পরিচয়টা ধর্মের নয় নাগরিকের হোক

Published : 7 Jan 2019, 12:35 PM
Updated : 7 Jan 2019, 12:35 PM

নাগরিক পরিচয়ে আমরা প্রথমে বাংলাদেশি। এরপর জাতীয়তা তথা ভাষাগত পরিচয়ে আমাদের বাঙালি/অবাঙালি/পাহাড়ি/আদিবাসী ইত্যাদি পরিচয় থাকতেই পারে। কারণ বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং জাতিগোষ্ঠী বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। এই ভূখণ্ডে এই বৈচিত্র্য কেবল পাকিস্তান আমল কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীতে গড়ে ওঠেনি বরং শত শত বছরের পুরানো। আমরা কেবল এই বৈচিত্র্যকে বংশানুক্রমে লালন করে চলেছি।

এদেশে ধর্মীয় পরিচয়ে কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ,কেউ খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্মীয় পরিচয় বহন করেন। বাংলাদেশে পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা সর্বোচ্চ। বলা হয়ে থাকে, এদেশে বিরানব্বই শতাংশ মানুষ পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারী। অপরদিকে দেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সংখ্যা কমতে কমতে ৪৮ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে বর্তমান প্রায় আট শতাংশ মত মানুষ পবিত্র হিন্দু ধর্মের অনুসারী। আর বাংলাদেশে পবিত্র বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীর প্রকৃত সংখ্যা এক শতাংশেরও কম।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বাংলাদেশে মুসলমান জনগোষ্ঠী সংখ্যায় সর্বোচ্চ। এরপর দ্বিতীয় স্থানে হিন্দু জনগোষ্ঠী এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর অবস্থান। এই সংখ্যার বিচারে বলা হচ্ছে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু। অর্থাৎ সংখ্যায় বেশি এবং কম। অথচ নাগরিক পরিচয়ে আমরা কেউ সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘু নই। জাতীয়তার পরিচয়ে আমরা সবাই বাংলাদেশী। এটাই আমাদের মূল পরিচয়।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এদেশের জাতিগত ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠী এখনো পর্যন্ত নাগরিক পরিচয়টাকে বড় করে তুলতে পারেননি। অপরদিকে অনেকের মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নাগরিক হিসেবে সংখ্যালঘু ভাবার মনোভাব এখনো পর্যন্ত পরিবর্তন হয়নি। সময় যতই এগোচ্ছে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু বিষয়টি ততই প্রকট হওয়া সত্যিই পীড়াদায়ক। এটা আমাদেরকে আহত করে। ধর্মীয় তুলনায় সংখ্যায় কম-বেশি তুলনার বিষয়টি যখন আসে তখন সবল আর দুর্বলের বিষয়টি চলে আসে। এতে করে ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং বিরোধ তৈরি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

আমি সংখ্যালঘু বলতে বুঝি,পৃথিবীর অন্য দশটি দেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ আমাদের বাংলাদেশেও কিছু মানুষ আছে যারা এদেশের শান্তি, সমৃদ্ধি চায়না। যারা বিভিন্ন অজুহাতে সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়, মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করতে চায়, ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফায়দা নিতে চায় তারাই সংখ্যালঘু। কারণ তাদের সংখ্যা আমাদের দেশে বেশি নয়। তাদের সংখ্যা খুবই কম। তাদের কোনও সুনির্দিষ্ট ধর্ম নেই, জাত নেই, সভ্য সমাজে দেওয়ার মতো তাদের কোনও পরিচয় নেই। তাদের পক্ষে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রযন্ত্র, দেশের আমজনতা, বিবেকি সমাজ কেউ নেই। অসহায় তো তারাই হওয়ার কথা। এদেশের ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীরা নয়।

বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি. ধর্ম বিশ্বাস, জাতিগোষ্ঠীর নাগরিকেরা তো এদেশের শোভা। বৈচিত্র আছে বলেই আমাদের দেশ এত সুন্দর। একটি ফুলের বাগানে কেবল একজাতীয় ফুল থাকলে এর কোনও সৌন্দর্য এবং আবেদন থাকেনা। যদি সেই বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের সমাবেশ ঘটানো যায় তাহলে বৈচিত্রতার কারণে উক্ত বাগানের সৌন্দর্য এবং আকর্ষণ দুটোয় বাড়ে। আমাদের জন্মভূমি তো তেমন এক দেশ যেখানে বৈচিত্রের সমাহার আগে থেকেই আছে। এই বৈচিত্রকে লালন করতে না পারলে, টিকিয়ে রাখতে না পারলে ক্ষতিটা দেশের এবং আমাদের সবার।

রাষ্ট্রের চার মূলনীতির একটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের ১২অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, কোনও বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ণ বিলোপ করা হইবে' ২৮ অনুচ্ছেদের (১) ধারায় বলা হয়েছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।' অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রের সকল ধর্ম বর্ণের মানুষ রাষ্ট্রের কাছে কেবল নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হবে। নাগরিকের ধর্মীয় পরিচয় রাষ্ট্রের কাছে মুখ্য পরিচয় নয়। রাষ্ট্রের সংবিধান এটাই বলে।

ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। রাষ্ট্রের সকল ধর্মমতের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম পালন করার যে সুষ্ঠু পরিবেশ প্রয়োজন সেই পরিবেশ নিশ্চিত করাই মূলত ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্রের জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলে যার যার ধর্মপালন করবে কিন্তু কেউ কারও ধর্ম পালনে কোনও ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেনা। ধর্মীয় উসকানি দিয়ে উন্মাদনা তৈরি করে এক ধর্মের মানুষ অন্য আরেক ধর্মের অনুসারী মানুষের ক্ষতি করবে না, তাদের উপর সহিংসতা চালাবেনা, তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং স্থাপনায় আঘাত হানবেনা এটাই ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির বৈশিষ্ট্য।

সকল ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জমি-জমা, বাড়ি-ভিটে এবং সম্পত্তির সুরক্ষা পাওয়ার পূর্ণ অধিকার আছে। রাষ্ট্র এবং সরকার এসব নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির আলোকে এটা রাষ্ট্র এবং সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিচারে একই রাষ্ট্রের নাগরিকদের সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু বিবেচনায় বৈষম্য করা ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির পরিপন্থী। ধর্ম যদি প্রকৃত অর্থে কোনও ব্যক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে তাহলে সেটা তার ইহ-পরকালের জন্য হিতকর হয়। কিন্তু রাষ্ট্রনীতি এবং রাজনীতির স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা হলে এর ফল এবং পরিণতি কখনো ভাল হয়না। আমাদের দেশে তাই হয়েছে। তবে এর দায় ধর্মের নয়, দলমত এবং পেশা নির্বিশেষে আমাদের সবার।

আমাদের দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি নাগরিকদের ধর্মীয় পরিচয়টাকে বড় করে তুলেছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু সরকার গঠন করে, দলীয় সরকার ব্যবস্থাও সুবিধাবাদী এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারছেনা অথবা বের হয়ে আসার চেষ্টা করছেনা। বিশেষ করে ভোটের রাজনীতিতে ধর্মীয় অনুভূতি এবং পরিচয়টা বড় হয়ে ওঠে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং সংসদ নির্বাচনে এটা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেখা যায়, কোনও কোনও ইউনিয়নে ওয়ার্ড ভেদে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভোটার অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অনেকে ওয়ার্ড প্রতিনিধি (মেম্বার/কমিশনার) নির্বাচিত হন। অনেক জায়গায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে উপজেলা চেয়ারম্যান/ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার নজিরও আছে। যদিও তাদের সংখ্যা একেবারে সীমিত পর্যায়ের। বৌদ্ধদের মধ্যে তিন পার্বত্য চট্রগ্রাম ছাড়া অন্য কোনও জেলায় সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার দৃষ্টান্ত নেই।

সারাদেশে এমন কিছু সংসদীয় আসন আছে যেখানে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু কোনও প্রার্থী ভোটের মাঠে জিতে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু সেসব আসনের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এক তরফা ভোট বা সমর্থন ধর্মীয় সংখ্যাগুরু কোনও প্রার্থীর জয়ের নিয়ামক এবং পরাজয়ের কারণ হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভোট আদায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এমন এলাকা বা আসনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি তথা টানাটানিও বেশি হয়ে থাকে। ধর্মীয় উম্মাদনা এবং বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক কোন ঘটনা বা সহিংসতা ঘটাতে পারলে একপক্ষ আরেকপক্ষকে ঘায়েল করতে সুবিধা হয়। কাজেই জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয়-ভীতি, আতংক এবং অনিরাপত্তাবোধ জিঁইয়ে রাখতে পারলে এবং তাদেরকে কোনঠাসা করে রাখতে পারলে এক ধরনের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা যায়।

জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানে যদি হয় তাদেরকে আজন্ম ভয়-ভীতি, আতংক, সুবিধা বঞ্চনা এবং অনিরাপত্তাবোধের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হবে এবং বেঁচে থাকতে হবে তাহলে এ মানুষগুলো দুর্বল মন-মানসিকতার হতে বাধ্য। মানুষকে কেবল মানুষ হিসেবে এবং রাষ্ট্রের একজন নাগরিক আরেকজন নাগরিককে কেবল নাগরিক হিসেবে দেখার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। পারিবারিক পর্যায় থেকে এ শিক্ষা শুরু করতে হবে। কারণ একই রাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া এবং বেড়ে ওঠা সন্তানেরা কেউ নিজেকে সুপারিয়র (শ্রেষ্ঠতর) এবং কেউ ইনফেরিয়র (হীনতর) ভাবার মানসিকতা লাভ করলে তাদেরকে দেমাগ, হীনমন্যতা, দুর্বলতা এবং জাতিবিদ্বেষের মত খারাপ দিকগুলো গ্রাস করবে। এটা দেশ এবং জাতির জন্য কখনো মঙ্গলজনক হবেনা। শিশুকালে মানবিক গুণাবলীর শিক্ষা পাওয়া আজকের সন্তানেরাই সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মের একেকজন যোগ্য প্রতিনিধি। এই তরুণ প্রজন্মই আগামীর সোনার বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্মাতা এবং উত্তরাধিকারী।