এবারের ভোট: রিকনসিলিয়েশন বনাম গণহত্যা

স্বদেশ রায়
Published : 19 Dec 2018, 01:32 PM
Updated : 19 Dec 2018, 01:32 PM

কোনও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বা বিপ্লবের পরে জাতীয় ক্ষেত্রে সকলকে একত্রিত করে মূলধারায় আনা (রিকনসিলিয়েশন) প্রয়োজন হয়। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, সব ধরনের স্বাধীনতা সংগ্রামে বা বিপ্লবে সচেতনভাবে কিছু স্বাধীনতা বা বিপ্লববিরোধী থাকে। আবার পরিস্থিতির শিকার হয়েও একদল বিরোধিতা করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের পরে প্রয়োজন হয় ওই বিরোধিতাকারী বা  কোলাবরেটর নেতাদের শাস্তি দিয়ে বাদবাকিদের স্বাধীনতা বা বিপ্লবের ধারায় নিয়ে আসা। যাতে ওই ভূ-খণ্ডে স্বাধীনতা বা বিপ্লববিরোধী কেউ না থাকে এবং পরবর্তী প্রজন্মে কোনওমতেই স্বাধীনতা বা বিপ্লববিরোধী কোনও চিন্তা-চেতনা প্রবাহিত না হয়। পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী চিন্তা-চেতনা লালিত হয় এমন কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক সংগঠন যাতে কোনওক্রমে ওই ভূ-খণ্ডে গড়ে না ওঠে, তা নিশ্চিত করতে হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলামী ও মুসলীম লীগ প্রভৃতি দলের নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর ও রাজাকার বাহিনী গড়ে উঠেছিল। একদল মানুষ ওই সব বাহিনীতে স্বেচ্ছায় ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে যোগ দিয়েছিল। আরেক দল পরিস্থিতির শিকার হয়ে যোগ দিয়েছিল।

তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, লাখ লাখ মা-বোনের আব্রু নষ্ট করা হয়েছিল। লুঠ-তরাজ, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাও ঘটানো হয়েছিল লাখ লাখ ক্ষেত্রে। শিশু হত্যা, ভ্রুণ হত্যা সবই ঘটিয়েছিল তারা। এরাই মূলত পাকিস্তানি বাহিনীকে সব ধরনের অপকর্ম করতে সহায়তা জুগিয়েছিল। স্বাধীনতার পরে এদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, অনেকের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ তখন সমস্যায় জর্জরিত।

তার পরেও বঙ্গবন্ধু রিকনসিলিয়েশনের বিষয়টি হাতে নেন। তিনি তেত্রিশ হাজার চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী অপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে, তাদের জেলে আটক রেখে বাদবাকিদের সাধারণ ক্ষমা করেন। এই সাধারণ ক্ষমা ও পাশাপাশি প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া চালু রেখে বঙ্গবন্ধু রিকন্সিলিয়েশন বা সকলকে মূলধারায় অন্তর্ভূক্তির কাজ শুরু করেন। অন্যদিকে সাংবিধানিকভাবে দেশে এমন পরিবেশ তৈরি করেন, যাতে এই সাধারণ অপরাধীরা স্বাধীনতার ধারায় ধীরে ধীরে চলে আসতে বাধ্য হয় এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বাধীনতাবিরোধী হওয়ার কোনও সুযোগ তৈরি না হয়। এ লক্ষ্যে সংবিধানে ধর্মভিত্তিক কোনও রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা নিষিদ্ধ করেন। পাশাপাশি কোলাবরেটরদের ভোটাধিকার বাতিল ও নির্বাচনে প্রতিযোগিতায় অযোগ্য ঘোষণা করেন সাংবিধানিকভাবে। এর সঙ্গে তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ এমন পথে লালন করা হচ্ছিল যে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে কারও বেড়ে ওঠার কোন সুযোগ ছিল না। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, পৃথিবীর সব দেশেই রিকন্সিলিয়েশন হয় স্বাধীনতা বা বিপ্লবের চেতনায়- যাতে ভবিষ্যতে এক চেতনায় একটি জাতি বা মানবগোষ্ঠী গড়ে ওঠে এবং ওই মানবগোষ্ঠীর হেজিমনি ও মানসিক চেতনা স্বাধীনতা বা বিপ্লবের ধারায় বেড়ে ওঠে।

এখানে সব থেকে গুরুত্ব দিতে হয় মানসিক কর্তৃত্ব বা হেজিমনির ওপর। যাতে রিকনসিলিয়েশন সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতার মৌল চেতনায় হয়, তা না হলে ওই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। যে লক্ষ্যে স্বাধীনতা অর্জন করা হয়েছিল, তা কখনও পূরণ হয় না। বঙ্গবন্ধু সেই ধারায় এগুচ্ছিলেন। কিন্তু সেই অভিযাত্রা থামিয়ে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভেতর দিয়ে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব থেকে স্বাধীনতার মৌল চেতনা ফেলে দেয়া হয়। সেখানে স্বাধীনতাবিরোধী অর্থাৎ  কোলাবরেটরদের চেতনা ও তাদের মূল উৎস পাকিস্তানের সেই ধর্ম ব্যবসায়ী রাষ্ট্রের চিন্তা-চেতনার যাত্রা শুরু করা হয়। আর একের পর এক সামরিক ফরমান বলে সংবিধান থেকে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে স্বাধীনতার চেতনার কর্তৃত্ব ছেঁটে ফেলা শুরু হয়। ধীরে ধীরে রাষ্ট্র কর্তৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিষ্ঠা করা হয়।

কাজটি যদিও শুরু হয়েছিল খোন্দকার মোশতাকের হাত দিয়ে, তবে তা দৃঢ় রূপ পায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের হাতে। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজে সর্বত্রই স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও আলবদরদের প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতার চিন্তা-চেতনার কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে রাজাকারদের চিন্তা-চেতনার রাজত্ব কায়েম করতে নেমে পড়েন। যার ফলে বাংলাদেশ একটি মিনি পাকিস্তান হিসেবে রূপ নেয় রাষ্ট্রিকভাবে।

এক্ষেত্রে জিয়ার অনুসারীদের বক্তব্য হলো, জিয়া একটি রিকনসিলিয়েশন করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতাবিরোধী ও স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির ভেতর সম্মিলন ঘটিয়ে জাতিকে এক করেছিলেন। শুধু এখানেই শেষ নয়, জিয়ার অনুসারীরা এক্ষেত্রে বাংলাদেশে যারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও কর্তৃত্ব বাঁচিয়ে রাখল, তাদের দোষারোপ করেন। তারা বলেন, এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির কথা বলে, দেশের মানুষকে বিভক্ত করে রেখেছে। এখানে বাস্তবতা হলো জিয়া রিকনসিলিয়েশন করেছিলেন স্বাধীনতাবিরোধীর চেতনার কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করে। তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের চেতনার অধীনে, তাদের হেজিমনির অধীনে স্বাধীনতার পক্ষের বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। সেই লক্ষ্যেই তিনি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব, সামাজিক প্রভাব ও রাজনৈতিক অঙ্গন গড়ে তোলার পথে নামেন।

সামরিক শাসক থেকে রাজনৈতিক নেতা হওয়ার জন্য জিয়ার এভাবে রাজাকার-আলবদরদের প্রতিষ্ঠা করার দরকার ছিল না। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতার চেতনায় রাষ্ট্র পরিচালনা, রাজনৈতিক দল গঠন ও সামাজিক পরিবেশ তৈরি করতে পারতেন। প্রকৃত উদ্দেশ্য রিকনসিলিয়েশন থাকলে তিনি নির্দিষ্ট অপরাধে অপরাধী তেত্রিশ হাজার রাজাকার-আলবদরকে মু্ক্তি না দিয়ে তাদের বিচার চালু রাখতে পারতেন। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের হেজিমনি যাতে ধীরে ধীরে সকল স্বাধীনতাবিরোধী মেনে নেয়, সেই পথে দেশকে এগিয়ে নিতে পারতেন। বন্ধ করতে পারতেন পরবর্তী প্রজন্মে যাতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চেতনা প্রবাহিত না হয়। তার বদলে সমাজে, রাষ্ট্রে ও রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ও পক্ষ শক্তিতে ভাগ করার সুযোগ সৃষ্টি করেন জিয়া। স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির যে বিলোপ ঘটেছিল, জিয়া তাদের প্রতিষ্ঠিতই শুধু করেন না, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে সমাজে দাঁড়ানোর পথ করে দেন।

রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের এই আধিপত্য সৃষ্টি করে দেয়ার পরে দেশের স্বাধীনতার চেতনার মানুষগুলো অন্তত সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে যতটা পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বজায় রাখতে জীবন বাজি রেখে নেমে পড়তে বাধ্য হয় তখন। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা স্বাধীনতার চেতনা তারা জীবন বাজি রেখেই অর্জন করেছিল।

জিয়া মুক্তিযুদ্ধের বা স্বাধীনতার চেতনার পক্ষে না গিয়ে কেন এ পথে গেলেন? এর উত্তর, স্বাধীনতার চেতনার পক্ষে গেলে জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হতো এবং হয়ত সেটা সম্ভবও ছিল না। কারণ স্বাধীনতার চেতনার পথের রাজনৈতিক দল হিসেবে তখন আওয়ামী লীগ, মোজাফফর ন্যাপ, সিপিবি ও জাসদ প্রতিষ্ঠিত অবস্থায় ছিল। এ কারণে রাজনৈতিকভাবে সহজ অবস্থান তৈরি করার জন্য জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও বিপক্ষের শক্তিতে ভাগ করে ফেললেন। তিনি নিজে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির নেতা হলেন। আর নিজেদের এই সহজ অবস্থান ধরে রাখার জন্য এখনও তার দল দেশে এই বিভক্তি রেখেছে। রাজকার পরিবারের সন্তানদের একটি বড় অংশকে স্বাধীনতার চেতনায় দেশকে ভাবতে শিখতে দিল না তারা। মূলত তাদেরকে এক ধরনের রাজনৈতিক প্রতিবন্ধী করে রেখেছে। কারণ বিএনপি (জিয়ার দল) জানে গোটা দেশের মানুষ স্বাধীনতার মৌল চেতনায় প্রবাহিত হলে, স্বাধীনতার হেজিমনি শতভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের আর কোনও অস্তিত্ব থাকে না। এভাবে জিয়া, সাত্তার ও এরশাদ টানা একুশ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে দেশের মানুষকে বিভক্ত করে রেখেছে। এর পরে খালেদা জিয়া দুইবারে দশ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে একইভাবে দেশকে বিভক্ত করে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন।

বেগম জিয়ার জন্য সুযোগ ছিল ১৯৯১ থেকে স্বাধীনতার পক্ষের আরেকটি রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠার। তিনি সে সুযোগ না নিয়ে প্রত্যক্ষ জামায়াতের সমর্থন নেন। তবে এটাও সত্য, বেগম জিয়ার এর বাইরে যাওয়ার কোনও পথ নেই। কারণ, তার দলের কর্তৃত্ব ও কাঠামো স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে। তাছাড়া বেগম জিয়া ১৯৭১-এ পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। জিয়া তাকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠালেও তিনি যাননি। সব মিলে তিনি স্বাধীনতারবিরোধী পক্ষকে লালন করবেন এটাই স্বাভাবিক।

যা হোক, ২০০৮-এ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, সে সময়ের শেখ হাসিনা অনেক পরিণত একজন নেতা। এর আগে তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত টানা দশ বছর রাজপথের মূল নেতা ছিলেন। তাছাড়া তিন বারের বিরোধী দলের নেতা ও একবারের প্রধানমন্ত্রী। এই বিশাল অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার নিয়ে শেখ হাসিনা ২০০৮-এ ক্ষমতায় আসেন। শেখ হাসিনার ২০০৮-এর ক্ষমতায় আসার আগের সব থেকে বড় বিষয় হলো ক্ষমতায় আসার পূর্ব প্রস্তুতি।

শেখ হাসিনার গত দশ বছরের রাষ্ট্র পরিচালনা যদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং ২০০৮-এর নির্বাচনী ইশতেহার পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় কতটা প্রস্তুতি নিয়ে তিনি ২০০৮-এ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন। এই পরিণত রাজনৈতিক নেতৃত্ব শেখ হাসিনা তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশের জনগোষ্ঠীকে একটি বৃত্তের মধ্যে নিয়ে আসার রিকনসিলিয়েশন কাজে মনোযোগী হন। পৃথিবীর সব দেশে যেভাবে স্বাধীনতার পরে রিকনসিলিয়েশন হয়, বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাকে ওই কাজটি সাড়ে তিন দশক পরে এসে শুরু করতে হচ্ছে। এতটা দীর্ঘ সময় পরে এ কাজ অনেক জটিল হয়ে গেছে। তার পরেও দেশের স্বার্থে, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার স্বার্থে সর্বোপরি মানুষের স্বার্থে ওই জটিল ও কঠিন কাজে হাত দেন শেখ হাসিনা। পৃথিবীর সব দেশ স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তরকালে যা করে, শেখ হাসিনাও সেই কাজ শুরু করেন। তিনি স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী, দেশের মানুষ হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বিচার কাজ আগে শুরু করেন। অন্যান্য দেশে এই বিচার কাজ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আদালতের মাধ্যমে শেষ করা হয়। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা না করে তাদের উচ্চ আদালতে আপিল করার যাবতীয় সুযোগ দিয়ে প্রায় ৮ বছর সময় নিয়ে যুদ্ধাপরাধীর মূল নেতাদের বিচার ও শাস্তি শেষ করেছেন।

এ কাজে শেখ হাসিনা দেশের নতুন প্রজন্মের বড় একাংশের সমর্থন পেয়েছেন ঠিকই, তবে সকলের পাননি। এই না পাওয়ার কারণ, জিয়াউর রহমান দেশকে যে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তিতে ভাগ করে গেছেন সে জন্য। জিয়ার দল স্বাধীনতার বিপক্ষ চেতনা তরুণ শ্রেণির একাংশের মধ্যে লালিত হবার সুযোগ তৈরি করছে সারাক্ষণ। তার পরেও যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বিচার শেষ করে শেখ হাসিনা দেশের মানুষের মধ্যে রিকনসিলিয়েশন প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন কাজে হাত দেন।

তিনি লক্ষ্য করেন, জিয়ার দল বিএনপি ও যুদ্ধাপরাধী দলের উস্কানিতে দেশের অন্যতম প্রাচীন ও ধর্মীয় শিক্ষা পদ্ধতির শিক্ষালয় মাদ্রাসার কোমলমতি তরুণ ছেলেদের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কাজে লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে। শেখ হাসিনা এটা লক্ষ্য করে তাদের স্বাধীনতার মূলধারা ও জাতীয় জীবনের মূল ধারায় আনার কাজে হাত দেন। ধর্মীয় শিক্ষালয়ের একটি অংশ অর্থাৎ কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের তিনি এই ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য গত কয়েক বছর কাজ করেছেন। এ কাজে তিনি এখন অনেক সফল। শেখ হাসিনা এখানে কোনও মৌখিক রাজনৈতিক স্লোগান নিয়ে কাজ করেননি। তিনি বাস্তবতার পথ নিয়েছেন। তিনি ওই শিক্ষালয়ে শিক্ষা নেয়া ছাত্রদের মূল ধারায় আনার পথে তাদের শিক্ষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছেন। অর্থাৎ মূল ধারায় আনার শুরুটা অন্তত করেছেন।

শেখ হাসিনার এই কাজের ভেতর দিয়ে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে, তিনি এবারের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে ক্ষমতায় এলে আগামী পাঁচ বছরে দেশে রিকনসিলিয়েশনের কাজটি সম্পন্ন করবেন। অর্থাৎ দেশে আর স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি বলে কোনও ভাগ থাকবে না। সকলেই স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি হবে। অর্থাৎ এক জাতি, এক প্রাণ। দেশের সব মানুষকে তিনি একটি মিলনের সুতায় বাঁধবেন। তাই তিনি বার বার বলছেন, আমরা দেশটাকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চাই যাতে দেশ আর কোনওদিন পেছনের দিকে না যায়। অর্থাৎ দেশের সবাই যখন স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি হবে, তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেই আসুক না কেন, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনও নীতির পরিবর্তন হবে না। ব্রিটেন বা আমেরিকায় যেমন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের পরে মৌলিক কোন নীতির পরিবর্তন হয় না, বাংলাদেশও তেমনি হবে। আর বাস্তবে শেখ হাসিনা দেশকে ও নিজেকে সেখানে নিয়ে এসেছেন। এবারের নির্বাচনে তার বিজয়ের অর্থই হলো দেশ এই অবস্থানে যাবে। আর কেউ স্বাধীনতাবিরোধী চিন্তা ধারণ করে দেশকে পেছনে নিয়ে যেতে পারবে না।

এ কারণে দেশের জন্য এখন একমাত্র বিপদ যদি ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জামায়াত-বিএনপি ঐক্যফ্রন্ট জয়লাভ করে। কারণ এই জোটের মূল ভিত্তি হলো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধী জামায়াত তাদের মূল চালিকাশক্তি। গত দশ বছরে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। সাজা হয়েছে। এমনকি সাজা হয়েছে যারা যুদ্ধাপরাধীদের লালন করে তাদেরও। তাই এদের প্রতিপক্ষ স্বাভাবিকই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল মানুষ। তারা ক্ষমতায় এলেই তাদের প্রতিশোধের আগুনের শিখা পেট্রোলবোমার থেকে আরও হাজার গুণ শক্তি নিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে।

তাদের বিজয় মানেই প্রথম দিনেই বাংলাদেশে কয়েক লাখ প্রগতিশীল মানুষ হত্যার ভেতর দিয়ে তারা রক্তের হোলি খেলা শুরু করবে। তাদের ফ্রন্টে যে সব কম-বেশি সুস্থ চিন্তার মানুষ আছে, তাদেরও কোনও ক্ষমতা থাকবে না। তাদের বিজয়ের পরে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা ধরে সারাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির যে নরহত্যা করবে তা ঠেকানো। পাশাপাশি তারা যে ঠেকাতে চায় না, তাও কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তাদের দলের মূল নেতা ড. কামালের বক্তব্য থেকে বোঝা গেছে।

জামায়াত নিয়ে প্রশ্ন করা সাংবাদিককে তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, 'চিনে রাখলাম' এবং তার পরে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, 'আর তো মাত্র ষোলো দিন আছে।' অর্থাৎ ষোলো দিন পরে ওই চিনে রাখা সাংবাদিকসহ তাদের তালিকা তারা ১৯৭১ এর মতো বাস্তবায়িত করবে। আর তারা কিভাবে পুলিশ, বিডিআর, আর্মি ও সাধারণ মানুষ হত্যা করে, তা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের পরে এ দেশের মানুষ দেখেছে। বিরোধী দলে থেকেও তারা ওইভাবে হত্যা করেছে, তা হলে ক্ষমতা পেলে কত বড় গণহত্যা করবে তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

আরও বাস্তবতা হলো, এই অপশক্তি যদি ক্ষমতায় আসে তা হলে এবার যে লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী হত্যা হবে, তাদের স্মরণে কোনও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের সুযোগও এ ভূখণ্ডে থাকবে না। এই ভূখণ্ডে যাতে আগামী এক শ' বছরে কোনও প্রগতিশীল চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেই ব্যবস্থাই তারা করবে। সেভাবেই তারা সব সেক্টরের প্রগতিশীল ও তাদের সমর্থকদের হত্যা করবে। ড. কামাল যেখানে বলছেন 'চিনে রাখলাম', সেখানে শিবির, জামায়াত  ও বিএনপি কর্মীরা কী করবে তা সহজেই বোঝা যায়।

স্বাভাবিকভাবে এবারের নির্বাচন সামনে রেখে সব থেকে বড় প্রশ্ন হলো, দেশের মানুষ কি একটি মিলনের মহাক্ষেত্র বা রিকনসিলিয়েশন দেশ চায়, না আবার গণহত্যা হোক সেটাই চায়? আর এটা এখন স্পষ্ট, শেখ হাসিনাকে ভোট দিলে মহামিলন, আর ড. কামালের নেতৃত্বের ঐক্যফ্রন্ট বা জামায়াত-বিএনপিকে ভোট দিলে ভয়াবহ গণহত্যা।

তাই এবারের নির্বাচন দেশের মানুষের সামনে রিকনসিলিয়েশন বনাম গণহত্যার নির্বাচন হিসেবেই সামনে এসেছে। এখন দেশের মানুষেরই সব থেকে বড় দায় দেশকে গণহত্যার হাত থেকে বাঁচানো।