জ্যামে বসে দেরিতে অফিসে যেতে চাননি তিনি। তাই রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে, পথচলতি এক মোটরবাইকের সাহায্য নেন তিনি। এবং ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছে যান।

পলক কি প্রতিদিন বা প্রায়ই এমন হেলমেট ছাড়া বাইকে চড়েন? সেটা আমরা জানি না। তবে একইদিন অফিস থেকে ফেরার পথে তিনি হেলমেট পরিহিত একটা ছবিও দেন ফেইসবুকে, জানা যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবর থেকেই। তাহলে তার হেলমেটবিহীন অফিসযাত্রা ছিল ব্যতিক্রম। প্রতিমন্ত্রীর এই অফিসযাত্রাকে এখনই স্টান্টবাজি বলে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে? নাকি আরো কিছু মাস অপেক্ষা করে দেখাই শ্রেয়? সময়ই তা বলে দেবে।

হেলমেটবিহীন দিনটিতে পলকের অবশ্য আরো অন্তত একটি বিকল্প ছিল। তিনি যথারীতি গাড়িতে জ্যামে বসে থাকতে পারতেন। দেরিতে অফিসে পৌঁছাতেন। ১২টার সভা ১২:৩০ কি ১টায় শুরু হতো। সভার ছবি তুলে ফেইসবুকে দিতে পারতেন। বলতে পারতেন, জ্যামের কারণে নতুন বছরের প্রথম কর্মদিবসে অফিসে আসতে দেরি হলো।

সেই ছবিতেও হয়ত পলককে এক হাত নিতেন ফেইসবুকাররা। কারণ এখন ইন্টারনেটের গণ-ক্ষমতায়নের যুগ। ফেইসবুকের কল্যাণে ব্যক্তির ভ্রান্তিভরা আত্মবিশ্বাসের যুগ।

৪.

এই লেখা শেষ হওয়ার পর এক খবরে জানা গেল হেলমেট ঘটনায় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে ভুল স্বীকার করেছেন প্রতিমন্ত্রী পলক। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেরই এক খবরে জানা গেল তার ভুল স্বীকারের তথ্য।

বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একথা জানান কাদের। তিনি বলেন, "আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম অ্যাজ জেনারেল সেক্রেটারি অফ পার্টি। হি এক্সপ্রেসড হিজ রিগ্রেট ফর ইট এবং সে বলেছে যে 'ইটস এ মিসটেইক, আমি আর রিপিট করব না'।"

নিজের ভুল বুঝতে পারার জন্য প্রতিমন্ত্রী পলক সাধুবাদ পেতে পারেন। তবে এ কারণে ফেইসবুকের 'মব জাস্টিস' যৌক্তিক হয়ে যায় না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সমাজে দীর্ঘ সময় ধরে চলা অভ্যাস হঠাৎ একদিনে দূর হয়ে যায় না। এ কারণে হেলমেট ছাড়া অন্যের বাইকে উঠে পড়েন একজন প্রতিমন্ত্রী।

আর, পলকের কাছ থেকে না হয় ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে ভুল স্বীকার পাওয়া গেল। কিন্তু ফেইসবুকীয় ভ্রান্তিভরা আত্মবিশ্বাসের যে ধারা ক্রমশ শক্ত হচ্ছে সমাজে তার পরিণতি কী? ভার্চ্যুয়াল আর রিয়ালের সীমা ভেঙে ফেইসবুক/ইন্টারনেট যে জীবন ব্যবস্থা তৈরি করছে সেখানে ব্যক্তির শেষ পরণতি কী? এখনো এর কোনো জবাব নেই।