নারীর জন্য আওয়ামী সরকারের ইশতিহার: প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

শান্তা তাওহিদা
Published : 22 Dec 2018, 01:13 PM
Updated : 22 Dec 2018, 01:13 PM

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংবিধানের ১০ ও ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী 'জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ' এবং রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকে মূলনীতি করে তাদের ইশতিহারের নারী বিষয়ক অংশটি তৈরি করেছে। যাতে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে।

অন্যদিকে বিএনপির ইশতিহারে নারীর জন্য আলাদা করে কোনও অংশ রাখা হয়নি। কেবল যুব নারী ও শিশু অংশে খুব হালকা করে ক্রিড়া ক্ষেত্রে ও সম্পত্তির ক্ষেত্রের বিষয় আলোচনায় এসেছে। অন্যদিকে, ঐক্যফ্রন্ট এর ইশতিহারে বলা হয়েছে, সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ করা হবে, নারীর বিয়ের বয়স ১৮ তে ফিরিয়ে আনা হবে।

নারী অধিকার কর্মীদের এ নিয়ে বেশ অসন্তোষ লক্ষ করা গেছে। তাদের অভিযোগ হলো ইশতিহারে যে সকল ইতিবাচক উন্নয়নের বিষয় লেখা হয় সেগুলো নির্বাচনের পর সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয় না। বিশেষত নির্বাচনের পর সেই প্রস্তাবিত পদেক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তার পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং করা হয় না।

বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য সংবাদ মাধ্যমে নারীর জন্য ইশতিহার শিরোনামের প্রতিবেদনটির মোটা দাগে এই হল সারমর্ম । নির্বাচনী ইশতিহারে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের প্রতিশ্রুতি পূরণের অভাবে কাগুজে প্রতিশ্রুতি হিসেবে রয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রের বর্তমান বাস্তবতার জায়গাকে আমি একেবারেই উল্টো বলে মনে করি। বিগত বছরকালে অন্তত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশে নারী শিক্ষা, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের যে যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে, এটি অস্বীকার করার সুযোগ আমি দেখছি না।

চলুন আওয়ামী সরকারের উন্নয়নের মাপকাঠিতে বিগত ইশতিহার এর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির তুলনা করি । প্রথমেই

আওয়ামী সরকারের নবম ও দশম ইশতিহারে নারীর জন্য যে অংশ রয়েছে তার দিকে নজর দেওয়া যাক।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইশতেহারে শিক্ষা ও বিজ্ঞান অংশে নারীশিক্ষা উৎসাহিত করার লক্ষ্যে উপবৃত্তি অব্যাহত রাখা হবে উল্লেখ করা হয়। ১২ নম্বর অংশটি হল নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক ।

যেখানে, নারীর ক্ষমতায়ন, সম-অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক প্রণীত 'নারী উন্নয়ন নীতি' পুনর্বহাল করা, জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা,  প্রশাসন ও সমাজের সর্বস্তরের উচ্চপদে নারীদের নিয়োগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া, নারী নির্যাতন বন্ধে কঠোরতম আইনি ব্যবস্থা নেয়া, নারী ও শিশু পাচার রোধে আঞ্চলিক সহযোগিতাসহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বৈষম্যমূলক আইনসমূহ সংশোধনের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা, কর্মবান্ধব পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার উল্লেখ রয়েছে।

২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইশতেহারে আলাদাভাবে নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। বিশেষ করে নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ দৃঢ়ভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা, রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে কেবল সংখ্যাগত সাম্য প্রতিষ্ঠাই নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নারীর অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানো, প্রশাসন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে নারীর অধিক সংখ্যায় নিয়োগের নীতি অব্যাহত রাখা এবং নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি, বৈষম্য বন্ধ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে গৃহীত আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনের পর ইশতিহারে প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলোর কতখানি বাস্তবায়ন করেছে সেদিকে নজর দেয়া যাক।

নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় গ্রহণ করা বহুবিধ পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করলে প্রথমেই আসে ১৯৯৭ সালে প্রণয়ন করা প্রগতিশীল নারী নীতিমালা। যার বাস্তবায়নের চিত্র পরবর্তীকালে দৃশ্যত হয়। ২০০৮ সালে নারীর ক্ষমতায়ন, সম-অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক প্রণীত 'নারী উন্নয়ন নীতি' পুনর্বহাল রাখা হয়। আওয়ামী সরকারের ইশতিহারের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, এই সরকার শুরু থেকেই নারীবান্ধব সরকার। এই দলের প্রতিটি ইশতিহারে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দিয়ে পৃথক ধারা উল্লেখ করে।

নারীর উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, এ গভীর উপলদ্ধি থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর নারী সমাজের উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেশকে উপহার দেন '৭২-এর অনন্য সংবিধান। যাতে কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথাই বলা হয়নি, অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে এতে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে সর্বপ্রথম জাতির পিতা নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত করেন। এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। যার ফলে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রথম সংসদেই নারীরা প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান।

তাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখনই সরকার গঠন করেছে তখনই দেশের নারী সমাজের উন্নয়নে কাজ করতে আমরা দেখেছি। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারী উন্নয়নকে যুক্ত করে। ১৯৯৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৩টি সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর ২৮ মে 'নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস' পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৯৮ সালে নারীর উন্নয়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সন্তানের পরিচিতির সাথে বাবার নামের পাশে মায়ের নাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আওয়ামী লীগ সরকার । এই সরকার সর্বপ্রথম সামরিক বাহিনীতে অফিসার পদে নারীদের নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। বাংলাদেশে প্রথম মহিলা সচিব নিয়োগ দেয়া হয়। ২০০০ সালে বাংলাদেশ 'সিইডিএডব্লিউ' সনদের 'অপশনাল প্রটোকল' অনুস্বাক্ষর করে। একই বছর মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল সনদে স্বাক্ষর করে নারী উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০, পারিবারিক সহিংসতা বিধিমালা-২০১৩, ডিএনএ আইন-২০১৪ এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৩-২৫ প্রণয়ন করে এই সরকার। মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাসে উন্নীত এবং মাতৃত্বকালীন ভাতা ও ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা চালু করা হয়। মন্ত্রণালয়গুলোতে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।

১৯৭৩ সালের ১ম সংসদে মাত্র ১৫ জন নারী সংসদ সদস্য ছিল, কিন্তু বর্তমানে সংসদে ৭২ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছে যার মধ্যে ২২ জন সরাসরি প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী সরকার জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, সিনিয়র সচিব বা সচিব পদে, ব্যাংকিং সেক্টরে উচ্চ পদ, রাষ্ট্রদূত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নারীদের নিয়োগ বা দায়িত্ব দিয়েছে।

প্রতিটি উপজেলা পরিষদে ১জন নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছেন। সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা নারীর ক্ষমতায়ন বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের ১০ জন সদস্যের মধ্যে ৩ জন নারী এবং দলটির সভাপতিও একজন নারী। স্থানীয় পর্যায়ে নারীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে মনোনয়ন দেয়ার মাধ্যমে। প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে সরকারের শেষ পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদেও নির্বাচনে ১২ হাজারের বেশি নারী জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

শেখ হাসিনার সরকার সামাজিক নিরাপত্তা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মেইনস্ট্রিমে নিয়ে আসার জন্য বহুমুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, যেমন ভিজিএফ, ভিজিডি, দুস্থ নারী ভাতা, মাতৃত্বকালীন এবং দুগ্ধবতী মায়েদের জন্য ভাতা, অক্ষম মায়ের ভাতা, তালাকপ্রাপ্তা ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী, ৪০ দিনের কর্মসূচী, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ইত্যাদি। গ্রামের নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সরকারের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ দেয়া হয় মাত্র ৫ শতাংশ সেবামূল্যের বিনিময়ে। নারী উদ্যোক্তারা ক্ষুদ্র উদ্যোগ তহবিলের ১০ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক খাতের ১০ শতাংশ পেয়ে থাকেন। বর্তমানে ৩০ লাখের বেশি নারী কেবল তৈরি পোশাক কারখানায় তথা গার্মেন্টসে কাজ করেন, এই গার্মেন্টস খাত থেকেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশই আসে। উপবৃত্তি, বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ এবং অবৈতনিক শিক্ষা দেওয়ার ফলে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্রীদের স্কুলে ভর্তির হার শতভাগে উন্নীত হয়েছে। নারীর উচ্চশিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ এবং পদক্ষেপের কারণে মেয়েরা ছেলেদের ন্যায় লৈঙ্গিক সমতায় চলে আসছে মেয়েরা। যেমন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মেয়েদের ভর্তির হার এখন ৫১ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে তা ৫৩ শতাংশ, যেখানে ছেলেদের ক্ষেত্রে তা ৪৭ শতাংশ, মাত্র কিছু বছর পেছনে ফিরে দেখা যাবে যখন ছেলেদের ছিল ৬৫ শতাংশ এবং মেয়েদের ছিলো মাত্র ৩৫ শতাংশ।

আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে গৃহীত ব্যবস্থায় নারী উদ্যোক্তাগণ এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল থেকে বিশেষ সুবিধাযুক্ত ১০ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছে। পুন:অর্থায়নে তহবিলের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য। নারীরা ২৫ লাখ পর্যন্ত এসএমই ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন জামানতদার ছাড়াই, কেবলই ব্যক্তিগত পরিচয়ে। পাশাপাশি সরকারী এবং বেসরকারী ব্যাংকগুলো নারীদের সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশেষ সার্ভিস চালু করেছে ইতোমধ্যে।

নারীর সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও ব্যবসায়ে সমান সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকার ২০১১ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি পাস করে। যেখানে নারীদের সম্পদের সমান অধিকার এবং ব্যবসায়ের সুযোগ সৃষ্টি করে। পারিবারিক সহিংসতা (দমন এবং নিরাপত্তা) আইন ২০১০ পাস করা হয়, এই আইন নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের নিয়মপত্র এবং সংবিধানের ২৮তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা স্পষ্ট করে, যা নারী ও শিশুর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণকে নিশ্চয়তা দেয়। পাশাপাশি সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১১ প্রণয়ন করেছে। দুস্থদের জন্য ৭টি বিভাগে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারগুলো মেডিক্যাল চিকিৎসা, আইনি সহায়তা, পলিসি সহায়তা এবং আক্রান্তদের পুনর্বাসন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় হাসপাতালে ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাব এবং ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।

জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি বাহিনীর ব্যাপক সুনাম ও চাহিদার প্রয়োজন মেটাতে সরকার এখন বিশ্বের সর্বাপেক্ষা নারী পুলিশ পাঠাচ্ছে মিশনগুলোতে। পারিবারিক সহিংসতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপত্তা, নারী অফিসারদের সুপরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে আামদের নারী পুলিশদের যোগাযোগ বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৯০ জন নারী অফিসার শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। সম্প্রতি পুলিশের চালু করা বিশেষ সেবা সার্ভিস ৯৯৯-তেও নারী পুলিশের অগ্রগণ্য ভূমিকা রয়েছে।

জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করছে। যার প্রমাণস্বরূপ আমরা বলতে পারি সম্প্রতি সময়ে ইউনেস্কোসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে আমাদের দেশের স্বীকৃতি।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের 'গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৬' অনুযায়ী ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭২তম যা দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের চাইতে ভালো অবস্থান নির্দেশ করছে।

রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী অংশগ্রহণের মান হিসেবে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ ৬ষ্ঠ স্থানে। মহিলা ও শিশুদের স্বাস্থ্যের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্ভাবনী চিন্তা শক্তির জন্য বাংলাদেশ ২০১১ সালে 'ডিজিটাল হেলথ ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট' শীর্ষক সাউথ-সাউথ পুরস্কারেও ভূষিত হয়। নারী শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি ও শিক্ষার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ইউনেস্কো থেকে 'পিস ট্রি' অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর ক্ষমতায়নে ও জেন্ডার সমতা আনায় উন্নতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ 'ওমেন ইন পার্লামেন্টস গ্লোবাল ফোরাম এওয়ার্ড' শীর্ষক পুরস্কারেও ভূষিত হয়।

এছাড়া প্লানেট ফিফটি ফিফটি অ্যাওয়ার্ড এবং এজেন্ট অব চেইঞ্জ অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার প্রাপ্তি বাংলাদেশের সকল নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জিত সাফল্যে নারীরা আজ সমাজকে আলোকিত করেছে। এ পুরস্কার শেখ হাসিনা সরকারের একার নয় এই পুরস্কার এ দেশের সকল নারীর।

এবারে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইশতিহারের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও পরিকল্পনার দিকে নজর দেওয়া যাক। যেখানে, ২০২০ সাল নাগাদ উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষায় নারী-পুরুষ শিক্ষার্থীর অনুপাত বর্তমানের ৭০ থেকে ১০০ শতাংশে বৃদ্ধি করা; প্রশাসন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে নারীর অধিক সংখ্যায় নিয়োগের নীতি আরো বৃদ্ধি করা; নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে তাদের জন্য আলাদা ব্যাংকিং সুবিধা, ঋণ সুবিধা, কারিগরি সুবিধা ও সুপারিশসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা;

'জয়িতা' ফাউন্ডেশন সম্প্রসারণের মাধ্যমে নারীদের সফল উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ সম্প্রসারণ করা; নারীদের পুরুষের সমান মজুরির নিশ্চয়তা দেওয়া এবং গ্রামীণ নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ও সকল ক্ষেত্রে নারীদের কর্মপরিবেশ উন্নত করা; শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য 'ডে কেয়ার সেন্টার' গড়ে তোলা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারকেও আমরা পূর্বের মতো নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের ইশতেহার বলতে পারি।

শেষ করব একটি পরিচিত উদাহারণ দিয়ে। অর্ধেক গ্লাস পানিকে আমরা বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে দেখে থাকি। আশাবাদীরা দেখেন পানিতে অর্ধেক পূর্ণ গ্লাস। নৈরাশ্যবাদীরা দেখেন, গ্লাসের অর্ধেকটা খালি। অথচ চাইলেই এই চিরায়ত বিভাজনকেও অন্যভাবে ভাবা যায়। যেভাবে ভাবলে আপনার-আমার দেশ-দশের সকলের উপকার হবে। চলুন, আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আজ থেকে বদলে ফেলি। আমরা সবাই একসাথে গ্লাসের বাকী আধেকটা পানিতে পূর্ণ করে পূর্ণ একগ্লাস শীতল জলে আমাদের তৃষ্ণা নিবারণ করি। বর্তমানে আমাদের দেশের উন্নয়ন আধেক গ্লাস পানির মতো। সেই আধেক গ্লাস পানিতে আপনার আমার পূর্ণ তৃষ্ণা নিবারণ করতে হলে আমাদের গ্লাসে পানি ঢালাকে চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ সেই গ্লাস পূর্ণ না হয়। আর আপনার হাতেই হলো পানির জগ। আপনার উপর নির্ভর করবে আপনি পানি ঢালবেন কিনা।

উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে চলমান রাখতে আপনাকে প্রয়োজন।  ১৯৭২ সালের সংবিধানে জাতির জনক যে নারী-পুরুষের সমতার বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছেন তা পূরণের আধেকটা পথ পেরিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলুন বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে একজন দক্ষ কারিগর হিসেবে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের বাকি আধেকটা পথ পাড়ি দেই। উন্নয়নের আধেক গ্লাসটা পানিতে পূর্ণ করি।

জয় বাংলা। জয় বাংলার নারী ।