কাউন্সিলিং সেবা হতে পারে সমাজ বদলের উপায়

ফারহানা মান্নানফারহানা মান্নান
Published : 26 June 2012, 03:49 PM
Updated : 26 June 2012, 03:49 PM

পরিবারের গন্ডি থেকে বেরিয়ে পনেরো কি ষোলো বছর বয়সের একটি ছেলের সমাজে টিকে থাকার নিজস্ব চেষ্টা দিনশেষে তাকে দাঁড় করায় একজন নিষ্ফলা মাঠের কৃষক হিসেবে। ব্যর্থতার গ্লানি, লক্ষ্যহীন জীবন তার প্রেষণার অভাববোধ- এই সবকিছুর ফলাফল হল ছেলেটির আত্মহনন।

সালটা ২০১০। এক পুত্র ও কন্যা নিয়ে মা-বাবার সুখের সংসার। দ্বিতীয় একজন নারীর উপস্থিতি সব সুখের বাঁধন আলগা করে দেয়। পারিবারিক অশান্তির স্পষ্ট ছাপ পড়ে যায় বাচ্চা দুটোর মধ্যে। স্কুলে ওদের নিম্নমানের ফলাফল, দুর্বল ক্লাসরুম পারফরমেন্স, আর শ্রেণীতে নিশ্চুপ আচরণ – শিক্ষকদের টনক নড়াতে পারে না। ওরা চিহ্নিত হয় দুর্বল শিক্ষার্থী হিসেবে। কী কারণ তা জানার প্রয়োজন বোধ করেন না আশেপাশের কেউই। ফলাফল শেষ পর্যন্ত মা-বাচ্চাসহ তিনজনের আত্মহনন।

সমাজের অন্যতম রক্ষাকর্তা পুলিশবাহিনী সমাজে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনছেন সমাজের অন্যতম উপাদান মানুষকে শায়েস্তা করে। সমাজের রক্ষাকর্তা পুলিশবাহিনীর বিরূপ ছবি আমরা দেখতে পাই খবরের কাগজের পাতায় পাতায়।

উপরের আলোচনায় তিনটি ঘটনা তিনটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঘটলেও একটা সাধারণ যোগসূত্র এদের ভেতর খুঁজে পাওয়া যায়। আর তা হলো ব্যর্থতা আর আক্রোশের পরিণতি। ঘটনা তিনটির ফলাফল নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় নামিয়ে নিয়ে আসা যেত। আত্মহনন নয়, অন্ততপক্ষে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকার চিন্তা জিইয়ে রাখা যেত। যদি এ পরিণতিকে রুখতে "কাউন্সেলিং" নামের একটা বিশেষ হাতিয়ার ব্যবহার করা হত। শিল্পায়ন, নগরায়ন ও বিশ্বায়নের ফলে দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি করছে। সামাজিক পরিবর্তন এত দ্রুত হচ্ছে যার ফলে মানুষ উদ্ভুত সমস্যার সঙ্গে উপযোজনে ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা যখন বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হই, তখন আমরা আশেপাশের বিভিন্ন ব্যক্তি, যেমন, পিতা-মাতা, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব, ডাক্তার, সেবিকা, সামাজিক কর্মী, ব্যক্তিগত সচিব, আইনজীবী ও অন্যান্য ব্যক্তিদের থেকে কাছ পরামর্শ বা উপদেশ নেই। কেউ কেউ উপদেশ দেন, কেউ কেউ দেন তথ্য, কেউ কেউ আবার ব্যক্তিকে তার পরিবেশকে উপলব্ধিতে সাহায্য করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আর অধিকাংশই তা নন। যদিও তাদের সবার উদ্দেশ্যই হলো মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা, তবুও তাদের এই কার্যক্রমকে মনোবিজ্ঞানে কাউন্সেলিং বলে না।

মনোবিজ্ঞানী H B Pepinsky and and P. Pepinsky (1954) -এর মতে, "কাউন্সেলিং হলো এমন এক রকমের মিথস্ক্রিয়া যেখানে (১) দুই জনের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় যাদের একজন কাউন্সেলর ও অন্যজন ক্লায়েন্ট, (২) এটিকে পেশাগতভাবে দেখা ও (৩) ক্লায়েন্টের আচরণ পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। কাউন্সেলিং-এর প্রধান লক্ষ্য হলো ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল ও আত্মনিয়ন্ত্রিত হতে সাহায্য করা এবং বিভিন্ন চাহিদার সঙ্গে যথোপযুক্ত উপযোজন করে উন্নততর ও কার্যকর জীবনযাপন করতে সাহায্য করা। কাউন্সেলিং এমন একটি প্রক্রিয়া যা ক্লায়েন্টের বিভিন্ন বিষয়, যেমন : চাহিদা, প্রেষণা, আবেগ, প্রত্যক্ষণ, আত্মোপলব্ধি ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে সাহায্য করে। কাউন্সেলিং আচরণে পরিবর্তন আনে, আত্মরক্ষার দক্ষতা বৃদ্ধি করে, ব্যক্তিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করে এবং সম্পর্ক উন্নয়ন ও ক্লায়েন্টের ক্ষমতা উন্নয়নে সহায়তা করে। এখন প্রশ্ন হলো কাউন্সেলিং-এর এই সুবিধা শিক্ষা ক্ষেত্রে কী করে প্রয়োগ করা সম্ভব? শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর আচরণীয় সমস্যা চিহ্নিত করে তা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি শিখন-বান্ধব পরিবেশ গঠনে কাউন্সেলিং কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে? গত ৩০ বছর ধরে পশ্চিমা বিশ্বে স্কুল-কাউন্সেলিং একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষামূলক এবং ব্যক্তিগত বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্কুল-কাউন্সেলিং সেবা শিক্ষার্থীদের বিকাশমূলক ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। শিক্ষার্থীদের অতীত অভিজ্ঞতা এবং তাদের সমস্যার ভিন্নতা ও এর ধরন নিয়ে আলোচনা করে স্কুল-কাউন্সিলিং। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে স্কুল-কাউন্সেলিং সেবা তেমনভাবে বিকশিত হয়নি। তবে সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, যেমন : নির্যাতন, মাদকগ্রহণ, আত্মহত্যা, বিদ্যালয়ের নিয়মশৃঙ্খলা পালনে অবাধ্যতা, প্রত্যাশিত ফলাফলে অক্ষমতা ও মানসিক চাপ মোকাবিলা করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অনেক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে কোনও কোনও বিদ্যালয় এই সেবা প্রদানের জন্য বিদ্যালয়ে পেশাগত কাউন্সেলর নিয়োগ দিয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে শিক্ষার্থীদের বয়সের সীমা, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবেশ ও পারিবারিক অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। বিদ্যালয়ে সামগ্রিক কাউন্সেলিং কাজ পরিকল্পনার জন্য একজন বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়োগ করা উচিত। আমাদের মতো গরীব দেশে এ রকম ব্যবস্থা গ্রহণ অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব। ফলে কোনও একজন শিক্ষককে এর জন্য নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এই শিক্ষক বিভিন্ন ধরনের বক্তৃতা বা কার্যক্রমের ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষামূলক বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে পারেন। বিভিন্ন বৃত্তিমূলক বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ, বিভিন্ন পেশাজীবীকে আমন্ত্রণ জানানো বা বিশেষ বিশেষ সহপাঠক্রমিক কাজে অংশগ্রহণ করিয়ে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করতে পারেন। এ জন্য শিক্ষককে ব্যক্তিগত পর্যায়ে উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। সে জন্য তাদের অভিভাবকদের সাক্ষাৎকার নেওয়া, বিদ্যালয়ে ভিজ্যুয়েলিটি ও রেকর্ড কার্ডের ব্যবস্থা করা, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে নিয়মিত মিটিং-এর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি উদ্যোগ নিতে পারেন তিনি। যদি কোনও শিক্ষার্থীর সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তবে উক্ত শিক্ষার্থীকে বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো যেতে পারে। এছাড়াও play therapy, bioliotherepy, peer counselling program, communication, curriculum, assessment, career, counselling community contact ইত্যাদি সেবা, academic administrative test বিভিন্ন মাদকবিরোধী কর্মসূচি AIDS, Hiv সহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যত। যথোপযুক্ত শিক্ষা এবং পরিবেশ একজন শিক্ষার্থীকে সমাজে বসবাসের উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে প্রয়োজনীয় এবং সমাজ-অনুমোদিত আচরণ রপ্ত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। আত্ম-উন্নয়ন ঘটানোর মাধ্যমে নিজেকে সমাজের উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা- এই লক্ষমাত্রা নিয়েই তো প্রতিনিয়ত আমরা একটি নির্ধারিত গন্তব্যপথে অগ্রসর হই। এই যাত্রা সুখকর হয় ব্যক্তির আচরণীয় সমস্যা দ্রবীকরণের মাধ্যমে। শিশুকাল থেকেই শিশুর আচরণীয় সমস্যা অনুধাবন করে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হলে প্রত্যেকটি শিশুই সুনাগরিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। যদি তা না হয় তবে শিশু, বয়স্ক, বৃদ্ধ যাই বলি না কেন পরিণতি শেষ পর্যন্ত উপরে বর্ণিত তিনটি ঘটনার মতোই হবে। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে- এবার শিক্ষকদের পেটালো পুলিশ, ছুঁড়ল গরম পানি, প্রকাশ্যে তরুণীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা পুলিশের, হাজতখানায় আসামিকে পিটিয়ে আহত করল পুলিশ।

পুলিশ ছাড়াও সমাজে বসবাসকারী অন্যান্য মানুষের মাঝেও আমরা আচরণীয় সমস্যা দেখতে পাই। এর ভেতর আছেন শিক্ষক, অভিভাবক, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ইত্যাদি গোত্রের মানুষ। শিশুকাল থেকে যথাযথ নির্দেশনা ও উপদেশ প্রদান না করার কারণে অনেক সফল ও দায়িত্ববান মানুষদেরও আমরা আচরণীয় সমস্যায় ভুগতে দেখি। বিশাল অঙ্কের জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া এ দেশটির সকল মানুষের আচরণ এক নিমিষে বদলে ফেলা সম্ভব নয়। তবে এও সত্য কাউন্সেলিং একটি চলমান প্রক্রিয়া হওয়াই উচিত। তা না হলে সমাজের রক্ষাকর্তা পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মীদের এমন পদস্খলন ঘটতেই পারে। ঘটতে পারে অভাবিত আরও বহু হত্যা, খুন, জখমের মতো নির্মম ঘটনা। তাই একটি বিশুদ্ধ সামাজিক পরিবেশ গঠনে কাউন্সেলিং অপরিহার্য।

সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবেও প্রয়োগ করা যেতে পারে কাউন্সেলিং সেবা। ১লা জুন জানতে পারলাম, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ তাদের ফোর্সের জন্য কাউন্সেলিং শুরু করেছে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের পদক্ষেপ আমাদের আচরণ সংশোধনের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

ফারহানা মান্নান: লেখক এবং শিক্ষক।