বাংলা একাডেমির কাছে আমাদের প্রত্যাশা

আনিসুর রহমান
Published : 24 Dec 2018, 01:35 PM
Updated : 24 Dec 2018, 01:35 PM

দীর্ঘ কয়েক দশক পর বাংলা একাডেমিতে একজন কবিকে মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে অভিনন্দন। আজকের এই পরিবর্তিত বাংলা একাডেমির নতুন পথযাত্রায় জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে আমার কিছু ভাবনা ও প্রত্যাশা তুলে ধরতে চাই।

ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন ও প্রসারের নিমিত্তে পৃথিবীর ইতিহাসে ফরাসি দেশে প্রথম একাডেমি স্থাপিত হয় ১৬৩৫ সালে। যার নাম ফরাসি একাডেমি (French Academy)। এই ধারণাটি পরিণতি লাভ করে বেশ কয়েকজন লেখকের নিয়মিত অনানুষ্ঠানিক আড্ডা থেকে। একদল প্রথিতযশা ফরাসি লেখক ১৬২০ সালে নিয়মিত আড্ডা দিতে শুরু করেন। তার পনের বছর পরে সেখান থেকে জন্ম নেয় ফরাসি একাডেমি।

এই একাডেমির আদলে সুইডেনের রাজা গুসতাফ তৃতীয় ১৭৮৬ সালে সুইডিশ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। যে একাডেমির উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর অন্যতম হলো সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া।

অনেকটা ফরাসি একাডেমির আদলেই ১৯৫৪ সালে দিল্লীতে প্রতিষ্ঠা করা হয় সাহিত্য একাডেমি। যার প্রথম সভাপতি ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের এরকম একাডেমির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রায় একই এবং কাঠামোও অনেকটা কাছাকাছি। আমাদের বাংলা একাডেমির যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৫ সালে। তার পূর্বে পণ্ডিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে আমাদের দেশে ভাষা সংক্রান্ত একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। পরে দৈনিক আজাদ পত্রিকা বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

ধারণা করা যায়, ফরাসি দেশে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ফরাসি একাডেমি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা লাভ করেছিলেন এবং আমাদের দেশে এরকম একটি একাডেমির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে থাকতে পারেন। তারপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এরকম একটি একাডেমির পক্ষে জোরালো একটা ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। একাডেমির নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এর অর্জন, তাৎপর্য ও ভূমিকা ব্যাপক। ১৯৬০ সাল থেকে বাংলা একাডেমি প্রতিবছর সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া শুরু করে। অভিধান প্রণয়ন, প্রকাশ, সভা সেমিনার, সম্মেলন এবং বইমেলা আয়োজনসহ আজ বাংলা একাডেমির কাজের পরিধি ব্যাপক।

বাংলা একাডেমি আজ ৬৩ বছরে পদার্পণ করেছে; এর মধ্যে এর ৪১ তম সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।

একাডেমির কার্যাবলী নিয়ে আলোচনায় যাবার পূর্বে একটা কথা বলে নিই। সব কাজ করতে গেলে মূল কাজে গলদ থেকে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তাই বাংলা একাডেমির মনোযোগের কেন্দ্র থাকা উচিত ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন ও এর প্রসার।

পৃথিবীর কোন দেশের এরকম একাডেমি বইমেলা আয়োজন নিয়ে বড় একটা সময় ব্যতিব্যস্ত থাকে না। তাই বইমেলার আয়োজনটা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আর প্রকাশক সমিতির কাছে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। আর বই মেলার সভা সেমিনারের বিষয়টা বাংলা একাডেমি দেখভাল করতে পারে। এই একাডেমির আইন ২০১৩ সালে সংশোধিত আকারে প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনে বলা হয়েছে, একাডেমি গঠিত হবে সভাপতি, কার্যনির্বাহী পরিষদ, ফেলো আর সদস্যদের নিয়ে। বর্তমানে এর সদস্য তিন হাজারের মতো। প্রতিবছর সর্বোচ্চ ২১ জন নতুন সদস্য করা যাবে। ষোল কোটি মানুষের দেশ। বলা হয়ে থাকে যেখানে কাকের চেয়ে কবি বেশি। তাই এই জায়গাটা পরিবর্তন করে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর পরিধি বিস্তৃত করা দরকার।

এই আইনে আরও বলা হয়েছে, কার্যনির্বাহী পরিষদ বাংলা একাডেমির ফেলোগণের মাঝ থেকে তিনজন নির্বাচিত হবেন আর সদস্যদের মাঝ থেকে চারজন নির্বাচিত হবেন। অথচ এই সাতজন সদস্য ছাড়াই বাংলা একাডেমি পরিচালিত হচ্ছে অনেক বছর ধরে। তাছাড়া নতুন আইনের নানা ফাঁকফোকর দিয়ে একাডেমি আজকে অনেকটা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটা ইউনিটের মতো; এর যে স্বায়ত্ত্বশাসিত ভাবমূর্তি থাকা দরকার সেটা অনেকটা আজ অনুপস্থিত।

বাংলা একাডেমির কার্যাবলীর একটি হলো আমাদের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিষয়ে বই প্রকাশ করা। এক্ষেত্রে একাডেমির উল্লেখযোগ্য তেমন কোনও কার্যক্রম নাই; অল্পবিস্তর লেখালেখি ছাড়া। সম্প্রতি ভারতের উড়িষ্যা রাজ্য সরকার রাজ্যের ২১টি আদিবাসী ভাষার অভিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের দেশে ৭৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ত্রিশের অধিক আদিবাসী ভাষা রয়েছে। বাংলা একাডেমি এসব ভাষার অভিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে পারে।

লেখকদের জন্যে তহবিলের জোগান দেয়ার নিমিত্তে স্বতন্ত্র তহবিল প্রতিষ্ঠা করা বাংলা একাডেমির কাজের মধ্যেই পড়ে। এক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এরকম তহবিল কিভাবে গঠিত হয়, পরিচালিত হয় সে বিষয়ে মতবিনিময় বা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। নরওয়ে এরকম তহবিল চালু করে ১৮ শতকে। আর আমরা ২১ শতকে এসেও এরকম একটা বিষয়ের জন্যে আলোচনাই শুরু করতে পারলাম না।

বাংলা একাডেমির বড় কাজ হলো ভাষার উৎকর্ষতা সাধন ও রক্ষা করা। এখন আমাদের বাংলাভাষার যে দূরবস্থা তা আমাদের গণমাধ্যম থেকে শুরু করে অফিস আদালতের ভাষা ব্যবহারের দিকে তাকালে সহজেই বোধগম্য।

ভাষা পর্যবেক্ষণ ও উৎকর্ষ রক্ষায় বাংলা একাডেমি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটা ভাষা পর্যবেক্ষণ পরিষদ করতে পারে। একই সঙ্গে অভিধানের জন্যে স্থায়ী একটা বোর্ড বা কেন্দ্র থাকা দরকার। বিশেষ করে নতুন শব্দ বা ভুক্তির বিষয়ে সর্ব সাম্প্রতিক দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি। এখন নতুন একটা বিদেশি শব্দের নিজস্ব ভাষায় তার শব্দ অনুসন্ধান না করে আমরা বিদেশি শব্দটাই চালিয়ে দিচ্ছি। এই প্রবণতা বন্ধ করার ব্যাপারে বাংলা একাডেমির এগিয়ে আসা জরুরি।

আরও একটা ক্ষতিকর প্রবণতা হচ্ছে বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে খিচুড়ি ভাষার প্রবর্তন। এটাও ঠেকানোর দায়িত্ব বাংলা একাডেমিকেই নিতে হবে। রাস্তায় বের হলে, অফিস আদালতে গেলে অথবা পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা বেতার দূরদর্শনে এই খিচুড়ি প্রবণতার ছড়াছড়ি। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রত্যয় নিয়ে বাংলা একাডেমি দায় এড়াতে পারে না।

প্রতিবছর ভুলভালে ভরা যথাযথ সম্পাদনাহীন অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়। এই বই বাংলা একাডেমির আয়োজিত বই মেলাতেও উপস্থাপন করা হয়। এই ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি বই সম্পাদনা বিষয়ে প্রকাশক, লেখক সম্পাদক, অনুবাদক সমন্বয়ে কর্মসূচি হাতে নিতে পারে।

তরুণ লেখক প্রকল্প এবং তরুণ অনুবাদক প্রকল্পও একটা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ হতে পারে। তরুণ লেখক এবং অনুবাদকের জন্যে বৃত্তি চালু করা, তহবিলের জোগান দেয়াও বাংলা একাডেমির উদ্যোগের অংশ হওয়া দরকার।

লেখাটি শেষ করার আগে নতুন মহাপরিচালক আমাদের সিরাজী ভাইয়ের সাফল্য কামনা করছি। একই সঙ্গে আশা করছি বাংলা একাডেমিকে তিনি অনন্য একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর তাৎপর্য সমুন্নত রাখবেন। এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এর ভাবমূর্তি মহিমান্বিত করবেন।