ভাটি অঞ্চলের সিংহপুরুষ সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘর আলো করে তার জন্ম, আমি বলছি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কথা। বাংলাদেশের রাজনীতির নির্মোহ ব্যক্তিত্ব হিসেবে সর্বজনবিদিত। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই ভাটিপুত্র বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম শীর্ষ আসন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের রাজনীতি যখন চরম বৈরি পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত ভ্যানগার্ড হিসেবে আবির্ভূত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি ছিলেন মুজিববাদী রাজনীতির নির্মোহ দার্শনিক।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ছিলেন মুজিব বাহিনীর বীর যোদ্ধা, মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সন্তান হয়েও যুদ্ধ করেছেন আর দশজন সাধারণ যোদ্ধার মতোই, মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষক জেনারেল উবান তার বইতে উল্লেখ করেছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথা। ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও লোভহীন জীবন বেছে নেওয়ার ঘটনা এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে খুবই বিরল, সৈয়দ নজরুলপুত্র আশরাফুল ইসলাম সেই বিরলপ্রাণ রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারিয়েছে একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদকে।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হওয়াতে তিনি শৈশব থেকেই রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকেন, এরপরে কৈশোর পেরোতে না পেরোতেই জড়িয়ে পরেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। তার পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর এবং আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম কাণ্ডারি, সেই সুবাদে তিনি হতে পারতেন ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা, কিন্তু তিনি বেছে নিলেন ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ, কেন্দ্রিয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ছাত্র রাজনীতির গণ্ডি ছাপিয়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের রাজনীতির আলপথের অন্যতম পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্য তিন জাতীয় নেতার সাথে সৈয়দ নজরুল ইসলামকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। পিতার মৃত্যুর পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যুক্তরাজ্যে চলে যান, এবং লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বাঙালি কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সেসময় তিনি লন্ডনের বাংলাদেশ যুবলীগের সদস্য ছিলেন। যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল লেবার পার্টির রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে যান তিনি। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ফেডারেশন অব বাংলাদেশি ইয়ুথ অর্গানাইজেশন (এফবিওয়াইইউ)-এর শিক্ষা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার আহবানে ১৯৯৬ সালে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেই আমলে তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ২০০১ সালেও বিপুল ভোটে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল গ্রেপ্তার হন, সিনিয়র অনেক নেতা যখন 'মাইনাস শেখ হাসিনা ফর্মুলা'র দিকে আগাচ্ছিলেন তখন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই দুর্যোগ মুহূর্ত থেকে আওয়ামী লীগের হারানো শক্তি ফিরিয়ে আনার পেছনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ভূমিকা অনন্য অসাধারণ।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রীসভা গঠিত হলে তিনি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পুনরায় স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৫ সালের ৯ জুলাই তার অসুস্থতাজনিত কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করেন। এক মাস এক সপ্তাহ দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকার পর ১৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নিজের অধীনে রাখা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন তাকে। শারীরিক অসুস্থতা ও স্ত্রী শীলা ঠাকুরের অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন গণমাধ্যম ও লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেছেন তিনি। গতবছর ২৩ অক্টোবর লন্ডনে চিকিৎসাধীন শীলা ঠাকুর মৃত্যুবরণ করলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভেঙে পড়েন, স্ত্রীর মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার মতো শক্তি তিনি অর্জন করতে পারেননি। ক্রমান্বয়েই গুরুতরভাবে অসুস্থ হতে থাকেন তিনি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন নির্বাচনী এলাকায় অনুপস্থিত থেকেও। ব্যাংককের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শপথ নেওয়ার পূর্বেই মারা যান।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে সন্দেহ নেই তার চরম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষেরও। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার দায়িত্বপালনকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিলো অন্য যেকোনও সময়ের থেকেও কঠিন পর্যায়ে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দৃঢ়তায় ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বিচক্ষণতায় বাংলাদেশ সেই বৈরি পরিবেশ কাটিয়ে ওঠে।
২০১৩ সালের ৫ মে এর ছোট একটি ঘটনার উদাহরণ না দিয়ে পারছি না, যখন হেফাজতে ইসলামীদের নগ্ন উল্লাসে রাজধানী ঢাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময়েই রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সেই সন্ধ্যায় তিনি ছিলেন সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক, তিনি সচরাচর লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন এবং কালেভদ্রে লোকালয়ে অথবা মিডিয়ার সামনে আসেন, তিনি একটা সংবাদ সম্মেলন করলেন। সারাদিন ধরে চলা নগ্ন সাদা ঝড়ের তাণ্ডবের আঘাতে তার আশ-পাশের মানুষগুলোর মুখমণ্ডল তখন শুকনো দেখাচ্ছিল আর তাদের শরীর দেখাচ্ছিল ক্লান্ত। অবসন্ন এবং ক্লান্ত মুখমণ্ডল পরিবেষ্টিত হওয়া সত্ত্বেও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দেখাচ্ছিল অন্যরকমের প্রাণবন্ত। গলায় ছিলো তার সূর্যের মতো তেজ; উপস্থিত সাংবাদিকদের মাধ্যমে সংক্ষেপে তিনি বললেন, 'আমাদের সরলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না। রাতের মধ্যেই আপনারা ঘরে ফিরে যাবেন এবং ভবিষ্যতে আপনাদেরকে আর ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হবে না।' মদিরার মতো কাজ করেছিলো তার এই বাক্যবাণ। স্মরণকালের সফল সেই নিরস্ত্র অপারেশনে হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা ফিরে যেতে বাধ্য হয় রাজধানী ছেড়ে।
এটাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। তাছাড়া তার লোভহীন জীবনের কথা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত জানেন। অর্থ সংকটে থাকা শীর্ষ রাজনীতিবিদ এই উপমহাদেশে তেমন একটা খুঁজে না পাওয়া গেলেও একবিংশ শতাব্দীর এই বাংলাদেশে তাকে আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মধ্যে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ব্যক্তিত্ব ছিলো আকাশসম। কূটনৈতিক বিশ্বে প্রবল প্রভাব নিয়ে রাজ করা রাজনীতিবিদ তিনি। প্রতিনিয়ত তিনি পড়াশুনা করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে। রাতজেগে পড়াশুনা করার কারণে তার এই রাতজাগা নিয়ে সুযোগসন্ধানীরা বিভিন্ন গুজব ছড়িয়েও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জনপ্রিয়তায় সামান্য পরিমাণে ধস নামাতে পারেনি।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভারত উপমহাদেশের বিরলপ্রাণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি মুজিববাদী রাজনৈতিক দর্শনকে ধারণ করেন সর্বাঙ্গে। ব্যক্তিগতভাবে আমি তার অপার স্নেহ পেয়েছি, এটা আমার সারাজীবনের অর্জন। মানুষকে ভালোবাসার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন তিনি, তার প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। অন্য আলোয় ভালো থাকুন আশরাফ ভাই।