দেশ জিতলে, সংস্কৃতি জিতলে, নির্বাচনও জিতবে

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 23 Dec 2018, 12:09 PM
Updated : 23 Dec 2018, 12:09 PM

সত্তরের নির্বাচন দেখার সুযোগ হয়েছিল। বাবা মায়ের হাত ধরে বাড়ির কাছের ভোটকেন্দ্রে যাবার স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে। সে নির্বাচনে মানুষ সঠিক রায় দিয়েছিলেন বলে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক।

বাংলাদেশের নাগরিকদের গোড়ার দিকে যে সংশয় আর অপমানের স্বীকার হতো তা এখন নাই।  যখন তারুণ্যে দেশের এমন চেহারা হয়েছিল আমাদের ভবিষ্যত কী সেটাই জানাবোঝা যেত না। একসময় পাকিস্তানের ছায়া রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য আদা জল খেয়ে লাগা সরকারী দলগুলো মুক্তিযুদ্ধকে প্রায় অকার্যকর প্রমাণের চেষ্টায় মরিয়া হবার পরও মানুষ দমেনি। তারা সবসময় সঠিক সিদ্বান্ত নিয়ে জাতিকে এগিয়ে রেখেছিল। আশাহীনতার ভেতর থেকে উঠে আসা আশার নাম বাংলাদেশ। কম সহ্য করেনি এই মাটি। কম দেখেনি কিছু ইতিহাস। যারা দেশ স্বাধীনের জন্য প্রাণ দিয়েছিল যাদের ত্যাগে পতাকা সঙ্গীত- তাদের অপমান সময় মেনে নেয়নি। এককালের জবরদস্ত রাজাকারেরা আজ ফসিল। যেসব আস্ফালন আর মিথ্যা বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতিকে বেগবান করেছিল তাও আজ আর কাজ করেনা।

এখন এক নতুন বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে দুনিয়ায়। একাত্তরে স্বাধীন হবার পর তলাবিহীন ঝুড়ি নামের দেশটি আজ উপচে পড়া দেশ। যেসব মুরুব্বিরা কথায় কথায় চোখ রাঙাতেন তাদের চোখের ভাষা পাল্টে গেছে। তারা বুঝে গেছে ধমকের দিন শেষ। এখন তোয়াজ করে চলতে হবে আমাদের। এই সেদিনও আমাদের চেনানো হতো নেক্সট টু ইন্ডিয়া বলে। সে বাস্তবতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজ বাংলাদেশ তার নিজের মান, নিজের নাম, নিজস্ব পরিচয়ে উদ্ভাসিত। তাই এবারের নির্বাচনটি আবার অপরিসীম গুরুত্ব আর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে হাজির।

কোনও দলের হয়ে কথা বলা লেখকের কাজ না। আবার দলহীনতার নামে দেশ জাতির সর্বনাশ করতে চাওয়া রাজনীতিকে উৎসাহিত করাও লেখার উদ্দেশ্য হতে পারেনা। আপনি আমাকে এমন একটা দেশ দেখান যেখানে রাজনীতি তার মৌলিক বিষয় নিয়ে এমন বচসা করে।

পাশের দেশ ভারত আর একদা যে দেশের অঙ্গ ছিলাম সেই পাকিস্তানের রাজনীতিও তা করেনা। বিজেপি গান্ধীর আততায়ী নাথুরাম গডসেকে হিরো মনে করে। অথচ আপনি দেখবেন তাদের নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশে-বিদেশে কত জায়গায় হাতজোড় করে গান্ধী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এর নাম দেশ ও জাতির ইতিহাসকে সম্মান করা।

পাকিস্তানে সামরিক বেসামরিক যত ধরনের সরকার আসে যায় কারও রাজনীতিতে জিন্নাহ নিয়ে বিতর্ক নাই। সে জায়গায় আমরা বঙ্গবন্ধুর মতো এক মহান কালজয়ী নেতাকে নিয়ে এখনো তর্ক করি। লন্ডনে পালিয়ে থাকা বিএনপির যুবরাজ তারেক তাকে বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধন পর্যন্ত করে না। তাদের নেতারা বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন কিংবা চার জাতীয় নেতার কাউকে শ্রদ্ধা করা দূরে থাকুক পারলে তাদের সবকিছু নষ্ট করে দিতে পারায় সচেষ্ট।

আমি এমন কোনও দেশের নাম জানিনা যেখানে মা, মাটি ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা রাজনীতির এতো কদর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের ভূমিকা জার্মানদের জন্য কি খারাপ? তাদের দিক থেকে বিবেচনা করলে হিটলার তো হিরো হবার কথা। যিনি প্রায় গোটা দুনিয়া জয় করে এনেছিলেন। অথচ আজও তার প্রতি ঘৃণা আর তাকে এড়িয়ে চলাই জার্মানির রাজনীতি।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কতটা গৌরবের সেটা তারুণ্য এখনো জানেনা।  তখন সবদিক থেকে চালচুলোহীন এক জাতি কিভাবে আমেরিকা চীন ও পাকিস্তানের সাথে টেক্কা দিয়ে একটা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিল তা না জানলে এদেশের কিছুই জানা হবেনা। আজ আবার একথাগুলো বলার কারণ নির্বাচন। কে না চায় দেশে একটা সঠিক বিরোধী দল থাকুক। রাজনীতিতে বিরোধী দল না থাকলে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকেনা। যেসব দেশ গণতান্ত্রিক বা যেখানে জবাবদিহিতা আছে সেখানে বিরোধী দল সিংহাসনে না থেকেও রাজা মন্ত্রী।

সে প্রক্রিয়া নাই বলেই হয়তো বিরোধী দল মানেই মারমুখো আর ভয়ঙ্কর সব কথাবার্তা। এবার আরো বিপদ তৈরি করেছে প্রবীণ কিছু রাজনৈতিক নেতা। এদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলি একটা সময় তাদের অবদান বা কাজ দেশকে কিছু দিলেও এখন আর তা নাই। বহুকাল ধরে তারা আধুনিক রাজনীতি ও নতুন প্রজন্মের স্পর্শহীন। এখন কি আর সত্তর দশক বা আশির দশকের রাজনীতি চলবে? বাংলাদেশে এখন ঢালাও বিরোধিতার দিন শেষ। এটা মানি রাজনীতির উভয়দিকে আছে ঝামেলার ছড়াছড়ি।

আওয়ামী লীগ দুই দফা সরকারে থাকার পর ও ইচ্ছা অনিচ্ছায় অনেক আবর্জনা সাফ করেনি। বরং নানা বিষয়ে তারা এমন সব তর্ক আর বিপদ জড়ো করেছে যা নানা সময়ে মানুষকে বিরক্ত করার পাশাপাশি উগ্র করে তুলেছে। হত্যা-গুম-খুনসহ দুর্নীতির অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বরং তার অনেকটাই সত্য।

কিন্তু ভরসার জায়গা কোনটা? নানা ধরনের কথা বলা সত্ত্বেও কাজ করা একনায়ক, না হঠাৎ বেরিয়ে আসা সেসব প্রবীণেরা যাদের কথা ও কাজে এখন অভিমান রাগ এবং ঝগড়া ছাড়া আর কিছু নাই?

সে কারণেই শেখ হাসিনাকে আবার দরকার। কারণ গত দুবারে তিনি এদেশকে ভালোভাবে বুঝে নিয়েছেন। রক্তের উত্তরাধিকার নিয়ে মতামতে বিভেদ থাকলেও মানতে হবে উপমহাদেশে রক্তের শুদ্ধ উত্তরাধিকার শক্তিশালী। ইন্দিরা গান্ধী যেমন ইতিহাস, তেমনি বেনজিরও।

আমাদের নেতা এ দুবারে বাংলাদেশকে যে উন্নয়ন ও অগ্রগতি দিয়েছেন তার নজির আছে? যদি না থাকে কোন গণতন্ত্রের নামে আপনি নিজের পায়ে কুড়াল মারবেন। বছরের পর বছর গদি আঁকড়ে থাকা যারা বাংলাদেশের কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারেননি, আবার কোন ভরসায় কোন গণতন্ত্রের নামে তাদের চাইবে মানুষ? হরতাল ধর্মঘট অবরোধের জামানা পেরিয়ে আসা দেশকে যেন সে পথে ঠেলে না দেই আমরা। সবচাইতে বড় কথা ভিশন। দূরদৃষ্টিহীন মানুষ আর যাই হোক নেতা হতে পারেন না।

এটা মানি মন্ত্রী থেকে ব্যবসায়ী সবার ভেতর গলদ আছে। সে গলদ থেকে বেরিয়ে আসার রাজনীতি এখনো দূর-অস্ত। এবার যদি শান্তি ও উন্নয়নের শক্তিকে জিতিয়ে আনা যায় তাহলে আমরা সেপথে পা রাখতে পারবো। আর তা না হলে আবারো হানাহানি আর মারামারির ভেতর চলে যাবে সমাজ। যার মানে অগ্রগতি ও শান্তি হবে সুদূর পরাহত।

বিশ্বাস করুন বিদেশে আজ বাংলাদেশ একটি মর্যাদার নাম। নানা সূচকে আমরা পাশের দেশগুলোকে ছাড়িয়ে  সামনে চলেছি। এই যাত্রা এ জীবনে দেখে যেতে পারবো মনে হয়নি। অথচ আজ তাই সত্য। এই সত্যকে তুলে ধরার নেতাকে বিদায় করার আগে ভাবতে হবে বৈকি। আর একটা কথা। আমাদের পরম শক্তি আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। আমরা সেসব বিরল জাতিসত্তার একটি যার সংস্কৃতি শুধু নাচ-গান-কবিতা নাটকে সীমাবদ্ধ থাকেনা। সময় মতো জ্বলে উঠে আমাদের পথ দেখায়।

এখন যারা বিরোধী দলে তারা কেন জানি বাংলা সংস্কৃতি ও অতীত ঐতিহ্যের প্রতি নাখোশ। তারা তাদের রাজনীতির কারণেই সংস্কৃতি বিমুখ। আমরা কি আমাদের দেশ ও জাতিকে সাংস্কৃতিকভাবে পঙ্গু দেখতে চাই? খোলা মন, খোলা মত, খোলা বিবেকের বিকল্প নাই দুনিয়ায়। যারা তা করতে পারে তারাই সম্মানিত । এ সম্মান এখন দোরগোড়ায়।

এবারের নির্বাচন তারুণ্যের জন্য এক আগুনের গোলা। তাদের ভোটেই ঠিক হবে মাশরাফির বাংলাদেশ তিরিশ দশকের ওয়ান ডে-তে জিতবে না হারবে?

ক্রিকেট যেমন আমাদের জাতীয় গর্ব আমাদের অহংকার, নির্বাচনে জয়-পরাজয়ও আজ বড় এক বিষয়। যারাই জিতুক বাংলাদেশের উন্নয়ন ও শান্তি হবে মানুষের চাওয়া। যার সন্ধানে জাতির জনক চার জাতীয় নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক সেনানি প্রাণ দিয়েছেন। স্বাধীন দেশের মাটি রক্তরঞ্জিত হয়েছে তাদের খুনে। এর পুনরাবৃত্তি চাই না।