আমরা বললেই ‘খামোশ’, বিদেশিরা বললে ‘আগে জানলে…’

কবির য়াহমদ
Published : 28 Dec 2018, 02:30 PM
Updated : 28 Dec 2018, 02:30 PM

নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন তার নেতৃত্বাধীন জোটে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন। তার এই স্বীকারোক্তির জন্য দেশের সাংবাদিকেরা বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেও বিদেশি মিডিয়ায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেটা স্বীকার করেছেন তিনি। বলেছেন, 'জানতেন না তিনি'। তার দাবি, 'যদি জানতাম জামায়াত নেতারা বিএনপির প্রতীকে নির্বাচন করবেন তাহলে আমি এতে যোগ দিতাম না'।

বৃহস্পতিবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন আরও বলেছেন, 'জামায়াত নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া বোকামি। আমি লিখিত দিয়েছি জামায়াতকে কোনও সমর্থন দেওয়া এবং ধর্ম, চরমপন্থা ও মৌলবাদকে সামনে আনা যাবে না'।

নির্বাচন পরবর্তী তার অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেছেন, '…কিন্তু ভবিষ্যৎ সরকারে জামায়াতের যদি কোনও অবস্থান থাকে তাহলে আমি তাদের (বিএনপি-জামায়াত) সঙ্গে একদিনও থাকব না'।

এই বক্তব্য তার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে জামায়াতের অবস্থান সম্পর্কিত স্বীকারোক্তি বিশেষ।

তবে এই স্বীকারোক্তি এমনি এমনি আসেনি, বলা যায় এসেছে অনেকটা বাধ্য হয়েই। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থায় প্রতিবেশি দেশের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যাপক প্রভাববিস্তারী। এ প্রভাবকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রতিবেশি ভারত সরকার শুরু থেকেই সমর্থন ও সহযোগিতা করে আসছে। দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অধিকাংশ দল বর্জন করলে প্রাথমিক পর্যায়ে বৈশ্বিক সমালোচনার যে ঘটনা ঘটেছিল, সেটা ভারতের শক্ত সমর্থনে আওয়ামী লীগ সরকার সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিল। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় ভারত এই অঞ্চলের শক্তিশালী অবস্থানে থাকায় তাদের সমর্থন ও সহযোগিতার দরকার হয়, যা আওয়ামী লীগ সরকার পেয়ে আসছে।

অপরদিকে ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির যোগাযোগ ও সম্পর্ক অতিমাত্রায় দুর্বল হওয়ার প্রেক্ষাপটে কামাল হোসেনকে তাই এখনকার পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

এক্ষেত্রে তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে জামায়াতের দৃশ্যমান অবস্থানকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না তার; তিনি বাধ্য হয়েছেন সেটা স্বীকারে। তবে আগামীর পথ উন্মুক্ত করে রাখতে তিনি এও জুড়ে দিচ্ছেন- 'ভবিষ্যৎ সরকারে জামায়াতের যদি কোনও অবস্থান থাকে তাহলে আমি তাদের সঙ্গে একদিনও থাকব না'। এমন কথা, যা তার পক্ষে করা সম্ভব হবে না।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক কামাল হোসেন হলেও সরকারবিরোধী এই জোটের চালিকাশক্তি বিএনপি। তাকে সামনে রেখে ফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কার্যত জোট পরিচালনা করছেন। সিদ্ধান্তের জানান দিতে মিডিয়ার সামনে আসছেন কামাল হোসেন। তার মুখ দিয়ে সিদ্ধান্তসূচক কথাগুলো বের হলেও সেটা আদতে বিএনপিরই সিদ্ধান্ত। আসন ভাগাভাগি, প্রতীক বরাদ্দের চিঠি থেকে শুরু করে সকল কিছুই হয়েছে বিএনপির সিদ্ধান্তে। শুরুতে শতাধিক আসন দাবি করলেও বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোকে মাত্র ১৯ আসন দিলে সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে ড. কামালকে।

এরমধ্যে আবার কামাল হোসেনের দল গণফোরামের জন্যে বরাদ্দ মাত্র ৭ আসন। এত কম সংখ্যক আসন নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকলেও শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট ও গণফোরামকে সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ঐক্যফ্রন্টের মূল নেতা হয়েও তাকে প্রধান শরিক বিএনপির সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নামে নির্বাচনে গেলে, প্রচারণা চালিয়েও এ জোটকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছে বিএনপি তারচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারানো স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীকে। যুদ্ধাপরাধী ওই দলকে ২২ আসন দেওয়ার পাশাপাশি আরও কয়েকটি আসনে স্বতন্ত্র হিসেবেও সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। এখানে কামাল হোসেনের  প্রভাব ছিল সামান্যই, অথবা এও বলা যায় কোনো প্রভাবই ছিল না।

এমনকি এ সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তার ন্যূনতম মতামত নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেনি তারা। ফলে জামায়াত প্রশ্নে বারবার বিব্রত হয়েছেন কামাল হোসেন, অস্বীকারও করেছেন অনেকবার। প্রশ্নকারী সাংবাদিকদের 'চুপ', 'খামোশ'-এর মতো শব্দ ব্যবহারে মুখ বন্ধ করাতে চেয়েছিলেন। রাগে-ক্ষোভে প্রশ্নকারী সাংবাদিকদের 'দেখে নেওয়ার' হুমকিও দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে তিনি তার সেই আচরণের জন্যে দু:খপ্রকাশও করেছিলেন।

ড. কামাল হোসেন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। সপ্তম সংসদ নির্বাচনের পর তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে গণফোরাম নামের এক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ২৬ বছর ধরে তিনি এ দলের সভাপতি। তার দাবি তিনি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম করেছেন, এবং দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্যে তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন। নেতৃত্বের প্রশ্নে নিজ দলে আড়াই দশকের বেশি সময় ধরে গণতন্ত্রের চর্চা না করলেও গণতন্ত্রের জন্যে তার এই সংগ্রাম যে কারও কাছে ইতিবাচক বলে মনে হতে পারে, এটাকে ইতিবাচক বলাও যায়। তবে এবারের তার সেই সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসেবে তিনি যখন জামায়াতের মতো গণধিকৃত দলকে সহযাত্রী করেছেন তখন তার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা যায়। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী সকল পর্যায় থেকে ধিকৃত ও নির্বাসিত। ইসি থেকে নিবন্ধন হারানোর পর দলটির নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ যেখানে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল সেখানে তাদের আদর্শিক মিত্র বিএনপির প্রতীকে ঐক্যফ্রন্টের নামে তারা ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হয়েছে। এটা জামায়াতের পুনর্বাসনের সবচেয়ে বড় পন্থা হতে যাচ্ছে। অথচ শুরুতে এর বিরুদ্ধে কার্যকর অবস্থান নিলে জামায়াত প্রার্থীদের বিএনপির মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু ড. কামাল হোসেন সেটা করেন নি। তার সামনে দিয়ে জামায়াত নেতারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেও তিনি চোখ-মুখ বন্ধ রেখেছেন। কেউ তার কানে সেই কথাগুলো তুললেও তাদেরকে প্রবল আক্রোশে 'চুপ, খামোশ, জেনে রাখব, চিনে রাখব'- বলে শাসিয়েছেন।

জামায়াত প্রশ্নে তার এ ভূমিকায় কী সত্যকে চাপা দেওয়া সম্ভব হয়েছে? হয় নি! দেশের সাংবাদিকেরা একের পর এক প্রশ্ন করে তার ক্রোধান্বিত রূপ দেখলেও বিদেশের মিডিয়ার কাছে সেই ক্রোধ দেখাতে পারেননি তিনি। স্বীকার করেছেন সেটা এবং এখানে স্বীকার শেষে বলছেন ভবিষ্যতে জামায়াতকে অংশীদার করলে থাকবেন না তিনি। তার এই না থাকার বিষয়টি আদতে বিশ্বাসযোগ্য হয় না যখন সাক্ষাৎকার শেষেও তিনি জামায়াতের ২২ নেতাসহ সকল প্রার্থীর জন্যে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট চান।

দুর্নীতির মামলায় কারাগারে থাকা খালেদা জিয়া, দুর্নীতি ও একুশ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার মামলার দণ্ড নিয়ে লন্ডনে পলাতক থাকা তারেক রহমানের কারণে ভাবমূর্তি সঙ্কটে থাকা বিএনপির দরকার ছিল দেশেবিদেশে খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের চাইতে গ্রহণযোগ্য কাউকে সামনে নিয়ে আসা। ড. কামাল হোসেন বিএনপির চাওয়ার সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছেন। ।

জামায়াত নেতাদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসনে মনোনয়ন দেওয়াসহ নির্বাচন বিষয়ক সকল সিদ্ধান্তে বিএনপি যেখানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও কামাল হোসেনের মতামতকে গুরুত্ব দেয়নি সেখানে নির্বাচনে তারা বিজয়ী হলে তার মতামতকে গুরুত্ব দেবে বলে মনে হয় না। তবে শেষ মুহূর্তে হলেও এই সময়ে এসেও জামায়াত প্রশ্নে তিনি ঋজু হয়ে দাঁড়াতে পারতেন, জামায়াতবিরোধী তার অবস্থানকে পরিষ্কার করতে পারতেন- কিন্তু সেটা করেননি। উলটো অন্য সকলের মত জামায়াত নেতাদের জন্যেও ভোট চাইছেন।

দেশের সাংবাদিকেরা জামায়াত প্রশ্নে ড. কামাল হোসেনের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেলেও বিদেশি সাংবাদিকেরা এ সম্পর্কিত স্বীকারোক্তি পেয়েছেন। আর এর মাধ্যমে জামায়াতের রাজনৈতিক পুনর্বাসনে তার ভূমিকাও স্বীকৃত হলো। আগামীর ইতিহাসে যখনই জামায়াতের পুনর্বাসনের বিষয় আসবে তখন জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়ার সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের নামও উচ্চারিত হবে। এ উচ্চারণে দায় স্বীকার-অস্বীকারের প্রশ্ন অবান্তর; এ যে ইতিহাসেরই লিখন!