সঞ্চয় বাড়ানো ও উচ্চ শিক্ষার মান

স্বদেশ রায়
Published : 9 Jan 2019, 12:57 PM
Updated : 9 Jan 2019, 12:57 PM

নির্বাচনের আগেই সামনে এসেছিল, আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় এলে তাদেরকে এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে ও উচ্চ শিক্ষার মানের দিকে নজর দিতে হবে। মন্ত্রী পরিষদ গঠন করার সময় শেখ হাসিনাও যে বিষয়টি মাথায় রেখেছেন তার প্রমাণ তিনি দুজন অভিজ্ঞ ও সফল মন্ত্রীকে অর্থ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন।

অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল গত পাঁচ বছর পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে সফল। শেখ হাসিনার উচ্চাকাঙ্খার অর্থনীতিকে তিনি সঠিকভাবে পাঁচ বছরে পরিকল্পনায় এনেছেন। তাই স্বাভাবিকই তার কাজের শুরুতে আশা করা যায়, শেখ হাসিনার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় অর্থনীতির বিকাশ তার হাত দিয়ে ভালোভাবেই ঘটবে। অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকাকালীন তার মন্ত্রণালয় একটি গতিশীল মন্ত্রণালয় ছিল, তিনি সমুদ্র বিজয়ের মতো বড় বিজয়েরও একজন নায়ক। তিনি শিক্ষামন্ত্রণালয়ে সফল হবেন এই আশাই এখন দেশের নানান মহল থেকে শোনা যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও আশাবাদী পোস্ট আসছে। যেমন আসছে অর্থমন্ত্রীর ক্ষেত্রে।

দুজনই অভিজ্ঞমন্ত্রী। তারা নিশ্চয়ই তাদের কাজের তালিকায় কোনটি বেশি প্রাধান্য পাবে সেটা ঠিক করেই নিয়েই কাজ করবেন। তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, গত দশ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক উন্নতি করলেও সব ক্ষেত্রে কিন্তু তাদের শতভাগ সফলতা নেই। গত দশ বছরে তেমনি সব মন্ত্রণালয়ে অসফলতার অনেকগুলো স্থান আছে। আশা করা যায়, প্রত্যেক মন্ত্রী তার নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কাজের ক্ষেত্রে ওই মন্ত্রণালয়ে অসফলতার স্থান কোনগুলো সেগুলো চিহ্নিত করে, সেই কাজগুলো আগে করবেন।

যেমন- আমাদের অর্থনীতির আকার বেড়েছে ঠিকই তার সঙ্গে অন্য অনেক কিছুর মিল থাকলেও সঞ্চয়ের মিল নেই। বিশেষ করে দেশের মানুষের অর্থ সঞ্চয়ে আসেনি ওইভাবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন মানুষের হাতে অর্থ আসছে। মানুষ নানানভাবে অর্থ উপার্জন করছে। তবে সবাই সঞ্চয়ের ভেতর আসছে না। দেশের অর্থ উপার্জনকারী সব মানুষ সঞ্চয়ে এলে ওই দেশের অর্থনীতি প্রকৃত অর্থে আলাদা ধরনের শক্তিশালী হয়। দেশে সঞ্চয়ের পরিমান বেশি থাকলে দেশ যেমন টেকসই অর্থনীতিতে শক্তিশালী হয় তেমনি সরকারও নিজ উদ্যোগে নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে হাত দিতে সাহসী হয়। তাই এ মুহূর্তে অন্য দশটি কাজের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষকে অধিক সঞ্চয়ের পথে আনা প্রয়োজন।

সঞ্চয়ের পথে আনতে হলে কী কী করতে হবে সেটা অর্থমন্ত্রণালয় ও অর্থমন্ত্রী সব থেকে ভালো বুঝবেন। তবে বাংলাদেশের উপার্জনকারী সব মানুষকে সঞ্চয়ের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে, দেশে কৃষিব্যাংকসহ মোট পাঁচটি বড় সরকারী ব্যাংক আছে। সরকারী ব্যাংক প্রাথমিকভাবে লাভের কথা চিন্তা না করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরো বেশি শাখা খুলতে পারে। অর্থাৎ ব্যাকিং ব্যবস্থাকে মানুষের দোরগোঁড়ায় নিয়ে যেতে পারে। প্রয়োজনে তারা সঞ্চয়ের জন্যে মোবাইল ব্যাকিং চালু করতে পারে। চালু করতে পারে নানান স্থানে ছোট ছোট উইন্ডো ( অর্থাৎ তিন থেকে চার জন স্টাফের একটি শাখা)।

এর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শাখা খোলার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও বেশি উদার হবার পরামর্শ দিতে পারেন। আর মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদেরকে দ্রুত শাখা খোলার নির্দেশও দিতে পারে। অর্থাৎ একটা টার্গেট ঠিক করা দরকার, কীভাবে প্রতিবছরে কত সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাংক পৌঁছাবে। তবে ব্যাংকে সাধারণ মানুষের টাকা আনার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা গত পাঁচ বছরে সামনে এসেছে, সেটা সুদের হার।

শিল্পায়নের লক্ষ্যে ব্যাংক সুদের হার ওয়ান ডিজিটে নামাতে গিয়ে সেভিংসের সুদের হার যেখানে চলে গেছে সেটা সাধারণ মানুষকে অনেকটা ব্যাংক বিমুখ করছে। এ বিষয়টি নিয়ে আরও চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন। সেভিংসের জন্যে মানুষকে মোটামুটি একটু লাভজনক সুদ না দিলে সাধারণ মানুষকে ব্যাংকমুখী করা কষ্টকর। তাই একদিকে শিল্পায়ন অন্যদিকে দেশের সঞ্চয় দুই এর ভেতর একটা সমন্বয় করা দরকার। সঞ্চয়ের জন্যে কোন ধরনের ইনসেনটিভ দেয়া যেতে পারে সেটা খোঁজা দরকার।

গত পাঁচ বছরে এটা সম্ভব হয়নি বলে মনে হয়। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সব সময়ই বলা হয়েছে, না বিষয়টি ঠিক আছে। তারপরেও নতুন অর্থমন্ত্রী যদি ব্যাংকারদের বক্তব্য এবং জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সাধারণ জনগনের কথা শোনেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন, বর্তমান সেভিংসের সুদের হারে শতভাগ মানুষকে ব্যাংকমুখী করা সম্ভব নয়। অথচ দেশকে উন্নত করতে, দেশের সব মানুষকে সঞ্চয়ের আওতায় আনার জন্যে এখানে একটি সমাধান দরকার। নতুন অর্থমন্ত্রী শপথ নিয়েই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন। তাই আশা করি এটা তার কাছে কোনও চ্যালেঞ্জই যেন না হয়। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে নরসিমা রাও ও মনমোহন সিং কিন্তু সফল হয়েছিলেন, বেশি মাত্রায় উদার নীতি অবলম্বন করে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে নেবার ক্ষেত্রে ভারত যখন উদার হলো তখন দেখা গেলো বৈদেশিক মুদ্রা দেশেও আসছেও বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা কতখানি কার্যকর হবে, বা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া সম্ভব কিনা সে বিষয়টি এখন সামনে এসেছে। যেহেতু অর্থনীতিকে নিয়ে আরো একটা লাফ দিতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো বাড়ানো দরকার।

অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি যদি তার মন্ত্রণালয়ে গত দশ বছরে যেটা সঠিক ভাবে সম্ভব হয়নি তা খুঁজতে যান তাহলে প্রথমেই তার চোখে পড়বে গত দশ বছরে দেশে শিক্ষার জন্যে অনেক কিছু করা হয়েছে ঠিকই তবে দেশে উচ্চ শিক্ষার মান বাড়েনি। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষার মান নেমেছে। কোনও বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না বলে বলা যায় প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষার মান ধরে রাখতে পারেনি। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এই শিক্ষার মান নামা শুরু হয়েছে আরো আগে থেকে। বাস্তবে এখন প্রথমে প্রয়োজন কোন কোন কারণে উচ্চ শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে; গত দশ বছরে কেন এটা বন্ধ করা বা মান বাড়নো সম্ভব হলো না এর কারণগুলো খুঁজে বের করা। সেজন্য কোনও কমিশন করার প্রয়োজন আছে কিনা বা দেশের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা দরকার সেগুলো সঠিক ভাবে চিহ্নিত করা।

একটি সার্বিক পরিকল্পনা নিয়ে দেশের উচ্চ শিক্ষার মানকে নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর বাড়িয়ে অন্তত প্রথম ধাপে এশিয় উন্নত দেশগুলোর কাতারে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এই উচ্চ শিক্ষার মান না বাড়লে বাস্তবে আমাদের অর্থনৈতিক জিডিপি একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যাবে। তাছাড়া আমরা যে উচ্চ মধ্যআয়ের দেশের পথে রওনা দিয়েছি এবং ভবিষ্যতে উন্নত দেশ হবো এটা সম্ভব হবে তখনই যখনই আমাদের উচ্চ শিক্ষার মান বাড়বে। বাস্তবে এখন সময় এসে গেছে এই মুহূর্ত থেকে প্রথমে এশিয় উন্নত দেশগুলোর মানের শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলা এবং ক্রমান্বয়ে আর্ন্তজাতিক মানের শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলা। আমাদের অন্তত একটি রূপরেখা নেয়া দরকার যে, আগামী একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে যেন দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে, কোন ক্রমেই আর অদক্ষ শ্রমশক্তি বিক্রি করে নয়। পাশাপাশি দেশের সকল কাজে যাতে মানসম্পন্ন উচ্চ শিক্ষিতদের নিয়োজিত করা যায়। বর্তমানে সব পেশাতেই সত্যিকারে দক্ষ ও শিক্ষিতের সংখ্যা কম এটা স্বীকার করেই এগুতে হবে।