বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষায় ‘মাইনাস থ্রি, প্লাস ওয়ান’ ফর্মুলা

বিজন সরকার
Published : 6 Jan 2019, 12:16 PM
Updated : 6 Jan 2019, 12:16 PM

বিএনপি ক্ষমতার বাইরে আজ দশ বছরের উপরে। দীর্ঘ দুই দশকে দলটির অবস্থা খুবই নাজুক। দলটি এখন একটি নতুন বাস্তবতার সম্মুখে রয়েছে।

বাস্তবতাটি হল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন। একটি বিশাল উন্নয়ন যজ্ঞের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যাচ্ছে। দেশের সাধারণ জনগণ সেটির সুফল পাচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকার যে উন্নয়নটি করছে সেটি পরীক্ষিত; এর আগে অন্য কোনও সরকার সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা থাকলেও (উদাহরণ: দুর্নীতি) জনগণের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মত নয়। তাদের সামনে আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই।

বিএনপি নিজেদেরকে আওয়ামী লীগের বিকল্প কিংবা সমকক্ষ হিসাবে প্রস্তুত করতে পারেনি। দলটি যদি নিজকে আওয়ামী লীগের বিকল্প হতে এখন পরিবর্তন করতে শুরুও করে, দলটির বিশ থেকে পঁচিশ বছর লেগে যাবে।

২০০১ সাল থেকে বিএনপি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এই মরণ ব্যাধি ক্যান্সারের কুপ্রভাবে দলটির প্রাণ যায় যায়। কোনও চিকিৎসা ছাড়া দলটি দু-দশক পার করেছে। দলটির বাইরে থেকে দলটির প্রয়োজনীয় চিকিৎসার কথা বলা হলেও ক্যান্সারে আক্রান্ত বিএনপি একটি অসচেতন মানুষের মতো আচরণ করছে। দলটির ডাইনোসর হওয়ার ঝুঁকির মাত্রা বিপদসীমার বেশ উপরে।

ক্যান্সারে আক্রান্ত বিএনপির নানান অঙ্গ অকেজো হয়ে পড়ছে। একটি বিশদ গবেষণা ছাড়া বিএনপির অকেজো অঙ্গের সঠিক চালচিত্র পাওয়া যাবে না। তিনটি প্রধান অঙ্গের চিত্রটির পর্যবেক্ষণেই পাওয়া যাবে বহুমাত্রিক রোগের প্রভাবে দলটি কেমন ভাবে আক্রান্ত। প্রসঙ্গত, দলটির জন্মই হয়েছিল কৃত্রিমভাবে।

আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে দলটির ঐক্যের প্রতীক বেগম খালেদা জিয়া। অর্থ আত্নসাতের মামলার রায়ে তিনি এখন জেলে। তার বয়স ৭৩। নানান ব্যাধিতে আক্রান্ত। জেল থেকে কবে ছাড়া পাবেন বর্তমান বাস্তবতায় সেটি বলা খুবই অসম্ভব। জেল থেকে ছাড়া পেলেও বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত কারণেই দলটির জন্য প্রয়োজনীয়তা সাপেক্ষে কর্মতৎপর হয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

ঐক্যের প্রতীক যখন একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে ভূমিকা হীন হয়ে উঠে, তখন ক্ষমতা-মুখি চরিত্রের মানুষদের দুর্বল আদর্শের জায়গায় নানান স্বার্থ আঘাত করে। নির্বাচনের পরে বিএনপির জন্য এমন বাস্তবতা প্রবল হয়ে উঠতে পারে। বলা যায়, খালেদা জিয়ার পক্ষে ঐক্যের প্রতীক হয়ে থাকার ক্রাউনটি 'আপসহীন নেত্রী'র মতই খসে পড়বে।

বিএনপির ঐক্যের প্রতীক হিসাবে দ্বিতীয় ব্যক্তিটি এখনো তারেক রহমান। একই সাথে এই তারেক রহমান বিএনপি কেবল ঐক্যের জন্য নয়, দলটির ভবিষ্যতের জন্য একক বড় হুমকি। তারেক রহমানের ইমেজের কারণেই বিএনপির প্রতি বাইরের কোন দেশের সামান্যতম আস্থা নেই। ভারতের কথা বাদ দেন, চূলখানি-গত কারণে আওয়ামীলীগের প্রতি বিরাগভাজন খোদ মার্কিনীরাও তারেক রহমানের প্রতি শূন্য আস্থা রয়েছে।

তারেক রহমানের ইমেজের যে রাজনৈতিক বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সেটি হল জঙ্গি-বান্ধব জামায়েত ইসলামের সাথে বিএনপির নাড়ির সম্পর্কটি। যে কোন বিচার্যে জঙ্গি-বান্ধব রাজনীতির ডিপো জামায়াতে ইসলাম বিএনপির জন্য বড় বোঝা। তা স্বত্বেও কেবল তারেক রহমানের কারণেই বিএনপি-জামায়াতে ইসলামের মধ্যকার 'অ্যাম্বেলিকাল কর্ড'টি কাটা যাচ্ছে না। তাছাড়া হাওয়া ভবন, ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা ও দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার মত বিষয়গুলিও রয়েছে।

ফলে তারেক রহমানের সামগ্রিক ইমেজ দলটিকে প্রতিটি মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বলা যায় বিএনপির 'তারেক রহমান' অঙ্গটিও বিএনপির জন্য অকেজো। বরং তারেক রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতি জন্য বড় অস্ত্র। সোজাভাবে বলা যায়, বিএনপিতে তারেক রহমানের উপস্থিতির ফল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কোষাগারে জমা হচ্ছে।

বিএনপির আরেকটি অঙ্গ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। সত্তর দশকের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন গরীব দেশগুলিতে একটি 'সামরিক শাসক' প্রকল্প শুরু করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল যে কোন মূল্যে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকানো। মুয়াম্মার গাদ্দাফি থেকে শুরু করে পাকিস্তানের জিয়াউল হক ও বাংলাদেশের জিয়াউর রহমান একই প্রকল্পের বাই-প্রডাক্ট।

বিশ্বব্যাপী চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ছিল প্রায় অভিন্ন। কিন্তু সময় ও বিশ্বের নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এখন একে অন্যের বিপরীতে। চীনের অর্থনৈতিক উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনকে ঠেকাতে ভারত ছাড়া অন্য বিকল্প নেই। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করবে না তাতে ভারতে খেপে যেতে পারে।

তাছাড়া ডোনান্ড ট্রাম্পের রক্ষণশীল নীতিতে বাইরের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর বিষয়টি তেমন নেই। ফলে ঢাকায় মার্কিন স্টেশনে দায়িত্বরত কেউ যদি কিছু লম্পঝম্পও করে সেটি কেবল লোক দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়।

অধিকন্তু, বাংলাদেশ চীনের সামরিক পণ্য ক্রেতাদের অন্যতম। তাছাড়া চীন নিজেই নির্বাচন বিহীন শাসন ব্যবস্থায় আছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ নিয়েও চীন নিজেই অস্থির। এসব বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বলেন আর চীনই বলেন, কোন দেশকে বিএনপি পাশে পাচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই।

প্রশ্ন হল বিএনপি এখন কী করবে? দলটির সামনে কোনও পথ কি খোলা আছে যাতে দলটি বিলুপ্তি হওয়া থেকে বাঁচতে পারে।

দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেশ দক্ষতার সাথে বেঁচে থাকার প্রথম কাজটি করে গেছেন। উনি দলটিকে ড. কামাল হোসেনের মতো অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের মতো নেতাদের সাথে যুক্ত করতে পেরেছেন।

আজ যদি ড. কামালেরা বিএনপির পাশে না থাকত, বিএনপি আর বিপদগ্রস্ত হয়ে উঠত। এটি আপনি মানতে পারেন, নাও মানতে পারেন। তবে নির্মোহ বাস্তবতা হল আওয়ামী লীগের ভাল কাজের তুলনায় খারাপ কাজের পরিমাণ খুবই সামান্য। ফলে আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি কখনো জনগণকে পাশে পায়নি।

বিএনপি ড. কামালদেরকে সামনে রেখে দেশের মানুষদের কাছে আওয়ামী লীগের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। ভারতে কংগ্রেসের বাইরে অনেক প্রগেসিভ রাজনৈতিক ফোর্স রয়েছে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বাইরে সেই অর্থে কার্যকর কোন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল নেই।

অনেকেই আছেন যারা বিকল্প পেলে বিকল্প ভাববেন। দেশের জন্যও এটি খুবই দরকার। দেশের তরুণ প্রজন্মও চায় যে সংসদে সরকারি ও বিরোধী হল দুটি হবে পরিপূর্ণভাবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির। জামায়েত ইসলামকে পাশে রেখে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দাবি করাটা যে কেবল হাস্যকর নয়, আত্নঘাতীও বটে সেটি বিএনপিকে বুঝতে হবে। শিশুদের মতো গোঁ ধরে থাকলে সামনে বিপন্নতার হুমকি।

বিএনপি যদি বিকল্প হওয়ার রাস্তায় বাধাহীনভাবে যায়, তবুও দশ থেকে পনের বছর লেগে যেতে পারে। তবে একেবারেই বিপন্ন হয়ে যাওয়ার থেকে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে আগানোই উচিত।

ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হচ্ছে ড. কামালের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট সেই দিকেই যাচ্ছে। দৃশ্যত বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের হাতে এক ধরনের নিরাপদ ছিনতাই হয়ে গেছে। ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব কিংবা সুলতান মুনসরের মতো ইতিহাসের অংশে হয়ে যাওয়া নেতারা যখন একজন সামরিক শাসকের নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন, তখন বুঝতে হবে উনারা কেবল সংসদ নির্বাচন করার জন্যই আসেনি। যাহোক, মুল কথা হচ্ছে ঐক্যফ্রন্টের বাইরে বিএনপির কোনও ভবিষ্যৎ নেই। ঐক্যফ্রন্টের বাইরে বিএনপি মৃতপ্রায়।

বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের ভিতরে থাকুক কিংবা বাইরে থাকুক, বিএনপিকে দল হিসাবে টিকে থাকতে হলে তিনটি অনুষঙ্গকে একেবারেই শরীর থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে। সংযোজন করতে হবে আরেকটি নতুন অনুষঙ্গ। তাই বিএনপির বেঁচে থাকার জন্য সেই ফর্মুলার নাম দেওয়া হয়েছে 'মাইনাস থ্রি প্লাস ওয়ান' ফর্মুলা।

মাইনাস থ্রি

মাইনাস ১ (তারেক রহমান): তারেক রহমান বিএনপির ঐক্যের প্রতীক হিসাবে দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেও এখন তিনি দলটির জন্য সাদা হাতি। তারেক রহমানকে নেতা বানাতে গিয়েই বিএনপি আজ খাদের কিনারায়। ২০০১ সাল থেকে তারেক রহমানের বিএনপির একটি অংশের নেতা হওয়া, জামায়েত শিবিরের সাথে তারেক রহমানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও প্যারালাল সরকার পরিচালনা করার খেসারত বিএনপি আজকে দিচ্ছে।

বিএনপির সাথে জামায়াত ইসলামের সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তারেক রহমান। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশের জঙ্গিবাদের প্রসারও ঘটেছিল তারেক রহমানের সমর্থনে। লন্ডন যাওয়ার পর তারেক রহমান আর বিএনপির নেতা থাকেনি! দৃশ্যত  তিনি এখন জামায়েত ইসলামের মুখপাত্র! ইচ্ছে করলেই তারেক রহমান জামায়েত শিবিরের খাঁচা থেকে বাহির হতে পারবে না। তার পিছনে রয়েছে জামায়াত শিবিরের বড় ধরনের বিনিয়োগ।

তারেক রহমান নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় না আসুক, সেটি আওয়ামী লীগ যতটা না চায়, তারচেয়ে বেশি চায় ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলি।

তারেক রহমানকে বিএনপির নেতা মেনে বিএনপির ক্ষমতায় আসার রাস্তা বন্ধ। দেশের এমনকি দেশের বাইরের প্রগতিশীল ও সচেতন সমাজ তারেক রহমানের কারণে বিএনপির পাশে দাঁড়াবে না। ফলে বিএনপির উচিত তারেক রহমানের বিকল্প ভাবা। মজার বিষয়ও হল, বিএনপির বিপক্ষে আওয়ামী লীগের তেমন কোনও রাজনীতি করার দরকার নেই; তারেক রহমান বিএনপির নেতা এই সত্যটি আওয়ামী লীগের বড় রাজনৈতিক হাতিয়ার।

এমতাবস্থায় তারেক রহমান হল মাইনাস ১। বিএনপি এই কাজটি যত তাড়াতাড়ি করবে, ততই মঙ্গল।

মাইনাস ২ (জামায়াত শিবির) 

জামায়াত শিবির একটি যুদ্ধাপরাধীর দল। এটি আইনত প্রমাণিত। তারা দেশের স্বাধীনতা চায়নি। দলটির অনেক নেতার যুদ্ধাপরাধের কারণে ফাঁসি হয়েছে। স্বাধীনতার পরে দুই দশক ইতিহাস বিকৃত করে ও নানান কাঠামতে এই যুদ্ধাপরাধী দলটিকে প্রণোদনা দিয়ে রাজনীতি দলটিকে জিঁইয়ে রাখা হয়েছিল। গত দশ বছরের দেশের কয়েকটি প্রজন্ম স্বাধীনতার ইতিহাসটি পরিপূর্ণভাবে জানতে পেরেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ইসলামের যে সম্ভাবনা আগে দেখা যেত, সেই সম্ভাবনার বীজটি গত দশ বছরে ধস হয়ে গেছে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও জামায়েত ইসলাম একটি জঙ্গি সংগঠন হিসাবে পরিচিত। সংগঠনটি মিশরের ব্রাদারহুডের ক্লোন। এমতাবস্থায় জামায়েত ইসলামকে সাথে নিয়ে একটি সাম্য সমাজ ব্যবস্থা গঠন যেখানে নানান জাতি গোষ্ঠী ও বিশ্বাসের মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত হয় সেটি সম্ভব নয়। জামায়েত ইসলাম পরিপূর্ণভাবে একটি ফ্যাসিস্ট শক্তি।

পাকিস্তানে জামায়েত ইসলামের মতো আর অনেক ইসলামিক উগ্রবাদী সংগঠন থাকাতে ভোটের রাজনীতিতে জামায়েত ইসলামের একক কোনও প্রভাব নেই। অন্যদিকে ভারতের গণতান্ত্রিক পরিবেশে জামায়েত ইসলাম অনেকবারেই নিষিদ্ধ হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ জামায়েত ইসলাম সম্পর্কে ভালভাবে জানার আগেই মোট ভোটের তিন শতাংশ ভোটের মালিকানা পেয়ে যায়।

ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হলো বিএনপি। কারণ বিএনপি ও জামায়াতের ভোটের অংশ ওভারল্যাপ হয়। এই প্যারামিটারটি বিবেচনায় আমার সব সময় মনে হয়েছে, জামায়াত ইসলাম খুব কৌশলে তারেক রহমানকে বিতর্কিত করেছে। বিএনপি যতই অগোছালো থাকবে, তাতে জামায়েত ইসলামের লাভ। আওয়ামী লীগ বিরোধী গোষ্ঠিরা ব্যর্থ জাতীয়তাবাদের বদলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে মানসিক শান্তি খুঁজবে। তাতে বিএনপিরই ক্ষতি।

অধিকন্তু, বিএনপি যে জামায়াত শিবির ক্যাডার বাহিনীর উপর নির্ভর করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাকে সরানোর পরিকল্পনা করে সেটি একেবারেই ভুল। জঙ্গি শিবিরের ক্যাডারদের রাজপথে পাওয়া ভবিষ্যতে কঠিন। জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মীরা বিয়েশাদি করে পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। তাদের রয়েছে সচ্ছল অর্থনীতি। এমতাবস্থায় তাদের সেই সচ্ছল থাকার কাঠামোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে যাবে কেন? কোনও দেশের সমর্থন বিএনপির না পাওয়ার দ্বিতীয় কারণটি হল জঙ্গি জামায়াত শিবির। ভবিষ্যতেও সমর্থন পাচ্ছে না এটি হলফ করেই বলা যায়। বিএনপির উচিত জামায়াত শিবিরকে জোট থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া। মানে   জামায়াত ইসলাম মাইনাস ২।

মাইনাস ৩ (জঙ্গিবাদ)

জঙ্গিবাদের সাথে বিএনপির সরাসরি কোনও যোগাযোগ নেই। তবে বিএনপির রাজনীতির দর্শন, চিন্তা চেতনা ও আদর্শের জায়গাতে জঙ্গিবাদের পরোক্ষ সমর্থনের একটি স্থান আছে। জিয়াউর রহমানের সময়ই প্রথম একটি দেশিয় ও আরেকটি পাকিস্তানের সংগঠন বাংলাদেশে প্রথম জঙ্গি মিছিল করেছিল। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির বহুমন্ত্রী, এমপি, মেয়র ও বিএনপির প্যারালাল সরকারের হাওয়া ভবন জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত ছিল। বিএনপি যতই অস্বীকার করুক, বিষয়গুলি দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। বিএনপিকে তওবা করে জঙ্গিবাদের জন্যে দলের ভিতরের জায়গাটুকু ধ্বংস করতে হবে।ফলে জঙ্গিবাদ মাইনাস ৩।

প্লাস ওয়ান (নানান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়)

বিএনপি সব সময়ই ধর্মীয় ও নানা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের প্রতি বিরাগভাজন-পূর্ণ মানসিকতা লালন করে। জিয়াউর রহমানের ধর্মীয় রাজনীতি অনুমোদন, খালেদা জিয়ার প্রথম শাসন আমলে দুই বছরব্যাপী ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ছাত্রদলের সহিংসতা, ২০০১-২০০৬ সালে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর বিএনপি ও জঙ্গি জামায়েত শিবির কর্তৃক মধ্যযুগীয় কাঠামোগত রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক নির্যাতন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

একটি জনগোষ্ঠী কিংবা সংগঠন কেমন সেটি বুঝা যায় জনগোষ্ঠী কিংবা সংগঠনটি সংখ্যালঘুদের কিভাবে মূল্যায়ন করে। বিএনপির জন্মের পর থেকেই সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জন করতে চেষ্টা করেনি। দেশের মোটের প্রায় ১০ শতাংশ ভোট সংখ্যালঘুদের হাতে। তিনশ আসন থেকে বিএনপি প্রতিবারেই পাঁচ থেকে সাতজনকে মনোনয়ন দেয়। প্রসঙ্গত জামায়াত ইসলাম তিন শতাংশ ভোটের জন্য প্রতিবারের গড়পড়তা বিশ জনের উপরে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পায়।

এটি ধারণা করা হয় যে দেশের তিনশত আসনের মধ্যে দশ শতাংশ আসন (প্রায় ত্রিশটি) রয়েছে যেখানে সংখ্যালঘুদের ভোটের সংখ্যা পঞ্চাশ ভাগ। পনের থেকে বিশটি আসন রয়েছে যেখানে ফল নির্ধারণই ভোটার হল সংখ্যালঘু ভোট। বিএনপির এই পরিসংখ্যানটির দিকে নজর দেওয়া উচিত।

এক সময় পশ্চিম বঙ্গের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কংগ্রেসকে ভোট দিতে। এতে বিরোধীদল সিপিএম তাদের প্রতি বিরাগভাজন পূর্ণ হয়ে উঠেনি। সিপিএম সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জন করেছে। দীর্ঘ দুই দশকের উপরে সিপিএম সংখ্যালঘুদের ভোট পেয়ে আসছিল। এখন সেই সংখ্যালঘুদের ভোট পাচ্ছে মমতা ব্যানারজির টিসিএম।

বিএনপি ইচ্ছে করলে পশ্চিম বঙ্গ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। বিএনপির উচিত আওয়ামীলীগের মতো আরেকটি নির্ভরশীল প্রগ্রেসিভ হয়ে সংখ্যালঘুদের আস্থাশীল হওয়া। মানে সংখ্যালঘু প্লাস ১।

কাজগুলি চ্যালেঞ্জিং। তবু বিএনপিকে পরিবর্তনশীল বিশ্বে টিকে থাকতে হলে পরিবর্তন করে; বিকাশ ঘটিয়ে; নিজেকে রূপান্তর করতে হবে। তা না হলে কোডাক কিংবা নকিয়ার ভাগ্য বরণ করতে হবে।