আবারো সত্তর

মামুন আল মাহতাব
Published : 13 Dec 2018, 12:33 PM
Updated : 13 Dec 2018, 12:33 PM

সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ চারদিকে। দেশে তো আগ্রহ থাকবেই। সেটাই স্বাভাবিক। আগ্রহ দেশের বাইরেও। সেটাও অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। ভৌগলিক অবস্থান সূত্রেই বাংলাদেশ তার জন্মের আগে থেকেই বিদেশিদের আগ্রহের কেন্দ্রে।

এদেশের স্বাধীনতা নিয়ে একাত্তরে আর্ন্তজাতিক টানাপড়েন কম হয়নি। গোটা দুনিয়া কার্যত দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল এই একটি ইস্যুতে। আলোচনা হয়েছে দফায় দফায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে। ভেটোও পরেছে একাধিক। আর সাম্প্রতিক সময়ে ভৌগলিক গুরুত্বকে ছাপিয়ে গেছে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা। এদেশে নির্বাচন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আগ্রহ জাগাবে সেটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক যা তা হলো আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক দু-একটি খবর।

শুধু অস্বাভাবিকই নয়, উদ্বেগজনকও বটে খবরগুলো। এই সেদিনও তো ভারতের একটি ইংরেজি দৈনিক লন্ডন প্রবাসী একজন দেশি নেতার সাথে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর বৈঠকের খবর ছেপেছে। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিচিত করায় পাকিস্তানিদের আগ্রহ সর্বজনবিদিত। এ নিয়ে কোনও যুক্তি তর্কেরও প্রয়োজন নেই। ভারতের পত্রিকাটি লিখছে আগামীতে বাংলাদেশে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠাই পাকিস্তানের লক্ষ্য আর সেই উদ্দেশ্যেই আলোচিত ওই বৈঠকটি।

রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা শুরুর দিকেও আইএসআই এতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। মিয়ানমার সরকার অনুমোদিত কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের ঠিক আগ মুহূর্তে আইএসআই-এর নির্দেশে রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের বর্ডার সিকিউরিটি পুলিশের চৌকিগুলোতে একসাথে হঠাৎই হামলা করে বসে। এতে মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনীর হতাহত হয় অনেক।

সেই ছুতোতেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা চালিয়ে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করে। পাকিস্তানিদের ভয় ছিল কফি আনান রিপোর্ট প্রকাশ হলে, তা দীর্ঘদিনের এই সমস্যাটিকে একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে। আর্ন্তাজাতিক গণমাধ্যম সূত্রেই আমরা জেনেছি এসব। যেমন আমরা জেনেছি যে, আইএসআই নির্বাচনের সময় বরাবরই আমাদের সাবেক বিরোধী দলকে অর্থায়ন করে এসেছে। পাকিস্তানের আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আইএসআই-এর সাবেক প্রধানের জবানিতে উঠে এসেছে এসব তথ্য আর আমরা তা জেনেছি আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমের বরাতেই।

তবে সবচেয়ে যা দুশ্চিন্তার তা হলো ভারতীয় আরেকটি দৈনিকের কদিন আগের কয়েকটি খবর। বলা হয়েছে, জামায়াতের একজন সিনিয়র নেতার সাথে লন্ডনপ্রবাসী ওই দেশি নেতার কদিন আগে আরেকটি বৈঠকের কথা। এই বৈঠকে জামায়াত সামনের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ছাড় দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে। সত্য হচ্ছে, ক্ষমতায় এলে শতাধিক টার্গেটেড কিলিং করতে হবে। এই তালিকার এক নম্বরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম। আরেকটি উল্লেখযোগ্য জিনিস, তালিকাটিতে এমন কিছু সুশীল ব্যক্তিত্বের নাম রয়েছে যারা এক সময় স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে নি:শর্ত সমর্থন দিলেও তাদের আজকের ভূমিকা স্বাধীনতার পক্ষীয়দের চেয়ে বিরোধিতাকারীদের পক্ষেই যায় বেশি। অথচ জামায়াত তাদেরও ছাড় দিতে নারাজ। ওরা ওদের শত্রু ঠিকই চেনে আর আমরা পারি শুধু কোটারই স্বার্থে স্বাধীনতার পক্ষের জায়গাগুলোকে ক্রমেই কৃশকায় করতে।

আর কদিন বাদে বাংলাদেশে শুধু একটি জাতীয় নির্বাচন নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটা এদেশের পাকিস্তানপ্রেমি বাংলাস্তানিদের সামনে 'হয় এসপার না হয় ওসপার' একটা অবস্থার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ওরা ওদের সবটুকুই উজার করে দিবে। দেশের রাজনীতিতে ইদানিং যা কিছু ঘটছে আর ভিনদেশি মিডিয়ায় যা কিছু ছাপছে, একটু মন দিয়ে সেসব বিশ্লেষণ করলেই অনেক কিছুই স্বচ্ছ হয়ে যায়।

না, এটা কোন তাত্ত্বিক আলোচনা নয়। ভোটের আগে জুজুর ভয় দেখিয়ে ভোট বাড়ানোও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। যদি মনে করে থাকেন একাত্তর দেখেছেন, দেখেছেন ২০০১ কিংবা ২০১৩-১৪-তে, তবে জেনে রাখুন দেখার বাকি আছে ঢের বেশি।

আপনার মনে নাই, কিন্তু ওদের মনে আছে গত দশ বছরে এদেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ হয়েছে বিশ লক্ষ কোটি টাকা। আপনি জানেননা, কিন্তু ওরা ঠিকই জানে যে ত্রিশের দশকের পর এই প্রথম এই বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা উর্দ্ধগামী। ২০০১ সালের পর যা কমে আট শতাংশের তলানিতে ঠেকেছিল আজ তা বেড়ে বারো শতাংশের বেশি।

যদি আমরা আবারও পেছনে হাঁটতে না চাই তাহলে আমাদের ত্রিশ তারিখে ভুল করার সুযোগ কোথায়? আমরা কথায় কথায় বলি আবারো একাত্তরের চেতনায় জেগে উঠার কথা। আমি চাই 'আবারো সত্তর'।

এদেশের ইতিহাসে সব চাইতে গুরুতপুর্ণ সম্ভবত সত্তরের নির্বাচন। কারণ ওই নির্বাচিত সাংসদদের হাত ধরেই গঠিত হয়েছিল মুজিব নগরের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারটি। সে সময়ে এদেশের সত্তর শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগে ভোট দিয়েছিল। আমরা পেয়েছিলাম একটি স্বাধীন দেশের লাল-সবুজ পতাকা আর সবুজ একটি পাসপোর্ট। সামনের নির্বাচন তার চেয়ে মোটেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সম্ভবত অনেক বেশি। কারণ এই নির্বাচনে জিতে যারা সংসদে যাবেন, তারাই নির্ধারণ করবেন এ দেশটা হবে কার- ওদের না আমাদের। এবারেও তাই প্রয়োজন ন্যূনতম সত্তর শতাংশের ভোট স্বাধীনতার সপক্ষের ব্যালটে, আরো বেশি হলে, ভালো আরো বেশি। এখন চাওয়া তাই একটাই – 'আবারো সত্তর'!