নারী কর্মীর বিদেশে যাওয়া: সুযোগ না স্বপ্নভঙ্গ?

ফরহাদ আল করিম
Published : 20 Dec 2018, 11:27 AM
Updated : 20 Dec 2018, 11:27 AM

সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে বিশেষ একটি ফ্লাইটে করে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলেন কুমিল্লার দাউদকান্দির স্বপ্না আক্তার (ছদ্মনাম)। অন্য দশজন সফল বিদেশ ফেরতদের মতো বড় হাতে বড় ট্রলি ব্যাগের পরিবর্তে তার হাতে রয়েছে ছোট্ট একটি কাপড়ের পুটলি। বিমানবন্দরের বাইরে আজ আত্মীয়-স্বজন কেউই নেই যে তাকে গ্রহণ করবে। প্রথম যেদিন বিদেশে যাচ্ছিলেন তখন বাড়ির লোকজন এই বিমানবন্দরের এসে উৎসব আমেজে বিদায় জানিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তারা আসবেন বা কেন? আজ তো তার দেশে আসার কথা ছিল না। বিমান থেকে নেমে তিনি কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। হাতে কোনও অর্থকড়িও নেই যে সায়েবাদ টার্মিনালে গিয়ে দাউদকান্দির বাস ধরে বাড়ি যাবেন।

তাছাড়া বাড়ি যেতেও মন চাইছে না। কারণ বিদেশের নির্যাতনের কথা যদি প্রতিবেশিরা জানতে পারেন-তাহলে নিজের ও পরিবারের মান-সম্মান কিছুই থাকবে না। 'আত্মহত্যা করতে পারলে বোধহয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশন পার হয়ে টার্মিনালের ভেতরে এ সব ভাবছেন'- বিদেশফেরত স্বপ্না ।

এভাবে তো তার দেশে ফিরে আসার কথা ছিল না। মাত্র মাস তিনেক আগে দুই বছরের চাকরির শর্তে গৃহকর্মীর ভিসায় সৌদি আরবে কাজ করতে যান। কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়- অভাবের তাড়নায় স্বামী পরিত্যক্ত স্বপ্না বিদেশে যাওয়ায় উদ্যোগ নেন। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর অভাবী ভাইয়ের সংসারে থাকতে নিজেকে বোঝা ভাবতেন। ভাই এর সংসারে যাতে বোঝা হয়ে থাকতে না হয় তাই প্রতিবেশি এক দালালের মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে গৃহকর্মীর ভিসায় সৌদি আরবে যাওয়ার চিন্তা করেন। আগে শুনেছেন নারীদের বিদেশে গেলে নানা রকম সমস্যা হয়, খারাপ কাজ করতে বাধ্য করা হয়। তারপরও ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আসবে এ বিষয়টি মাথায় রেখে করে দালালের সহায়তায় বিদেশে যাওয়ার ঝুঁকিটি তিনি নিয়ে নেন।

বিদেশে কর্মক্ষেত্রের প্রথম দিনটি কোনও রকমে কাটলেও দ্বিতীয়দিন থেকে তার উপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। সমান্য খাবার ও কোনওরকমে থাকার একটি জায়গা দিয়ে সারাদিন গৃহকাজে একটানা খাটুনি খাটতে হতো।  প্রতিদিন ভোর থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত এক নাগাড়ে কাজ করতে হত। কাজ করেত দেরি হলে গৃহকর্ত্রীর ধমক ও শারীরিক মারধর চলতো অনবরত। সারদিনের কর্মব্যস্ত  সময় শেষে পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে রাতে যখন বিশ্রাম নিবেন যে সময় গৃহকর্তা তাকে জোর করে যৌন নির্যাতনে বাধ্য করতেন। বিভিন্ন সময়ে গৃহকর্তার  স্ত্রীকে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং তার উপর সময়ে অসময়ে কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এজেন্সির কাছে অভিযোগ করে প্রতিকার চাইলে সমস্যার সমাধান না করে তাকে উল্টো চুরির দায়ে পুলিশে অভিযোগ করে এজেন্সি অফিসে পাঠিয়ে দেয় নিয়োগকারী।

কিছুদিন এজেন্সির শেল্টার হোমে (স্থানীয়ভাবে 'মক্তব' নামে পরিচিত) থাকার পরে তাকে শূন্য হাতে অন্য দশজন নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীর সাথে সরকারের উদ্যোগে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়।

শুধু কুমিল্লার স্বপ্না কেন, প্রতিদিন এয়ারপোর্টে দেখা যায় তার মতো অনেক নারী বিদেশে কাজ করতে গিয়ে স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। সফল বিদেশ ফেরত নারী ছাড়াও কেউবা প্রতারিত হয়ে ফিরে আসছেন আবার কেউবা ফিরছেন শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে। অনেকে অনাকাঙ্খিতভাবে গর্ভধারণ করে দেশে ফিরছেন। নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে এখানে দেশে ফিরে আসলে তাদের কথা শোনার লোক দেশে-বিদেশে খুব বেশি নেই। সমস্যা সুরাহা করার বিশ্বস্ত কেউ পাশে থাকেন। এভাবে ফিরে আসার পর সমবেদনা দেওয়া বা সহযোগিতা করার জন্য কম প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারপরও সম্ভাব্য বিপদ জেনে স্বপ্নারা আবার ঝুঁকি নিয়ে জীবিকার তাগিদে বিদেশে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। পুনরায় আবার এই চক্রে পড়ে নির্যাতন ও শোষণের গল্প নিয়ে ফিরে আসেন।

আমাদের দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের মধ্যে কৃষি, তৈরি পোশাক শিল্প ও বিদেশে কর্মসংস্থান বা লেবার মাইগ্রেশন- এই তিনটি সেক্টর আমাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে বেশ অবদান রাখছে। গৃহকর্ম বা ঘর গৃহস্থলি ছাড়াও এই সেক্টর সমূহে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করছেন। আগে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে পিছিয়ে থাকলেও নারীরা বর্তমানে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশে কাজ করার সাহস করছেন। ২০১৭ সালে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি নারীকর্মী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে যায় যা আমাদের শ্রম অভিবাসনের জন্য একটি রেকর্ড। যদিও সরকারিভাবে ১৯৯১ সালে নারীদের বিদেশে কাজের সুযোগ হয়েছিল কিন্ত গত ৫ বছর ধরে বিদেশে নারী কর্মীর যাওয়ার আগ্রহ বেশি পরিমাণে তৈরি হচ্ছে ও তুলনামূলকভাবে যাওয়ার সংখ্যাও বেড়েছে। সরকারি তথ্য মতে, শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় পৌনে ৮ লাখ নারী কর্মী বিদেশে যায়। শুধু এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৮০ হাজার নারীকর্মী বিদেশে চাকরি পেয়েছেন যাদের বেশিরভাগ যান সৌদি আরবের গৃহকর্মের পেশায়। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুরুষ কর্মীরা যাওয়ায় সুযোগ পাচ্ছেন যে তুলনায় নারী কর্মীদের বেশিরভাগের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের সীমিত কয়েকটি দেশে।

পুরুষের পাশাপাশি বর্তমানে আমাদের নারীরাও বিদেশে গিয়ে চাকরি করছেন যা একটি সাহসী পদক্ষেপ। তাদের বিদেশে চাকরি খোঁজা দেশের অর্থনীতি ও বেকারত্ব দূরীকরণে একটি বড় সুযোগ। কিন্তু বিদেশে তাদের কাজের এই সুযোগটিকে আমরা কতোটুকু ঝুঁকিমুক্ত, মর্যাদাপূর্ণ ও লাভজনক করতে পেরেছি ভেবে দেখার সময় এসেছে এখন। সম্প্রতি বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট এবং ফিরে আসা অভিবাসীর মুখে বিদেশের গল্প শুনলে বোঝা যায়- সফলতা ছাড়াও ব্যর্থতার নানান ধরনের নেতিবাচক চিত্র আমরা দেখতে পাই যা অনাকাঙ্খিত এবং নারীর কর্মসংস্থান খোঁজার জন্য প্রতিবন্ধক। প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা বিমান বন্দরে ফেরত আসা নারীদের মধ্যে দেখা যায় নির্যাতন আর কান্নার করুণ আর্তি।

তাদের মনে ও শরীরে রয়েছে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন যা অপ্রকাশিত থেকে যায় সবসময়। একটি রঙ্গিন স্বপ্ন তাকে তাড়িত করে দেশের সীমানা পার হয়ে বিদেশে নিয়ে গেলেও অন্ধকারের কালোছায়া তাদের স্বপ্নকে গ্রাস করে। ফলে লালিত স্বপ্নটি অধরা থেকে যায় বারবার। জীবনে নেমে আসে দূর্ভোগ ও রচিত হয় স্বপ্ন ভঙ্গের মহাকাব্য।

বাংলাদেশ থেকে গত কয়েক বছরে নারী কর্মীর বিদেশে যাওয়ার হার বেড়ে গেছে এবং পুরুষের পাশাপাশি তাদের প্রেরিত রেমিটেন্স অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সহায়তা করছে। আগে নারীদের বিদেশগমন বিষয়ে অপর্যাপ্ত তথ্য ও সুযোগ কম হওয়াতে বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা ছিল নগন্য। তবে গত কয়েকবছরে বিদেশে গার্মেন্ট ভিসা ছাড়াও বাঁচার তাগিদে গৃহকর্মীর ভিসায় নারীকর্মীরা যেতে আগ্রহী হচ্ছেন। বিনা খরচে তারা এই ভিসায় বিদেশে গেলেও কর্মীর বেতন খুব কম, বিপরীতে শোষণ ও নির্যাতনের মাত্রা অন্য পেশায় চেয়ে বেশি ঘটে।

এ প্রেক্ষাপটে মনে করি গৃহকর্মী কম পাঠিয়ে গার্মেন্টে ছাড়াও অন্যান্য ট্রেড বা শোভন কাজে বিদেশে নারীদের পাঠালে অভিযোগ ও সমস্যা যেমন কম হবে, তেমনি আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারবো।

এছাড়াও জরুরী আরেকটি বিষয় হল- নারীদের বিদেশে পাঠানোর আগে মানসিক স্ক্ষমতা যাচাই, চাকরিটি  লাভজনক কিনা, কাজের উপর প্রশিক্ষণ ও ভাষা শিক্ষা, বিদেশে কাজের সুযোগ, আবহাওয়া ও খাদ্যাভাস এবং সম্ভাব্য সমস্যা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। সম্প্রতি সরকার বিদেশে নির্যাতিত নারীদের সমস্যা সমাধানে সকল পর্যায়ের বিভিন্ন পেশাজীবী সংস্থা ও এনজিওদের সাথে কাজ এক হয়ে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে। বিষয়টি সমসাময়িক হওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ কারণ সমস্যাটি জিইয়ে রাখলে নারী অভিবাসন বিষয়ে নেতিবাচক তথ্য তৈরি হবে যা কাম্য নয়।

তবে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এই পরিকল্পনার সাথে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর আগে সম্ভাব্য ঝুঁকি ও বিরাজমান সমস্যা চিহ্নিত করে সামনে এগোতে হবে। দেশে প্রশিক্ষণ ছাড়াও বিদেশে বিপদগ্রস্ত নারী কর্মীদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়ানো  এবং পুনরেকত্রীকরণের উদ্যোগ নেয়া জরুরী। বিদেশে আমাদের লেবার উইংস বা শ্রম শাখাকে শক্তিশালী করা ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে ফেরত আসা নির্যাতিতদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে নারী অভিবাসন নিরাপদ হবে, পুনরেকত্রীকরণে সফলতা আসবে। আমরা চাই স্বপ্নের অভিবাসনের মাধ্যমে আমাদের নারীরা অর্থনৈতিক মুক্তির সিঁড়িতে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে, দেশ নানাভাবে সমৃদ্ধ হবে।