ড. কামাল হোসেনের মেজাজ হারানো, ভুল ও ক্ষমা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 17 Dec 2018, 01:05 PM
Updated : 17 Dec 2018, 01:05 PM

তিনি রাজাকারের দলের সঙ্গে জোট করেছেন। তার নির্বাচনী জোট ঐক্যফ্রন্টে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন নিয়ে নির্বাচন করছে। জামায়াতে ইসলামী নামে দলটি একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের প্রাক্কালে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করেছে। সেই ১৪ ডিসেম্বর তিনি যখন মিরপুরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গিয়েছেন, তখন খুব স্বাভাবিক ও সঙ্গত কারণেই জামায়াতে ইসলামী নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়।  হ্যাঁ, পেশাগত কারণে সাংবাদিকরা একটু নাছোড় হয়, তাই হয়তো বার বার একটা প্রশ্ন করেছেন। আর প্রশ্নটাও নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাতেই কেন মেজাজ হারান ঐক্যফ্রন্ট প্রধান ড. কামাল হোসেন? জামায়াতে ইসলামীর প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেনের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, 'কত পয়সা পেয়েছো এসব প্রশ্ন করতে? চিনে রাখবো। কত পয়সা দিয়েছে? চুপ করো, খামোশ।'

ছিঃ কামাল হোসেন, ছিঃ, এই আপনার আচরণ? 'কত টাকা নিয়েছ?' এই কথা কি আপনার মুখে শোভা পায়? এর মাধ্যমে যে আপনি সাংবাদিকতা পেশাটাকেই অপমান করলেন! আর 'চিনে রাখার' ভয় দেখিয়ে তো আপনি একজন অর্ধশিক্ষিত পাড়ার মাস্তানের সঙ্গে নিজের কোনো পার্থক্যই রাখলেন না!

যে জোট গঠন করে আপনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখছেন এবং দেখাচ্ছেন, সেই জোটে তো জামায়াতও আছে। জামায়াত যেখানে আছে, সেই জোটের নেতা হয়ে আপনি কীভাবে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে যান? আপনার বিবেকে কি একটুও বাধে না? হে মহানাগরিক, এই বিজয়ের মাসে এর জবাব আপনাকে যে দিতেই হবে!

দুই.

ঘটনার পরের দিন গণমাধ্যমে একটি চিঠি পাঠিয়ে ড. কামাল হোসেন ক্ষমা চেয়েছেন। ক্ষমা চাওয়ার মতো সৎসাহস তার আছে। এটা বিরল দৃষ্টান্ত। খুবই ভালো একটা উদ্যোগ। ক্ষমা একটা মহৎ গুণ। যেই সংবাদকর্মীর প্রতি তিনি রুষ্ট হয়েছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই তাকে ক্ষমা করে দেবেন। তবে ক্ষমা চাওয়ার আগে এবং ক্ষমা পাওয়ার পরেও আমাদের যেটা জানা থাকলো তা হলো ড. কামাল হোসেন সাহেবের গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক আচরণের নমুনা। তবে তিনি ক্ষমা চেয়ে যে চিঠি পাঠিয়েছেন, সেখানে যে ব্যাখ্যা ও যুক্তি দিয়েছেন তাতে মনে হয়েছে তিনি সম্ভবত আইন চর্চা ছেড়েছেন অনেক আগে, অথবা তিনি ড্রাফ্টটা দেখার সময় পাননি। তাইতো তার উত্তেজিত হওয়ার গল্পটা একটুও জমেনি। তিনি যে কারণগুলোর কথা বলেছেন, তা কেমন খোঁড়া অজুহাত মনে হয়েছে। সাংবাদিক বা জনগণকে তিনি হয়ত কোর্টের মতো অতোটা গুরুত্ব দেন না! বয়সও এর একটা কারণ হতে পারে। তবে তার ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়!

তিন.

মানুষ মাত্রই কিন্তু ভুল হয়। আপনি যেই হোন না কেন, যত বড় পণ্ডিত কিংবা যতই নিরেট মূর্খ, মানুষের ভুল হয় এবং ভুল হতেই পারে। আমাদের দেশের মানুষের, বিশেষ করে দায়িত্ববান মানুষের যেন ভুলটা আরও বেশি বেশি হয়। কিন্তু এদেশে কেউ ভুল স্বীকার করেন না। প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা না, রাজনীতিবিদরা না, ব্যবসায়ীরা না, এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও না। তাহলে কি এদেশে কেউ ভুল করেন না?

ভুল স্বীকার করাকে কখনওই নিরুত্সাহিত করা উচিত নয়। কেননা, ভুল স্বীকার করা একটি ইতিবাচক মানবিক ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মে তো ক্ষমাপ্রার্থনার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মেই এই ক্ষমাপ্রার্থনার বিশেষ গুরুত্ব আছে।

আসলে ভুল স্বীকার করতেই হবে। ভুল থেকেই 'ঠিক'-এ যেতে হয়। যেমন অন্ধকার থেকে আমরা আলোর পথযাত্রী। ঠিক সেভাবেই অসত্য থেকে সত্যের পথে যাত্রা। ফরাসি দার্শনিক রাসেল এক বার মজা করে বলেছিলেন, মাঝে মাঝে ভ্রম হয় যে আমরা একটা সত্য থেকে আর একটা সত্যে যাচ্ছি নাকি একটা অসত্য থেকে আর একটা অসত্যের পথে যাচ্ছি। কারণ, আজ যেটাকে সত্য বলে আঁকড়ে ধরছি, সেটা কাল হয়ে যায় হাইপোথিসিস। আসলে, আমরা একটা হাইপোথিসিস থেকে আর একটা হাইপোথিসিসেই হাঁটছি!

সেদিক থেকে 'ভুল' ও 'ক্ষমা'ও একটা হাইপোথিসিস!

চার.

চীনে একটি কোম্পানি ছিল, হয়তো এখনও আছে। বেশ কয়েক বছর আগে তার কথা লিখেছিলেন এক মার্কিন সাংবাদিক। কোম্পানিটির কাজ ক্ষমা চাওয়া। অন্যের হয়ে ক্ষমা চাওয়া। তাদের স্লোগানই হলো: আমরা আপনার হয়ে 'সরি' বলব। ব্যাপারটা কী? আসলে ও দেশের মানুষ চট করে ক্ষমা চাইতে পারেন না। সাহেবরা যেমন কথায় কথায় 'হা-ই, সরি অ্যাবাউট দ্যাট' বলে কাঁধ ঝাঁঁকিয়ে সব দু:খ-টু:খ ঝেড়ে ফেলে নিজের কাজে চলে যেতে পারেন, চীনে অনেকেরই এখনও সেটা রপ্ত হয়নি। এ ব্যাপারে বাঙালি-চীনা ভাই ভাই বলা যায়, আমাদের এ-দিকেও অনেকেই এখনও সাহেবি কেতাবে তেমন অভ্যস্ত হননি, পথে-ঘাটে, বাজারে মার্কেটে কিংবা ট্রেনে-বাসে কারও পা মাড়িয়ে দিয়ে 'সরি' বললে নিস্তার মেলে না, উল্টো মুখঝামটা খেতে হয়, 'ওই এক বুলি শিখিয়ে দিয়ে গেছে ইংরেজরা, বললেই অমনি সাত খুন মাপ হয়ে গেল!'

তবে ভাইয়ে ভাইয়ে সবকিছু তো আর মেলে না, একটা ব্যাপারে চীনের লোকেরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ওস্তাদ। ওরা ব্যবসাটা ফাটাফাটি বোঝেন। ক্ষমা চাইতে লজ্জা, 'সরি' বলতে অস্বস্তি এই স্বভাবটাকেই দিব্যি পুঁজি বানিয়ে কেউ কেউ লক্ষ্মীর সাধনায় নেমে পড়েছেন। যেমন, ওই কোম্পানিটি। ওরা ক্রেতাদের নানা রকম প্যাকেজ বিক্রি করেন। ক্ষমা চাওয়ার প্যাকেজ। ধরা যাক, দুই বন্ধুর বেধড়ক ঝগড়া হয়েছে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তারপর এক দিন, যেমন হয়, এক বন্ধুর মনটা হু-হু করে উঠল। হয়তো অন্যেরও। কিন্তু বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না, বরফও গলে না। এসব বিপদে তৃতীয় বন্ধুর একটা ভূমিকা থাকে, কিন্তু সমাজ পালটেছে, ভাল বন্ধুর সংখ্যা কমেছে, তেমন বৃন্দা দূতী মেলা কঠিন। এখানেই মুশকিল আসান কোম্পানির প্রবেশ। ওদের সাফ কথা: ক্ষমা চাইতে চান, কিন্তু লজ্জা পাচ্ছেন? চলে আসুন আমাদের কাছে, বলুন আপনার কেস হিস্ট্রি, জানিয়ে দিন কতটা জোর দিয়ে সরি বলতে চান। আমরা আপনার চাহিদা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা করে দেব। আমাদের লোক চিঠি লিখবে, ফোন করবে বা সশরীর চলে যাবে আপনার অভিষ্ঠ মানুষটির কাছে, যথাযথ ভাষায় ও ভঙ্গিতে ক্ষমা চেয়ে আসবে তার কাছে। শুকনো সরি-র সঙ্গে যদি কিছু উপহার দিতে চান, তার ব্যবস্থাও আমরাই করে দেব। দাম প্যাকেজ অনুসারে।

এ কোনও শখের কারবার নয়। ওই কোম্পানিতে যারা কাজ করেন, মানে ক্ষমা চেয়ে বেড়ান, তারা রীতিমত শিক্ষিত, সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে আছেন শিক্ষক, আইনজীবী, সমাজকর্মী। তারা স্বভাবে শান্ত, মগজে বিচক্ষণ, চমৎকার কথা বলেন। তার ওপর তাদের বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়। ক্ষমা চাইবার ট্রেনিং, যাতে তারা আরো দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন। একটা ব্যাপার খেয়াল করা ভাল। এই কাজে দক্ষতার মূল্যায়ন বেশ সহজ। ক্ষমা চাইবার ফলে মনোমালিন্য মিটল কি না, দূরত্ব কতটা কমল, সেটাই বলে দেবে, পেশাদার ক্ষমাপ্রার্থী তার পেশায় কতটা সফল।

মার্কিন সাংবাদিকটির লেখার সূত্র ধরে চীনের এই কোম্পানিটির কথা জানিয়েছেন মাইকেল স্যান্ডেল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রবীণ অধ্যাপক ন্যায়, নীতি, নৈতিকতা নিয়ে অসামান্য সকল লেখা লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। 'জাস্টিস' নামে তার বক্তৃতামালা আক্ষরিক অর্থেই বিশ্ববিশ্রুত। বছর দুই আগে প্রকাশিত তার লেখা 'হোয়াট মানি কান্ট বাই' নামক একটি স্বল্পকায় বইয়ে তিনি আলোচনা করেছেন, আমাদের জীবনের সমস্ত অন্ধিসন্ধিতে বাজার কীভাবে অনুপ্রবেশ করেছে, এমন অনেক কিছুর দখল নিয়েছে যা আমরা আগে বাজারের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারতাম না। ক্ষমা চাওয়ার চিনাবাজার নিয়ে আলোচনা এসেছে সেই সূত্রেই। খেয়াল করা দরকার, এ বাজার পশ্চিম দুনিয়ায় হয়নি। হবে না, কারণ সেখানে মানুষ অনায়াসে এবং অবলীলাক্রমে ক্ষমা চায়। চীনের মতো দেশে ক্ষমা চাওয়া মানে মুখের কথা নয়, সত্যিই মাথা হেট করা। 'সরি' বলাটাকে লোকে সিরিয়াসলি নেয় বলেই সহজে বলতে পারে না, পারে না বলেই এই নিয়ে দিব্যি একটা ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এটা আপাতদৃষ্টিতে একটা প্যারাডক্স বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে এখানেই বাজারের ক্ষমতা। যা কিছু আমাদের কাছে মূল্যবান, বাজার তাকেই আত্মসাৎ করে, সেই মূল্যকে মুনাফায় রূপান্তরিত করে ফেলে! সে পেশাদার প্রতিনিধিকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানোই হোক, হিরের আংটি কিনে ভালোবাসা জানানোই হোক। তাতে শেষ পর্যন্ত মানবিক অনুভূতিগুলোর মূল্য কমে যাবে কি না, মূল্য কমে গেলে বাজারটাই উধাও হবে কি না, সে-সব ভবিষ্যতের ব্যাপার। ভবিষ্যতে আমরা সবাই মৃত।

আমাদের দেশেও ক্ষমা চাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। বিশেষ করে রাজনীতির লোকেরা চট করে 'সরি' বলতে রাজি নন। অথচ প্রতিপক্ষ কেবলই তাদের পুরনো পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে বলে, তাই নিয়ে শোরগোল তোলে। কোনও পক্ষই ক্ষমা চাইবে না, ওদিকে প্রতিপক্ষও ছাড়বে না। তাই ভাবছিলাম, একটা কোম্পানি তৈরি করলে হয় না? আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, ড. কামাল হোসেন-যেই হোক, যে কারণেই হোক, যখন যেখানে দরকার, যার কাছে দরকার, ক্ষমা চেয়ে আসবে। খরচটা দিয়ে দিলেই হল, ব্যস।