নির্বাচনোত্তর ঐক্যফ্রন্টের করণীয়

শুভংকর বিশ্বাস
Published : 7 Jan 2019, 01:36 PM
Updated : 7 Jan 2019, 01:36 PM

বিরোধী দলে থেকে সরকারের সমালোচনা করা যত সহজ, সরকারী দলে থেকে বিরোধী দলের সমালোচনা করা ততটাই কঠিন। এটা সম্ভবত একারণে হতে পারে যে, আমরা খুব দ্রুত অতীত ভুলে যাই, হুমায়ুন আহমেদের ভাষায় যেটাকে বলে 'গোল্ডফিস মেমোরি'। আর ভুলবো না-ই বা কেন? এক একটা নতুন বছর আসে, অমনি আমরা বলি, 'আসুন অতীত ভুলে ভবিষ্যতের দিকে তাকাই'।

তাহলে বলুন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দশ বছর এবং তারও আগে দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামল, মোট বারো বছর ডিঙিয়ে ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালের বিএনপির তাণ্ডবলীলার কথা 'গোল্ডফিস" বাঙালি' তো দূরে থাক, কোনও পাগলেও কী মনে রাখবে? তাছাড়া তখন সোশাল মিডিয়ারও কোন দৌরাত্ম্য ছিল না যে, সাধারণ মানুষ তা ধারণ করে ভার্চুয়ালি ছড়িয়ে দিবে, যেটা এখনও ইথারীয় মাধ্যমে ঘুরে বেড়াবে। তাই তো আজ আমরা বেমালুম ভুলে গেছি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া পূর্নিমা রানী শীলের কথা, যে মেয়েটি নির্বাচনের পরপরই ৮ অক্টোবর ২০০১ সালে তৎকালীন জোট সরকারের আমলে গণধর্ষনের শিকার হয়েছিল তার মায়ের সামনে। এত মানুষ দেখে পূর্নিমার মা বলেছিল, "বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট, তোমরা একজন একজন করে এসো, না হলে আমার মেয়েটা মরে যাবে"।

আমরা ভুলে গেছি বাগেরহাটের রামপালের ছবি রানীর কথা, যাকে ২০০২ সালের ২১ অগাস্ট জোট বাহিনীর ক্যাডাররা বাসস্ট্যান্ড থেকে তুলে পাশের বিএনপির অফিসে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষন করেছিল। ভুলে গেছি, একই বছরে বাগেরহাটের যাত্রাপুরের ঠাকুরবাড়ীতে একরাতে ২৩ জন গৃহবধুকে ধর্ষণের ঘটনা। জেএমবির সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই? শায়খ আব্দুর রহমান? যারা বিএনপির ছত্রছায়ায় জঙ্গিবাদ শুরু করেছিল বগুড়ার নন্দিগ্রামের বাদশা নামক এক ব্যক্তিকে হত্যা করে আমগাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে।

৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা? সব, সবকিছুই আমরা ভুলে গেছি সময়ের আবর্তে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় যে গ্রেনেড হামলায় বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা হয়েছিল, যে হামলায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছিল, সেটাও ভুলে গেছি? গণতন্ত্র, গণতন্ত্র বলে এখন আমরা মুখে ফেনা তুলে ফেলছি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিরোধী দলের প্রধান নেতাকে হত্যা করতে চাওয়া কি গণতন্ত্রের পাঠ?

গণতন্ত্রের কথাই যখন আসলো, তখন আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, বাংলাদেশ কি এখনও গণতন্ত্রের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত? বাংলাদেশের সব জনগণ কী আসলেই দেশের ভালোটা বুঝতে সক্ষম? তাদের সবাই কী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বোঝেন? এমনকি দেশের সত্যিকার উন্নয়ন? দেশের অধিকাংশ জনগণ যদি এগুলো না বুঝতে পারে, তবে বাংলাদেশ যদি রাশিয়ার নির্বাচনী মডেল অনুকরণ করে, বিরোধী দলের জন্য খারাপ হলেও দেশের জন্য তা কি খুব খারাপ?

একাবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিগত প্রায় আঠারো বছর যাবত ভ্লাদিমির পুতিন কখনও প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবং কখনও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থেকে নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে, ২০১৮ সালের মার্চে সর্বশেষ প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে পুতিন তার দল ইউনাইটেড রাশিয়ার হয়ে নির্বাচন না করে স্বতন্ত্র হিসেবে আত্মবিশ্বাসী নির্বাচন করে প্রায় ৭৭ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। যেখানে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী কমিউনিস্ট পার্টির পাভেল গ্রুডিনিন পান মাত্র প্রায় ১২ শতাংশ ভোট। উক্ত ভোটে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে রিপোর্ট করে রাশিয়ার একমাত্র স্বাধীন ভোট পর্যবেক্ষক দল গোলোস।

বিরোধী দলসমুহের নেতাকর্মীদের উপর দমন-পীড়ন ও নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বশক্তির মধ্যে চীন সর্বপ্রথম পুতিনকে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানায়। পরবর্তীতে ভারত, জাপান, সৌদি আরব ও তুরস্কসহ অনেক দেশ নিরঙ্কুশ বিজয়ের জন্য পুতিনকে অভিনন্দন জানায়। বিশ্বশক্তিতে রাশিয়ার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা ও তার স্নেহধন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রথমে প্রত্যাশিতভাবে নিশ্চুপ থাকে।

সমসাময়িক সময়ে যুক্তরাজ্যের সালিসবারীতে রাশিয়ার সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও ইউকের গোয়েন্দা এজেন্ট সার্গেই স্ক্রিপাল ও তার মেয়ে ইউলিয়া স্ক্রিপালকে নিষিদ্ধ নার্ভ গ্যাসের বিষক্রিয়ায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে এবং ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগের ভিত্তিতে। পরবর্তীতে তারা পুতিনের বিরুদ্ধে নির্বাচনে শক্তিপ্রয়োগ ও নির্বাচনী আইন অমান্য করে বিজয়ী হওয়ার অভিযোগ তোলে। তারও পরে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প ও ইউরোপিয়ান কমিশনের সভাপতি জ্যঁ-ক্লাউড জ্যাঙ্কার পৃথকভাবে পুতিনকে ফোন করে অভিনন্দন জানান। আর ফ্রান্স ও জার্মানী সচেতনভাবে 'অভিনন্দন' শব্দটি এড়িয়ে পুতিনকে পরবর্তী ছয় বছরের জন্য শুভকামনা জানান।

দেখুন, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে পুতিন মারাত্মক অনিয়ম করে ভোটে জিতে আবারও দেশটির প্রেসিডেন্ট হয়েছে, সেটা কি রাশিয়ার উন্নয়ন ও বিশ্ব শক্তিমত্তার দিক থেকে রাশিয়ার জন্য খুব নেতিবাচক কিছু হয়েছে? বরং এটুকু জোর দিয়ে বলা যায় যে, পুতিন যেভাবে রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী করছে তাতে দেশটি আবারও তাদের হারানো বিশ্বমোড়ল খেতাব পূনরুদ্ধার করতে চলেছে, যেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের গাত্রদাহের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং, অত্যন্ত সঙ্গত কারনে তারা পুতিন-বিরোধীদের সমর্থন দিয়ে রাশিয়াকে পেছনে টেনে ধরার চেষ্টা করবে।

এবার দেখা যাক বাংলাদেশের একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মানবতাকে শিকেয় তুলে বধ্যভূমি বানানো ও নিরীহ ফিলিস্তিনিদের রক্তে রঞ্জিত ইজরায়েলকে উলঙ্গ হয়ে সমর্থনদানকারী পশ্চিমা বিশ্ব কি ভাবছে। গত ৩০ শে ডিসেম্বর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩০০ টি সংসদীয় আসনের মধ্যে এককভাবে ২৫৭ টি আসনে এবং জোটবদ্ধভাবে মহাজোটের হয়ে মোট ২৮৮ টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে। ভারত, চীন, রাশিয়া, ইরান, সৌদি আরব, কাতার, নেপাল, শ্রীলংকাসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশের প্রধানগন এবং ওআইসি ও সার্কের প্রধানগন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তাছাড়া সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষক দল নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে সিএনএন, দ্য ইকোনোমিস্ট, ওয়াশিংটন পোস্ট ও আল জাজিরাসহ সমমনা কিছু সংবাদ মাধ্যম নির্বাচনকে বিতর্কিত, বিপজ্জনক, একদলীয় গণতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল উভয়ের সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করে বিরোধীদলের পক্ষ থেকে ওঠা নির্বাচনে অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনারের কাছে। একইভাবে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইট ওয়াচ ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

দেখুন, যে গুটিকতক দেশ এবং মিডিয়া বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তারা কিন্তু খুবই কমন। তারাই কিন্তু সারা বিশ্বের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে অভ্যস্ত যদি সিদ্ধান্ত নিজের পক্ষে না আসে। এমন না যে তারা সবসময় মানবিকতার পক্ষে কথা বলে। তাহলে আজ আর মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলত না। সুতরাং, তারা যে বাংলাদেশের উত্থান ভালোভাবে দেখবে সেটা আশা করাটা বোধ হয় একটু বোকামি। সঙ্গত কারণেই তারা চাইবে না যে জননেত্রী থেকে ক্রমে বিশ্বনেত্রী হয়ে ওঠা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নেতৃত্বে আসুক।

আমার মনে হয় মোটা দাগে আমাদের সবারই এটা বিশ্বাস করা উচিত যে, আমাদের দেশটাকে আমরা বাংলাদেশিরা যতটা ভালবাসি (জামায়েত ইসলামসহ গুটিকতক দলে বিশ্বাসীরা বাদে), পৃথিবীর অন্য কোনও দেশ বা তাদের মিডিয়া ততটা ভালবাসে না। তাই নিজেদের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বিদেশি প্রভুর মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেরাই সেসব সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হওয়া উচিত।

এটা হতে পারে সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে, না হলে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে। তবে মনে রাখতে হবে, রাজপথ সোশ্যাল মিডিয়ার মতো ফুলের বিছানা নয়, বরং কন্টকাকীর্ণ। রাজপথের আন্দোলনে দরকার অকুণ্ঠ জনসমর্থন এবং সৎসাহসী, নির্ভীক ও ত্যাগী নেতৃত্ব যেটা এই মুহূর্তে বিএনপি-জামায়েত নিয়ে গঠিত ঐক্যফ্রন্টের নেই যারা নির্বাচনে মাত্র প্রায় ১২ শতাংশ ভোট পেয়েছে।

পক্ষান্তরে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট পেয়েছে প্রায় ৭৭ শতাংশ ভোট। ঐক্যফ্রন্টের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ ভোট ডাকাতি করে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। যদি করেও থাকে তা কতো শতাংশ হতে পারে? ১০ শতাংশ? ২০ শতাংশ? তারপরও কিন্তু মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করত। আর যদি ঐক্যফ্রন্টের ৭০ শতাংশ জনসমর্থন থাকত, তাহলে কি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে মাত্র ৩০ শতাংশ বা তারও কম জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ দেশের ৭০ ভাগ জনগণকে রাজপথে নামতে দেয়নি বা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি? আপনি নিজে কি তা বিশ্বাস করবেন? ১৯৯৬ সালে বা ২০০৬ সালে বিএনপি কি তা পেরেছিল?

এই মুহূর্তে ঐক্যফ্রন্টের উচিত নির্বাচনী বাস্তবতা মেনে নিয়ে বিদেশি প্রভুর কাছে অভিযোগ না করে নিজেদের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করে তা সমাধানের চেষ্টা করা। তাদের বুঝতে হবে যে, শুধু আওয়ামী লীগ বিরোধীদের ভোটে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে না, নির্বাচনে জিততে হলে তাদের নিজেদেরও কিছুটা ক্যারিশমা থাকা লাগবে। তাই তাদের সময় এসেছে জোটের নেতৃত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবার। তাদের ভাবতে হবে জোটের জন্য তারেক জিয়া, খালেদা জিয়া বা জামায়েত ইসলামী কতটা প্রয়োজনীয়। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, জামায়াত এবং জিয়া পরিবারকে বাইরে রেখে ড. কামাল হোসেন, মীর্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর, আ স ম আব্দুর রব, মাহামুদুর রহমান মান্নাদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন একটি দলই পারবে আগামী দিনগুলোতে কমপক্ষে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে।