ঐক্যফ্রন্টের কেন ধারণা হলো জাল ভোট ছাড়া আওয়ামী লীগ জেতে না!

সুলতান মির্জা
Published : 29 Dec 2018, 01:28 PM
Updated : 29 Dec 2018, 01:28 PM

দেখুন, আমাদের দুর্ভাগ্য বলা যায়, এরশাদ পতনের পরে গণতন্ত্রের যাত্রার ১৯৯১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত সকল নির্বাচনের নির্মোহ গবেষণাভিত্তিক জয় পরাজয়ের কোনও আর্টিকেল আমাদের এইখানে নেই। যদি থাকত, তাহলে অবশ্যই বুঝে নেওয়া যেত ১৯৯১ সালের নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অথবা ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির জয়গুলোতে কেমন ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপস্থিতি ছিল। এর মানে মোটেও এটা বলছি না, বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করার মতো জনপ্রিয়তা রাখে না, তবে বিএনপির জয়লাভের দু্ইটা নির্বাচন ঘেঁটে দেখলে ওই সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করলে যা দাঁড়ায়, তা হলো একটা নির্বাচনেও সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক লেবেল প্লেয়িং নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসেনি। কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, ভোট কেন্দ্রে না যেতে ভোটারদের হুমকি এইসব মাঠের কৌশল অত:পর এভারেজ প্রশাসনিক ইঞ্জিনিয়ারিং দিয়েই বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে।

কাজেই সে থেকেই বিএনপির এ ধারণা যে ক্ষমতায় যাওয়া মানেই জাল ভোট কেন্দ্র দখল হাবিজাবি করা ছাড়া সম্ভব নয়। এইজন্য যে বিএনপি নিজেও জানে এইসব করা ছাড়া কোনওভাবেই ক্ষমতায় আসার মত ক্ষমতা রাখে না।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায়নটা দেখেন, ১৯৯৬ সালে ১২ জুন আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসাটা খুব মসৃণ ছিল তা বলা যাবে না, এক প্রকার টেনে-হিঁচড়েই বলা যায়। কারণ সেইবার সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগের দরকার হয়েছিল দ্বিতীয় পার্টির সমর্থন।

যদিও আ স ম রব নিজে থেকেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে বসেছিল এক আসন নিয়ে। তারপরে জাতীয় পার্টি সমর্থন দিলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। অত:পর ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের জন্য মোটেও মিরাকল ছিল না, এই জন্য যে ২০০১-২০০৬ সময়ে খালেদা নিজামী সরকারের অপশাসনের অভিশাপ প্রতিফলিত হয়েছে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্স বিজয়। এই ক্ষেত্রে নির্বাচনী পরিবেশ লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড সবকিছুই ছিল একেবারেই মসৃণ। হ্যাঁ, ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে এইক্ষেত্রে যেহেতু নতুন কিছুমাত্রা যোগ হওয়া নির্বাচন ছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, সেহেতু সেই নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত অংশ না নিয়ে ভুল করেছে। তবে দেশের ওই সময়ের সামগ্রিক পরিস্থিতি যা ছিল আওয়ামী লীগ অবশ্যই জয়লাভ করতো তবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো।

এবারের ২০১৮ সালের নির্বাচন, প্ল্যান যা করেছে তার পুরোটাই করেছে বিএনপি-জামায়াত-কামালের ঐক্যফ্রন্ট। কৌশলের নামে অপকৌশল নানান অভিযোগ যা করেছে তা বিএনপি-জামায়াত-কামালের ঐক্যফ্রন্ট। এমনকি নির্বাচনী প্রচারেও পজেটিভ নেগেটিভ যাই বলেন, সবটাই সফলভাবে করেছে বিএনপি-জামায়াত-কামালের ঐক্যফ্রন্ট। তবে কথা আছে বা অনেকেই তুলছে এবং তুলবে তাহলো নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নামের এনজিও সৃষ্ট পশ্চিমা শব্দ সেটা তৈরি হয়েছে কি না…

কথা হলো, নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড কেন হওয়ার কথা ছিল ? কার সাথে কার লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড ? যেখানে টোটাল নির্বাচনের সাথে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাদের দায়ে আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো একটি দলকে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বিএনপি কামালের ঐক্যফ্রন্ট, সেখানে কিসের লেবেল প্লেয়িং? যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এবং দণ্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ অপরাধীদের সন্তানদের সাথে নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং কোনও কারণে? বাংলাদেশে ২০০১-২০০৬ সময়ে নানান অপরাধে অপরাধী বিশেষ করে ২১ অগাস্টের মতো ঘটনা ঘটিয়ে বিরোধী দলকে ফিনিস করে দেওয়ার মন মানসিকতা ধারণ করা ব্যক্তিদের সাথে লেবেল প্লেয়িং কেন ? সারাদেশে ২০০১-২০০৬ সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মা বোনদের ধর্ষণ করা ধর্ষকদের সাথে কিসের লেবেল প্লেয়িং ? কোন দেশে কোন অংকে খুঁজলে পাওয়া যাবে ধর্ষিতা আর ধর্ষকের জন্য লেবেল প্লেয়িং হয়…

২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালের পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে যাওয়া নিহতদের পরিবার কিংবা যারা বাকি জীবনের জন্য অক্ষম হয়ে যাওয়া মানুষটি লেবেল প্লেয়িং খেলবে পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে মারা দল-গোষ্ঠি, ইন্ধনদাতা, নির্দেশ দাতা ব্যক্তির সাথে…! কেন ?

এইসব 'কেন' এর উত্তর হয়তো কারও কারও কাছে আছে, কারও কাছে নেই, তবে দু:খজনক ঘটনা হলো আমাদের স্মৃতিশক্তি এতোই নিম্নমানের যে, কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া সহিংসতাকে আমরা নিতান্তই কিছু সুযোগ সুবিধার জন্য ধামাচাপা দিয়ে দিতে চাই। হয়তো কারও কারও মনে এমন যে, এই ধামাচাপায় শান্তি আসলে ক্ষতি কী। কিন্তু দু:খজনক ব্যাপার হলো এতে শান্তি আসে না, অন্যায় কে প্রশ্রয় দেওয়া হয়।

যাইহোক, ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংস্থা নির্বাচনী জরিপ বাজারে ছেড়েছে, যেখানে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট আবারও ক্ষমতায় আসবে। যদিও জরিপে আমি বিশ্বাসী নই। তারপরও বলতে হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত-কামালের ঐক্যফ্রন্টকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠাবে এর পক্ষে যৌক্তিক কোনও লজিক খুঁজে পাই না। কেন ভোট দিবে? কিসের জন্য ভোট দিবে? এরা ক্ষমতায় এলে কী করবে? এই বাংলাদেশের ধার এবং ভাড় বহন করে দেশ পরিচালনা করার মতো যোগ্যতা বিএনপি-জামায়াত-কামালের ঐক্যফ্রন্টের আছে কি না ? প্রতিটা সচেতন ভোটার অবশ্যই এইসব ভাবছে বলেই বিশ্বাস করি।

শেষ কথা হলো, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক মানুষের সাথেই কথা বলেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি সেটা হলো আওয়ামী লীগের গত ১০ বছরের শাসনামলে ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যই আছে, তবে রাজনীতি  বিবেচনায় আওয়ামী লীগ কিন্তু ব্যর্থ নয়। সেটা যেকোনও উন্নয়ন ও ইতিবাচক পরিবর্তনের মাপকাঠিতেই।

মোদ্দা কথা দেশকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা ছাড়া বিকল্প কেউ এই বাংলাদেশে নাই।