নির্বাচন: তারুণ্যের আক্ষেপ, তারুণ্যের প্রত্যাশা

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী
Published : 27 Dec 2018, 03:24 PM
Updated : 27 Dec 2018, 03:24 PM

সময় এখন বাংলাদেশের। সময় এখন তারুণ্যের। এই সময় শুধু নয়, ভবিষ্যতের সময়ও তারুণ্যের। ভবিষ্যতের বাংলাদেশও তরুণদের জন্যই। আর তারুণ্যের উপযোগী বর্তমান বিনির্মাণ করা গেলেই কেবল- ভবিষ্যত হবে বাংলাদেশের।

নির্বাচন আসন্ন। এবারের নির্বাচনে ১০ কোটি ৪২ লাখ ভোটারের মধ্যে সোয়া দুই কোটি নতুন ভোটার। গত দশ বছরে হওয়া ভোটারের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে এ সংখ্যা আরো বেশি। গড় হিসেবে মোট ভোটারদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। শুধু ভোটার সংখ্যার বিবেচনায় নয়, জনসংখ্যার হিসেবেও বাংলাদেশের জনগোষ্ঠির সিংহভাগই এখন শিশু-কিশোর-তরুণরাই। এ সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। কাজেই নির্বাচনকে সামনে রেখে অংশগ্রহণকারী সব দলেরই বিবেচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে তরুণরা। প্রাধান্য দেয়াটা শুধু নির্বাচনী বৈতরণী পেরোনোর জন্য হলে চলবে না। পরিপূর্ণ সদিচ্ছার সাথে জানতে হবে তারুণ্যের হতাশা কী এবং প্রত্যাশা কোথায়। নিতে হবে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা এবং উদ্যোগী হতে হবে বাস্তবায়নে।

এখন দেশজুড়ে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা। প্রচারণার সনাতনী পদ্ধতিতে মিছিল-উঠান বৈঠক চলছে পাড়া-মহল্লায় ও রাজপথে। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে দলগুলো প্রচারণায় সরব এবার। যা বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে নতুন সংযোজন। সময়ের চাহিদা এবং তারুণ্যের পছন্দের কথা মাথায় রেখেই এই কৌশল নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। পাশাপাশি এটাও বিবেচনায় নিতে হবে যে, প্রচারণার সময় প্রতিপক্ষকে বাধাদান ও হামলা এবং প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যে প্রচারণা এসব তরুণরা পছন্দ করে না।

তারুণ্য চায়, ভোটের প্রচারণা চলবে সৌহার্দ্যের সাথে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে শান্তিপূর্ণ। তরুণরা চায় নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। এই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে যেকোনও রকমের বাধা তরুণদের মনে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। এই প্রতিক্রিয়া শুধু বাধাদানকারীর বিরুদ্ধে নয়, দীর্ঘমেয়াদে তা রাজনীতির চলমান ধারার বিরুদ্ধেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব হয়ে দেখা দিতে পারে। কাজেই নির্বাচনের পক্ষ-বিপক্ষ, সরকারি ও বিরোধী জোট আর নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে জড়িত সকল সংস্থাকে আসন্ন নির্বাচনে প্রধানত নির্বিঘ্নে ভোটদানের সুযোগ নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে।

বাংলাদেশের তারুণ্যের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ- কর্মসংস্থান। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কর্তৃক প্রকাশিত 'ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮' অনুসারে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৮ লাখ। আর ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ৩০ লাখে পৌঁছাতে পারে বলে আইএলও এর পূর্বাভাস। তাদের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ২৫ লাখ। বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশই 'অপ্রাতিষ্ঠানিক', যা দারিদ্র দূরীকরণের পথে বাধা বলে মনে করে আইএলও।

বাংলাদেশের কর্মশক্তির একটা বিরাট অংশ আবহমান কাল থেকেই কৃষিখাতের সাথে জড়িত। পাশাপাশি শিক্ষিত তরুণদের অনেকে এখন কৃষি ও কৃষিভিত্তিক ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছেন। প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবসা ক্রম বিকাশমান। স্বল্প শিক্ষিত তরুণ এমনকি সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণরাও জীবিকার সন্ধানে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি দেয় বিদেশে। কর্মক্ষম মানুষের অন্যতম ঠিকানা এখন তৈরি পোশাক শিল্পখাত। কর্মসংস্থানের সংকট দেশের এক কঠিন বাস্তবতা। বিশাল জনসংখ্যার এ দেশে ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শিল্পায়নের কোনও বিকল্প নেই। কেবল শিল্পায়ন হলেই 'প্রাতিষ্ঠানিক' কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে, যা দারিদ্র দূরীকরণে সহায়ক হবে। এবং এর ফলে কার্যত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা হবে টেকসই। তাই তারুণ্যের প্রত্যাশা- শিল্প ও বিনিয়োগ বান্ধব রাজনৈতিক শক্তি। যারা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উদ্যোগী হবে। সঙ্গে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ অভিবাসনের ব্যবস্থা করবে। বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক শিল্পের বাজার ধরে রেখে প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেবে এবং কৃষিতে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সহায়তা দিয়ে কৃষি ভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলবে।

তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষা- দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। উন্নয়নের বৃহৎ অংশ যে দুর্নীতির দুষ্টচক্রে পড়ে হারিয়ে যায় এবং জনজীবনের মানের উন্নতি ঘটাতে ব্যর্থ হয় এই বোধ তারুণ্যের আক্ষেপ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। হতাশার জন্ম দেয়। শিক্ষিত-চাকরিহীন-হতাশ তারুণ্য নিরাশায় আশ্রয় খোঁজে। তারুণ্য নির্ভর একটি দেশে এ ধরণের হতাশা সম্মিলিত রূপ লাভের আগেই এর গতিরোধ করা প্রয়োজন। দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি- এই উক্তি শুধু কথার কথা তো নয়। আশেপাশে দুর্নীতি পরায়নদের বাড়-বাড়ন্ত আর বিলাসী জীবন দেশপ্রেমিক তারুণ্যকে বিপর্যস্ত করে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই তাই শুধুমাত্র দুর্নীতি দমন কমিশনের মত প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সম্ভব নয়। এই ব্যাধি দমনে তাই একটি জাতীয় নীতি অনুসরণ করতে হবে এবং সমাজে বিরাজমান দুর্নীতি বিরোধী সব শক্তিকে একত্রিত করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক অপ্রাপ্তির হতাশা এবং সাংস্কৃতিক চর্চার শূন্যতা তরুণদের একটি অংশকে বিপথগামী করছে। তাদের কেউ কেউ মাদকে আসক্ত হচ্ছে। আর কেউ কেউ ঝুকছে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির দেখানো অন্ধকার পথে। এ সময়ের মাদক হাতিয়ার ইয়াবা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে মহামারি আকারে। এর ভয়াল এবং ভবিষ্যত বিধ্বংসী প্রভাব থামাতে হলে শুধু মাদক কারবারীদের বিরুদ্ধে অভিযানই যথেষ্ট নয়। বন্ধ করতে হবে মাদকের উৎসমুখ। প্রতি গ্রাম, প্রতি শহর, প্রতি নগরে বাড়াতে হবে সাংস্তৃতিক চর্চা। সৃষ্টি করতে হবে সুস্থ বিনোদনের পরিবেশ। আর্থিক ও সামাজিক হতাশা সৃষ্টির কারণগুলোকেও অপসারণ করতে হবে যথাযথভাবে। উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিকাশের নেপথ্যের কারণগুলো চিহ্নিত করে তাদের বেড়ে ওঠার জল-হাওয়া বন্ধ করতে হবে অবিলম্বে। তা না হলে মাদক ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বাড়-বাড়ন্ত বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার মসৃণ পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।

তরুণ-যুবকদের প্রত্যাশার অন্যতম ক্ষেত্র- শিক্ষা। অগ্রসরমান অর্থনীতির বাংলাদেশে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিশ্ব ব্যবস্থায় শিক্ষাই হবে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র হাতিয়ার। কিন্তু প্রচলিত পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা আগামীর তারুণ্যের সৃষ্টিশীলতাকে ব্যাহত করছে। ব্যাহত করছে তাদের ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে। একটি দীর্ঘ ও পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতির ভেতরে থেকেও বাংলাদেশের তরুণরা উচ্চ শিক্ষার বিশ্ব পরিমণ্ডলে দারুণ সব সাফল্য উপহার দিয়ে চলেছে। প্রযুক্তি নির্ভর ভবিষ্যত বাংলাদেশ গড়তে হলে পরীক্ষার আধিক্য বাদ দিয়ে একটি কার্যকর ও জ্ঞান অর্জনের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে। পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে হবে তৃণমূল পর্যায়ে। তাহলেই কেবল প্রশ্ন ফাঁস, অতিরিক্ত চাপে থাকা শিক্ষার্থীদের মনো-সামাজিক বৈকল্য এবং শিক্ষা শেষে বেকারত্বের মত সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।

বাংলাদেশের তারুণ্য নানা প্রতিকূলতার মাঝেও সঠিক পথেই থাকতে চায়। থেকেছেও অতীতে। তারুণ্যের প্রতি জাতি যখনই আস্থা রেখেছে, তারা প্রতিবারই এর যথাযথ প্রতিদান দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত লড়াইয়ে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে- প্রতিবারই তারুণ্য এগিয়ে এসে জাতিকে পথ দেখিয়েছে। এই তারুণ্য যেমন রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ চায় ঠিক তেমনি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশও চায়। তারা চায় একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল, রাজনৈতিক হানাহানিমুক্ত বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা আমাদের রাজনীতিবিদরা হরহামেশাই বলেন। আগামীর উন্নত বাংলাদেশ গঠনে তাই তারুণ্যেই নির্ভর করতে হবে। ভরসা রাখতে হবে তারুণ্যের শক্তিতে ও দেশপ্রেমে। তাহলেই ভবিষ্যত হবে তরুণদের, ভবিষ্যত হবে বাংলাদেশের।