তপ্ত কড়াইয়ে আগুন ভুলে থাকি!

হাসান ইমাম
Published : 14 Dec 2011, 11:35 AM
Updated : 6 Jan 2019, 12:44 PM

বাংলা ভাষায় যতভাবে মৃত্যুকে চেনা-বোঝা যায়, তার মধ্যে পটলতোলা-ই সম্ভবত সবচেয়ে 'মূল্যহীন' উপমাযোগের শব্দ! সহজলভ্য বেচারা এই সবজির চেয়েও অপঘাত মৃত্যু যেন বাংলাদেশে অনায়াস, বিশেষত্বহীন। অন্য অনেক বিষয়ের অগ্রগতি বা উল্লম্ফন বোঝানোর মতো অপঘাত মৃত্যুও এখন তাই পরিসংখ্যানে উপস্থাপিত, সংখ্যায় বিবেচ্য!

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বসন্তের গান বর্ষায় বেমানান যেমন, নির্বাচনের মৌসুমে ভোটের বাইরে, জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশের বাইরে, বিজয় উদযাপনের বাইরে বাকি সবই ছাইভস্ম-সমান! সুতরাং অমুক হোসেন-তমুক খাতুনের  মতো হাজারো বাংলার নর-নারীর তথাকথিত সড়ক দুর্ঘটনায়, 'ক্রসফায়ারে', মাদকবিরোধী অভিযানে এমনকি পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু এখন রাজনৈতিক মনোযোগের বাইরে, নির্বাচনি 'প্রদশর্নী'র আড়ালে। তাই গতকালের 'এত'জনসহ গত 'এত' দিনে সড়ক দুঘর্টনায় নিহত 'এত'; হররোজ পত্রিকার পাতায় ছাপা হওয়া অপঘাত মৃত্যুর এই খতিয়ান স্রেফ সংখ্যা। একইভাবে কেবল সংখ্যা হয়ে থাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মাদকবিরোধী অভিযানের 'অর্জন', পুলিশি হেফাজতে 'আইনি' ক্ষমতার এস্তেমাল! এমনকী, বিশেষ তাৎপর্যের নিরিখে স্থিরিকৃত 'দিবসে'ও সংশ্লিষ্ট বিষয় সীমাবদ্ধ থাকে গণমাধ্যমের দায়সারাহীন গোছের প্রতিবেদনে, সংক্ষুব্ধ পক্ষের মানববন্ধন-বিবৃতিতে, ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আয়োজিত শোকসভায়, স্মরণসভায়। আর নির্বাচনকেন্দ্রীক যত প্রাণহানি, রাজনৈতিক দল-জোটের তত 'সুবিধা'!

কোনও দলের বা পক্ষের কারও অপঘাত মৃত্যু মানেই তা প্রতিপক্ষ বধের 'অব্যর্থ হাতিয়ার', খুলে যায় নিজেদের বিজয়ের দুয়ার! আর খোদ নির্বাচনের দিনের সংঘাত-প্রাণহানির খতিয়ান আগের নির্বাচনগুলোর তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরার একটি উপাদন মাত্র! তাই এবারের ভোটের দিনের ১৭-১৮ জনের নির্মম হত্যাকাণ্ডও নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড বিবেচ্য; বিজয়ী ও বিজিত পক্ষের একে অপরের দোষারোপের ট্রাম্পকার্ড!

তবে এসব মৃত্যুমথিত সংখ্যার জরুরত আছে বৈকি; এগুলো কাজে লাগবে আগামীদিনের নতুন সংসদে কোনও মাননীয় সংসদ সদস্যের করা প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর উত্তরে, বিদগ্ধ গবেষকদের গবেষণাকাজে, বছরওয়ারি তুলনামূলক চিত্রে, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে উত্থাপনের জন্য, এমনকী গত বছরটা কেমন গেল— এ বিষয়ে পত্রপত্রিকার করা বিশেষ ক্রোড়পত্রে, টেলিভিশনগুলোর গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনে। ইত্যাদি, প্রভৃতি এমন অনেক দালিলিক কাজে পরিসংখ্যান সংরক্ষিত থাকবে, কিন্তু কোনও দলিলেই লেখা থাকবে না ভাতের থালায় গড়িয়ে পড়া স্বজনের অশ্রুর তীব্রতা, বুক ফালা ফালা করে দেওয়া আহাজারির ব্যাপকতা, কোনও কিছুতে পূরণ না হওয়া তাদের জীবন-ঘেরা শূন্যতা… এবং কোনও শব্দ-বাক্যেই ধরা পড়বে না স্বজনহারা মানুষগুলোর বেদনার ভাষা।

২.

'দুর্ঘটনা' বলতে যা বোঝায় বাংলাদেশে তা 'নিয়মে' পরিণত! সড়ক দুর্ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বলার উপায় কি থাকে, যখন চালকদের যোগত্যা নিরূপণে রাষ্ট্রীয় শীর্ষপর্যায় থেকে মানুষ ও গবাদি পশুর পার্থক্য নির্ণয়কে মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়? শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মীম-সজীবের মর্মান্তিক মৃত্যুর জেরে দেশময় ছড়িয়ে পড়া 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনের ঝাঁকুনিতেও তাই আমাদের বেহুঁশদশা কাটেনি— কি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, কি সামাজিক বা ব্যক্তিপর্যায়ে। সুতরাং সবার চোখের সামনে প্রতিদিনই ঘটছে 'প্রতিকারহীন' প্রাণহানি!

৩.

অপরাধের বিচার করাই দস্তুর সভ্য সমাজে। অপরাধীকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন যেমন ওঠে না, তেমনি বিচারের নামে ইচ্ছেমাফিক সাজা দেওয়াও জায়েজ হতে পারে না কোনও বিবেচনাতেই— চাই কি গণতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়, জরুরি বা স্বাভাবিক অবস্থায়। কিন্তু সভ্যতার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে মানবাধিকারকে অগ্রাহ্য করাই যেন প্রশাসনিক শৌর্য-বীর্জের পরিচায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে!

আইন ও সালিশ কেন্দ্র—আসকের হিসাব বলছে, সদ্যবিদায়ী বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ৪৩৭। এই সময়ে গুম হয়েছেন ২৬ জন।

'ক্রসফায়ার' নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার যে 'হাতসাফাই' অ্যানালগ আমলে উদ্ভাবিত, ডিজিটাল যুগে এসে তা আরও সমৃ্দ্ধ, সুচারু! এর সঙ্গে যোগ হয়েছে 'গুম' নামের তেলেসমাতি! একজন মানুষ আচানক সবার 'দেখা-শোনা'র বাইরে চলে যান, এমনকি জানা যায় না তার অন্তিম ঠিকানাও! গন্তব্য নির্ধারিত না হয়ে জীবনের শুরু কি হতে পারে কারও? গুমব্যবস্থা তা-ও গুম করে দেয়! সত্যিই রাষ্ট্রের চেয়ে বড় ম্যাজিশিয়ান নেই!

আসকের বক্তব্য, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগের ব্যাখ্যা চেয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবরে। সেসব বিষয়ের ১৫৪টির উত্তর নাকি এখনও মেলেনি। মিললেও কি প্রতিকার পাওয়া যাবে? আশাবাদী মানুষের উত্তরও, বোধকরি, এক্ষেত্রে হ্যাঁ-সূচক হওয়া দুষ্কর।

.

একটি সমাজ যতভাবেই বিকশিত হোক এক মাদক তার সামর্থ্যে ঘুণ ধরানোর পক্ষে যথেষ্ট। তাই মাকদের আছরমুক্ত সমাজের প্রশ্নে সরকারের 'জিরো টরারেন্স' অবস্থানই কাম্য। কিন্তু তা অবশ্যই ন্যূনতম আইনি বন্দোবস্ত, মানবিকতার পাঠ আর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মনে রেখে। আসকের হিসাবে গত বছরের ১৫ মে থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে বেঘোরে মারা পড়েছেন ২৭৬ জন।

সভ্যতার পূর্বশর্ত কি বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষী/নির্দোষ সাব্যস্ত করে শাস্তি/রেহাই দেওয়া নয়? এক অপরাধ নির্মূলে আরেক অন্যায় পন্থার ফল হাতেগরম পাওয়া যেতে পারে বটে, তবে সেই ফল 'গরম' হতেও বাধ্য; এতে হাত পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বৈকি।

মৃত্যুদণ্ডই হয়তো মাদককারবারিদের 'প্রাপ্য'ই হতো বিচারে, কিন্তু ন্যূনতম অধিকারহীনতার ভেতর দিয়ে এমন মৃত্যু তাদের 'মানুষ' পরিচয়কে অস্বীকার করে। ব্যক্তি মানুষের মৃত্যুতে সমাজের অগ্রযাত্রা থামে না বটে, কিন্তু মানুষের অধিকারহীনতা সমাজকে খঞ্জ করে।

৫.

বছরের পর বছর ধরে আসকের মতো বিভিন্ন সংস্থা, নানা কিসিমের নজরদারি বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ গণমাধ্যমের দেওয়া এসব অপঘাত মৃত্যু তথা বকলমে 'হত্যা'র খতিয়ান কি আলাদাভাবে কারও নজরে পড়ে, এখন— এই ডিজিটাল বাংলাদেশে? নজরে না পড়লে মনেই বা পুষবে কীভাবে? আমাদের নজর কি নিজেদের চৌহদ্দির সীমা পেরিয়ে যায়? যায় না। নিজেরা 'সেফ' থাকলে অন্যের বিপদে আমরা চোখ বুজে থাকি; একবারও ভাবি না এর পরের 'টার্গেট' আমি! আর নির্বাচন নামের যে ঢাকে বাড়ি পড়েছে, একপক্ষের আড়েবহরে আজদাহা বিজয়ের যে বুলন্দ শব্দ উঠেছে তাতে ভুক্তভোগী মানুষের গোঙানি-ফোঁপানি-আহাজারি সবই অশ্রুত। রাজনৈতিক হুঙ্কারে চাপা পড়ে মানবিক স্বর!

রাষ্ট্র যখন নিদ্রায় থাকে, সমাজ যখন অন্ধ আর ব্যক্তি মানুষেরা নিজেদের খোলসে আবদ্ধ, তখন অব্যবস্থাপনাই ব্যবস্থা, অপঘাত মৃত্যুই পরিণাম। আমৃত্যু শোকের কাতরতা, বেদনার বিহ্বলতা, ক্ষোভের তপ্ততা কেবল স্বজনের!