জয় বাংলা ও বিলুপ্তির পথে বিএনপি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 1 Jan 2019, 12:41 PM
Updated : 1 Jan 2019, 12:41 PM
নির্বাচন শেষ। ভোটের ফলাফলও এখন আমাদের জানা। টানা তিনবার দেশ শাসনে এসেছে শেখ হাসিনার সরকার। আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই দুটো ধারা। একটি জয়ী- যারা বলবেন নির্বাচন সফল ও সার্থক। আর একধারা যাই হোক বলবে, ঠিক হয়নি। বর্জন করলাম।
ধরুন যদি ঐক্যফ্রন্ট ১৫০টি আসন পেত তারা কী বলতেন নির্বাচন সঠিক হয়েছে? বলতেন না। যে পর্যন্ত না তারা ১৫১  আসন অর্থাৎ সরকার গঠনে সহায়ক ততক্ষণ তা সফল না। গেল বছরের বড় ঘটনা ছিল ঐক্যফ্রন্টের আগমন। কী অবস্থায় কেন তা গঠিত হয়েছিল তা সবার জানা। জাতিকে অবাক করে দিয়ে বলতে গেলে চমকে দিয়ে  আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা ড. কামাল হোসেনের আগমন ও নেতৃত্ব নেওয়ায় নড়েচড়ে বসেছিল মানুষ। কিন্তু যাহা বায়ান্ন তাহাই তিপান্ন।
কামাল হোসেনের সাথে এসে জুটলো ছাত্রলীগের নেতা একাত্তরে ভূমিকা রাখা আ স ম রব, দল খেদানো নেতা সুবিধাবাদী মান্না, বঙ্গবীর থেকে বিড়ালে পরিণত  হওয়া কাদের সিদ্দিকী। এদের বদ্ধমূল ধারণা জাতি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা নামলেই সবকিছু পাল্টে যাবে। যা মূলত দিবাস্বপ্ন এখন। সেটাই প্রমাণ হলো ফলাফলে।
সবচাইতে সুবিধাবাদী অবস্থানে ছিল বিএনপি। আমি এখনো মনে করি বিরোধী দল মানে বিএনপি। কারণ এটি কোনও দল না এটি একটি 'ককটেল পার্টি'। যার ভেতর এক চামচ মুক্তিযুদ্ধ, এক চিমটি জাতীয়তাবাদ আর বেশির ভাগ বিকৃতি ও পাকি ভাবধারা। এই ককটেল মানুষকে বেশকিছু সময় গেলানো হয়েছিল। যে সময় তার নেশা ছিল সে সময় আমাদের যৌবনকাল।
মনে আছে 'হাঁ', 'না' ভোটের কথা। দুটো বাক্স রেখে ভোটারদের হাতে ভোটের কাগজ ধরিয়ে দেওয়া পুলিশ নজর রাখছিলো কোন বাক্সে তা ফেলা হচ্ছে। হিসেব এমন গোলমেলে যে একশ'র ভেতর একশ আট পার্সেন্ট ভোট পেয়ে গেছিলেন জেনারেল। আমরা তা ভুলিনি। ভুলিনি ধানের শীষে ভোট পড়বে জানার পর ও দুপুরের ভেতর বিরোধী আওয়ামী লীগের প্রচারের তাঁবু উপড়ে ফেলে লাঠিসোটা নিয়ে তাদের বের করে দেওয়া। তাই এরা যখন ধোঁওয়া তুলসী পাতা সাজার চেষ্টা করে তখন আমাদের করুণা হয়।
এবারের নির্বাচনী ফলাফলে আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয় মানতে নারাজ ঐক্যফ্রন্ট। তাদের বিজয়ী প্রার্থীরা নাকি শপথ নেবেন না। সেটা তাদের ব্যাপার। নিলে ভালো। না নিলে দেশের বা জনগণের কি আসলে কিছু  আসবে যাবে? তাদের কোন প্রার্থির কী লাভ লোকসান জানিনা, তবে এটা নিশ্চিত নিশ্চিহ্ণ হবার পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে বিএনপি।
বিএনপির ধানের শীষকে পুঁজি করে যারা এমপি হতে চেয়েছিল তাদের ব্যর্থতা কি বিএনপি বহন করবে ? সরকারী দল হিসেবে আবির্ভূত বিএনপি কখনোই এমন বিপদ বা পরিবেশ মোকাবেলা করেনি। তাদের শুরু থেকে রমরমা সময় মানে গদিতে থেকে ছড়ি ঘোরানো। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বরবারই মাঠের দল। আমরা যৌবন থেকে যৌবনের শেষ পর্যন্ত দেখেছি এদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম বলাও ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ। শোক দিবসের বিশাল মিছিল আর চার জাতীয় নেতার জেলখানা হত্যা দিবসকে সামনে রেখে মানুষকে বরাবর একতাবদ্ধ করা আওয়ামী লীগের শক্তি কখনোই শেষ হয়ে যায় নি।
এ বাস্তবতাকে পায়ে দলে পনের অগাস্ট ভূয়া জন্মদিন পালন আর দিনের পর দিন রক্তমাখা কেক কাটার পাপ কী ছেড়ে কথা বলবে? ছেড়ে কথা বলবে হাওয়া ভবনের বদ হাওয়া? বলা নাই, কওয়া নাই হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা যুবরাজের গোপন রাজনৈতিক দল তখন আসল বিএনপিকে শেষ করে আনছিল। যার প্রমাণ ওয়ান ইলেভেন। সে সময় আওয়ামী লীগও ছিল বিপাকে। অথচ তারাই উঠে এলো। আর তলিয়ে গেল বিএনপির ভবিষ্যত।
এগুলো না ভেবে একের পর এক ভুল সিদ্বান্ত আর প্রতিশোধের রাজনীতি বিএনপিকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে । যার প্রমাণ এবারের নির্বাচন। ধরে নিলাম অতি উৎসাহী আর ক্যাডারেরা কোথাও কোথাও বাড়াবাড়ি করেছে। ভোট হয়তো যেভাবে হবার কথা হয়নি। তার মানে কি এই আপনারা আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট েকজন প্রার্থীকেও হারাতে পারতেন? পারতেন কি মাশরাফী , মমতাজ, তন্ময় বা জনের মতো নতুন মুখদের হারাতে? এটাই শেখ হাসিনার রাজনীতি।
শেখ হাসিনা সময় মতো এমন সব চমক উপহার দেন যা মানুষকে মুগ্ধ করে। তিনি যখন মাশরাফির ব্যাপারে সিদ্বান্ত নিলেন তখন সুশীলদের অনেকেই চোখ বাঁকা করে বলেছিলেন, অধিনায়ককে বিতর্কিত করার চেষ্টা কেন? চোখ খুলে দেখুন দেশে দেশে এমন ক্রিকেট তারকারা কিভাবে রাজনীতিতে এসেছেন। শ্রীলংকার বিশ্বকাপ জেতা অধিনায়ক অর্জুনা রাণাতুঙ্গা মন্ত্রী। মন্ত্রী পান্জাবের ক্রিকেটের সিধু। আজহার উদ্দিনের মতো খেলোয়াড়ও ভোট করেছিলেন। ভোটে আসা মানে কি অধিনায়কত্বকে অপমান করা? আর যারা স্বার্থের জন্য এসব বলেন তারা নিজেদের দিকে তাকায় না। তাকালে দেখতে পেত তাদের টিকেটে নির্বাচন করেছে গায়িকা কনকচাঁপা। তার বেলায় চুপ থাকা আর বিরোধীদের সমালোচনা মূলত ছোট মনের পরিচয়।
তাছাড়া মুখে বলছি গুণগত পরিবর্তন দরকার আর কাজে তা চাইনা। চাইলে এই বিষয় নিয়ে তর্ক করতাম না। আজকাল মানুষ বিশেষ তারুণ্য রাজনীতি বিমুখ। তাদের চোখের সামনে বয়সী নেতাদের ভাঁড়ামো আর গন্ধময় অতীত। সে জায়গা থেকে তারুণ্যকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে এদের নিয়ে আসার বিকল্প নাই। শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা আর মেধা এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। তিনি জানেন নতুন মুখ ছাড়া দেশ এগোবেনা।
আর একটা কথা এই যে তার সহিষ্ণুতা তারও মূল্য আছে। সবাই জানেন আওয়ামী লীগের সাবেক সচিব বা সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল সংস্কারপন্হি হিসেবে শেষ সময় দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। যা বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার বেলায়ও হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা তা মনে ধরে রাখেননি। রাখেননি বলেই জলিল পুত্র জনকে মনোনয়ন দিয়ে এবার এমপি করে এনেছেন। এর মূল্য বিএনপি না বুঝলেও মানুষ দিয়েছে।
এসব কারণে পরাজিত  হয়ে ধস নামার পরও বিএনপি তা মানতে চায় না। সরকার পতনের জন্য একটা বড় দল যাকে খুশি তাকে দলে নেবে আর মানুষ তা মেনে নেবে? হয়তো বি চৌধুরীর প্রশ্ন তুলবেন অনেকে। সেটাও সত্য। কিন্তু তারা এসেছেন পরিস্হিতির চাপে। আর তাদের নেওয়ার কারণও ছিল উদ্ভুত পরিবেশ। তাছাড়া যারা আছেন তারা আগে থেকেই মহাজোটের পার্টনার। মানুষ এটাকেও নিশ্চয় ই মাথায় রেখেছিল। সব মিলিয়ে বিএনপির নির্বাচনী কৌশল ছিল ভুলে ভরা। প্রধানমন্ত্রী ফলাফলের পর যে মতামত দিয়েছেন তাও প্রণিধানযোগ্য। আসলেই তো কেউ জানতো না ঐক্যফ্রন্ট জিতলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী। তাদের মুখপাত্র বা মূল নেতা কামাল হোসেন নিজেই ঝুঁকি নেননি। ভোটে দাঁড়াননি। হয়তো প্ল্যান ছিল জিতলে তিনি হবেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু সরকার চালাবে কে ? সেখানে একজন বিকল্প কী আসলেই আছে না ছিল?
শেখ হাসিনা এখন এমন এক উচ্চতায় যে জায়গায় তাকে মোকাবেলা করা সহজ না। দেশের বাইরে তার ব্যাপ্তি আরো বিশাল। একটি দেশে কর্মযজ্ঞ কী এত সহজ না বাংলাদেশের মত দেশকে রাতারাতি উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করা সম্ভব? এ কাজ হয়েছে বিগত এক দশকে। সে ধারাবাহিকতায় মানুষ খেয়ে পরে আনন্দে আছে। তারা কেন ভাগ্য নিয়ে জুয়া খেলতে রাজি হবে?
ফলে বিএনপির ভবিষ্যত আসলে কী সেটাই এখন দেখার বিষয়। তাদের বিভিন্ন নেতাদের ফোনালাপে শোনা গেছে অসহায় ব্যর্থ নেতাদের হাহাকার। মওদুদের মতো বয়সী অভিজ্ঞ নেতা বলছেন মহাসচিব নাকি তার ফোন ধরেন না। কেন ধরেন না? কারণ তিনি ভোট বানচাল করতে চান। নিজে জিতবে না জেনে বাকীদের নিয়ে পাশা খেলার ফাঁদে পা দেননি মির্জা ফখরুল। সে কারণে তিনি নিজে জিতেছেন। এখন দেখার বিষয় এই শেষ সুযোগ কিভাবে কাজে লাগান তারা। দেশের ডোনার বা দলের পেছনে থাকা সহায়তাকারীরা কী আগের মতো থাকবেন? রাজনীতি থেকে নীতি অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। এখন দেয়া-নেয়ার দিন। যেখানে নেয়ার চান্স কম বা নাই সেখানে শুধু দিতে আসবে কেউ? কেন আসবে? বিএনপির আদর্শ কী? খালি জিয়ার নাম বিক্রি করে আর খাল কাটার গল্প করে আর কতদিন? কতদিন সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্প।
বদলে যাওয়া দুনিবায় গণতন্ত্র ই একমাত্র ব্যবস্হা যা দিয়ে বিশ্ব চলছে। চাই বা না চাই বাংলাদেশ সে পথেই থাকবে। এখানে বিএনপির মাতবরীর দরকার পড়েনা। ধরে নিতে পারি হতাশ আর পিছিয়ে পড়া বিএনপি এখন আস্তে আস্তে নাই বা সংখ্যালঘু দলে পরিণত হতে বাধ্য। যুবক-যুবতীদের ভেতর জিয়া এখন অদৃশ্য এক ইমেজ। জেনারেল ইমেজ দিয়ে আর যাইহোক ডিজিটাল বিশ্বে নেতা হওয়া যায়না।
বিএনপির আরেক বিষফোঁড়া তাদের লন্ডনে পলাতক তারেক জিয়া। ইনি সেখানে বসে ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কী করেন জানা যায় না। ষড়যন্ত্র ও সব নিম্মমানের। হত্যা রক্তপাত আর সরকার হটানোর নামে নৈরাজ্য বা জঙ্গিবাদ মানুষ আর নেবেনা। সেগুলো সফলতার সাথে ব্যর্থ করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। তাকে কেউ টলাতে পারেনি। হিলারি ক্লিনটন বা আমেরিকান কর্তা কেরির ফোনেও একচুল নড়েননি তিনি।সেখানে এই পচা শামুক কী করবে?
পথ একটাই। সুষ্ঠু ও সঠিক পথে ফিরে আসা। মনে এক বাইরে এক এই নীতি চলবে না। জামায়াত একসময় তাদের ভোট এনে দিত। এটা সত্য যে জামায়াত ছাড়া বিএনপি জিততে পারতোনা। আজ আর সে বাস্তবতা নাই। এখন জামায়াতের ঘোর অন্ধকার সময়। তাদের আস্ফালন বা ক্যাডারের গল্পও শেষ। তাদেরও উচিত অন্যভাবে নিজেদের আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নিজেদের ন্যাক্কারজনক ভূমিকার জন্য মাফ চেয়ে কিছু করা। নয়তো তাদের ধিক্কারের ভেতরই থাকতে হবে আজীবন। আর বিএনপি? পরের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি করার দিন শেষ। মনে হচ্ছে এই শেষ সুযোগ। জিয়া পরিবারকে বাইরে রেখে আসতে না পারলে তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। বিলুপ্তির পথে বিএনপি কে কে বাঁচাবে। কেউ কি পারবে তুলে আনতে?
সামনে বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা আরও এগিয়ে নিয়ে দেশ ও জাতিকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবেন যেখান থেকে হয়তো ফেরার চেষ্টাও করবে না কেউ। তাই যেন হয়। কারণ রাজনীতির মূল বিষয় মানুষ। সে মানুষ যদি ভালো থাকে অসাম্প্রদায়িক দেশ বা সমাজে থাকে তাহলে তার কাছে রাজনীতি একটি নিয়ম ছাড়া আর কিছুই না। এটাই সভ্য দেশের পরিচয়। সে দিকেই ধাবিত হোক বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনসহ সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গণাদের আত্মত্যাগের এই মাটি  কতটা শক্তি রাখে সে প্রমাণই মিললো আরেকবার। তবু অন্ধরা চোখে দেখেনা।