মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি, অপপ্রচার ও সদুত্তর

অমি রহমান পিয়ালঅমি রহমান পিয়াল
Published : 12 Dec 2018, 06:23 PM
Updated : 12 Dec 2018, 06:23 PM

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নিয়ে একটা লম্বা সময় ধরেই তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত ছিল। এর একটা বড় কারণ এই ইতিহাসকে বিকৃত করতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বরাবরই সক্রিয়। গত এক দশক ধরে দীর্ঘ লড়াই করে তাদের অনেকখানি সচেতন করা গেছে। তারপরও কিছু বিভ্রান্তি রয়ে গেছে তাদের মনে। ডিসেম্বর মাস এলেই অনলাইনে বিশেষ করে ব্লগে ও ফেসবুকে একটা মহলকে দেখা যায় কিছু বিষয় নিয়ে অপপ্রচার চালাতে। আজকের লেখায় তেমন কিছু বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করবো।

আমরা বিষয়গুলোকে এভাবে সাজাতে পারি:

১. মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কে ছিল?

২. মুক্তিযুদ্ধ কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছিল?

৩. আত্মসমর্পন দলিলে কেন ওসমানীর পরিবর্তে ইন্ডিয়ান জেনারেল স্বাক্ষর করেছে?

৪. আত্মসমর্পনের দলিল ভারতে

৫. মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সব অস্ত্র ভারত নিয়ে গেছে

তো একে একে এগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করি।

১.

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ওসমানী অ্যাক্টিভ লিস্টে আহুত হন। ১২ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার নাম ঘোষণা করা হয়। এতে রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলে ঘোষণা করা হয় এবং বাংলাদেশ সরকার এক ঘোষণায় ওসমানীকে ১২ এপ্রিল থেকে মন্ত্রীর মর্যাদাসহ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই মুজিবনগরে উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর গঠন করা হয়। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ওসমানিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়। তার পেশাগত ক্রমিক নম্বর ৮২১। তার নিয়োগপত্র ও ঘোষণাপত্রের ছবি নিচে দেওয়া হলো।

মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ইস্যুটা নিয়েই সবচেয়ে বেশি প্যাচানো হয়। রটনাকারীরা কিন্তু এটা ভুলে যায় মুক্তিযুদ্ধের আগে ওসমানী একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা হলেও আওয়ামী লীগের নির্বাচিত একজন এমপি ছিলেন। কিন্তু তারা শেষ বয়সের ওসমানীকে মাথায় নিয়ে প্রশ্ন সাজায় তো ছবিতে দেখা যাচ্ছে ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি একজন ক্যাবিনেট মিনিস্টারের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

তবে ওসমানীর আনুষ্ঠানিক অধিভুক্তিতে একটু সময় লেগে যায়। ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন ওসমানী। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাকে নতুন করে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিতে হয়। ১৫ জুলাই '৭১ (কাগজে ভুলে ৭০ লেখা) বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রে ওসমানীকে নতুন করে সেনাবাহিনীতে অধিভুক্ত করা হয়, এবং এতে সাক্ষর দেন উপ-সেনাপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার । প্রসঙ্গত, একে খন্দকার তখন অ্যাক্টিভ সার্ভিস হোল্ডারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন, আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন তিনিই।

এই দেরি হওয়ার কারণ ছিল বাংলাদেশ সরকারের দাপ্তরিক কাগজপত্র সিল ইত্যাদি তখনও চূড়ান্ত হয়নি। যে কারণে ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগে সাধারণ কাগজপত্রই ব্যবহার করা হয় প্রথমে। তার নিয়োগ অনুমোদন দিয়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাক্ষর করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

এখন কেনো কমান্ডার ইন চিফ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নন এই ব্যাপারে খোদ তাজউদ্দিন আহমেদ (যিনি আসলে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার সেনাপতি) সুন্দর যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন- 'সিএনসির বাংলা তরজমা কিন্তু সর্বাধিনায়ক নয়, প্রধান সেনাপতি। আমাদের সরকার সামরিক নয়। সামরিক সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সেনাপতি একই ব্যক্তি থাকেন। এজন্য প্রধান সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট তিনবাহিনীর পুরো দায়িত্বে থাকেন। এজন্যই তখন সেনাবাহিনী প্রধানকে সর্বাধিনায়ক বলা হয়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় তিনবাহিনীর তিনজন প্রধান থাকেন। রাষ্ট্রপ্রতি তিন বাহিনীর সমন্বয়ক হিসেবে তিনিই হন সর্বাধিনায়ক।'

তো যেহেতু রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনিই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক।

২.

আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের একটা পর্যায়ে এসে পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মোটেও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নয়। এমনকি গৃহযুদ্ধও নয়। কারণ ১২ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পরপর পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবেই বিলুপ্ত হয়।এবং আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে অনুমোদিত হয় সেই ঘোষণায় যা এক অর্থে আমাদের প্রথম সংবিধানও।প্রসঙ্গত বলতে হয় গত শতকে শুধু বাংলাদেশই আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় এবং একমাত্র দেশ বাংলাদেশ ।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার নামে মুজিবনগরকে রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করে কাগজপত্রে ব্যবহার করলেও বাস্তবে তাদের অবস্থান ছিলো কলকাতায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাও ভারতেই ট্রেনিং নিয়ে তাদের অস্ত্রের সহায়তা নিয়েই জন্মভূমিতে ফেরেন দেশকে মুক্ত করতে। তো পাকিস্তান সরকার এবং তাদের এদেশি অনুচররা (জামাতে ইসলামী-মুসলিম লিগ-নেজামে ইসলামী-পিডিপি) মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের দালাল (সংক্ষেপে ভাদা) বলে অফিসিয়ালি উল্লেখ করতো। ইয়াহিয়া সরকার প্রায়ই ভারতকে হুমকি দিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য দেওয়া বন্ধ না করলে আক্রমণের। গোলাম আযম তো ঘোষণাই দিয়েছিলো দিল্লীতে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়ার যদিও সে ঈদের পরদিনই পাকিস্তান পালায়।

যাহোক ২১ নভেম্বর '৭১ বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। আর এই কমান্ডের অধিনায়ক ছিলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। যেহেতু বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব দিকে তাই পূর্বাঞ্চল অধিনায়ক হিসেবে অরোরা এই দায়িত্ব পান। যদিও ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ছিলেন স্যাম মানেকশ। এমন সিদ্ধান্তে আসার কারণ যুদ্ধ তখন চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে যাচ্ছিলো। সেই লড়াই ভারী অস্ত্রের লড়াই। ট্যাংক-মিগ আর ফ্রিগেটের লড়াই যার কিছুই ছিলো না বাংলাদেশের। থ্রি নট থ্রি, স্টেন, গ্রেনেড এমনকি ভারী মেশিনগানও মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছে ভারত কিন্তু কয়েকশ মিগ, কয়েকশ ট্যাংক আর নৌবহর তো দিতে পারে না। ওগুলা তাদেরই চালাতে হবে। তাই মিত্রবাহিনী গঠন।

৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাটিতে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ চলে দুটো ফ্রন্টে। পূর্ব ফ্রন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয় মিত্রবাহিনী। আর পশ্চিম ফ্রন্টে শুধু ভারতীয় বাহিনী। পূর্ব ফ্রন্টে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করে। জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই এই অংশের লড়াই লিবারেশন ওয়ার অব বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে উল্লেখিত যার ব্যাপ্তি ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ শেষ হয় ১৯ ডিসেম্বর। দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (প্রথমটি ১৯৬৫ সালে) তাই ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসেব করা হয়।

প্রসঙ্গত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হয়ে ঠিক এই প্রশ্নটাই বেশ ক্ষোভ নিয়েই আমি করেছিলাম ভারতীয় জেনারেল জেএফআর জ্যাকবকে। বলেছিলাম- কোনও কোনও মহল আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে অভিহিত করে এবং এটা আমাদের অহমে আঘাত দেয়। এ বিষয়ে আপনার দৃষ্টি ভঙ্গিটা কি? তার উত্তর ছিলো: I've always said it was your liberation war. It was your war of independence, not otherwise. (আমি সবসময়ই বলে এসেছি এটা তোমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ, তোমাদের মুক্তিযুদ্ধ, অন্য কিছু নয়।)

৩.

এই প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করা হয়েছে। এমনিতে প্রশ্ন হয় ওসমানী কেনো আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না? মূল কারণটা হচ্ছে আর্মি প্রটোকল। তাজউদ্দিন আহমেদ যদি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ না দিতেন তাহলে সিনিয়ারিটি অনুযায়ী বাই ডিফল্ট এটি হতেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, কারণ তিনিই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার এবং একই সঙ্গে উপ-সেনাপ্রধান। অন্যদিকে ওসমানী তখনও কর্নেল এবং তাকে জেনারেল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৬ ডিসেম্বরের পর। যাহোক তারপরও তিনি আমাদের প্রধান সেনাপতি এবং ভারতীয় বাহিনীর প্রধান স্যাম মানেকশ এর সমানই তার মর্যাদা ছিলো তখন। অন্যদিকে অরোরা একজন আঞ্চলিক প্রধান। পূর্ব ফ্রন্টের অধিনায়ক। যেমন লে. জেনারেল নিয়াজীও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব ফ্রন্টের অধিনায়ক। পূর্ব ফ্রন্টের জন্য গঠিত মিত্রবাহিনী তাই অরোরার কমান্ডেই হবে সেটাই স্বাভাবিক। ওসমানী কেন সই করবেন? পাকিস্তানের পক্ষে কি তাদের সেনা প্রধান সই করেছিলো? আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে কি স্যাম মানেকশ ছিলেন? তাহলে ওসমানী কেন যাবেন?

এই প্রশ্নে জ্যাকবের উত্তর ছিলো: There is a lot of propaganda about it. The fact is, he was in Sylhet. He was in a helicopter that was shot at by the Pakistan army. I had ordered everyone on the Bangladesh side to stay in Kolkata. But he rode the chopper, got shot and couldn't attend the ceremony. It's not our fault. He should have been there. We wanted him there. Khandker (deputy commander-in-chief AK Khandker) attended in his absence.

জ্যাকবের কথাটা সত্যনিষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে ওসমানীর ভাষ্যটা বরং আমরা শুনি: যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম। একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা নামে এক স্মৃতিচারণে তিনি তুলে ধরেছেন এর বিষদ বিবরণ।

ঘটনা হচ্ছে ১২ ডিসেম্বর ওসমানী কলকাতা থেকে আগরতলা হয়ে মুক্তাঞ্চল সিলেটে যান। এটা নিশ্চিত করেন মুক্তিবাহিনী হেডকোয়ার্টারের অফিসার ইন চার্জ জেনারেল ওসমানীর বিশ্বস্ত বন্ধু মেজর এমআর চৌধুরী। তার ভাষায়- তানী এখন সিলেট গেছুন।

১৮ ডিসেম্বর সদর দপ্তরে ফিরে তাকে নিয়ে এসব গুজব শুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন ওসমানী। নজরুল ইসলামের মুখে পুরোটা শুনে যে জবাব দিয়েছেন কোট করছি:

দেখুন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে কোনো চেতনা এখনও জন্ম হয়নি। আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর সুযোগটা কোথায়? কোনো সুযোগ নেই। তার অনেক কারণ রয়েছে। নাম্বার ওয়ান- পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কবে আত্মসমর্পণ করবে আমি জানতাম না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব এসেছে।

নাম্বার টু- ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল স্যাম মানেকশ। সত্যি কথা হচ্ছে আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ নয়।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করবেন লে.জে অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্ন উঠতো। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশর সমান। সেখানে তার অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়। এটা প্রটোকলের ব্যাপার। আমি দুঃখিত, আমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের বড় অভাব।

ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়। জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল অরোরার কমান্ডের অধীন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাবো কি জেনারেল অরোরার পাশে দাড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাও ক্যান আই!

আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। এখানে আমার ভূমিকা কি? খামোখা আমাকে নিয়ে টানা হ্যাচড়া করা হচ্ছে।

পাশাপাশি কেন মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেনি এটার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ওসমানী সংক্ষেপে ব্যাপারটা এমন যে- যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে যার অন্য নাম জেনেভা কনভেনশন। বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয় বলেই সেই নীতিমালা মানতে মুক্তিবাহিনী বাধ্য ছিলো না। তাই তাদের হত্যা করলে বা তাদের উপর অত্যাচার করলে বলার থাকতো না কিছু। পাকিস্তানিরা জেনেশুনে সে ঝুঁকি নেয়নি। তাছাড়া ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দিকে খাওয়ানো পড়ানো তদারক করার ক্ষমতাও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ছিলো না। তখনও নিজের খাওয়াটাই যে জোটে না!

(তথ্যসূত্র : একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা লেখক: নজরুল ইসলাম, অনুপম প্রকাশনী ১৯৯৯)

তো ওসমানী সিলেটে কি করেছেন? হেলিকপ্টারে গুলি ছোঁড়ার কাহিনী একটা গল্প বটে।কারণ তাতে ওসমানী আহত হননি। আগরতলা দিয়ে ওসমানী কুমিল্লা হয়ে সিলেটে ঢোকেন। কুমিল্লা থেকে হবিগঞ্জ যাওয়ার পথেই তার কপ্টারে গুলি ছোঁড়া হয় বলে কথিত আছে। যাহোক ১২ তারিখ তিনি হবিগঞ্জে মুক্তাঞ্চল সফর করেছেন।

সিলেটে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করে ১৫ ডিসেম্বরে। ওসমানী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর মুক্ত সিলেটে ওসমানী। কথা বলছেন দুই সেক্টর কমান্ডার লে.কর্নেল সিআর দত্ত এবং লে.কর্নেল মীর শওকত আলীর সঙ্গে এমন একটা ছবি ওসমানীর নিজের স্মৃতিকথাতেই প্রকাশিত ।

আর তিনি আত্মসমর্পনের দায়িত্বে থাকা মিত্র বাহিনীর ভারতীয় অফিসারদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন সে ছবিটাও আছে তার উপর প্রকাশিত সেই বইয়ে (ও জেনারেল, মাই জেনারেল)।

এমনকি মিত্রবাহিনী গঠন ও অনুমোদন তার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সঙ্গে স্যাম মানেকশর বৈঠকে তিনিও ছিলেন।

এমনকি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠকেও।

এখন আসা যাক, এই প্রশ্নের মধ্যে গোপন প্রশ্নটায়। ভারতীয় জেনারেল সই করেছেন যে দলিলটায় সেটায় কি পাকিস্তান ভারতের কাছে আত্মসমর্পন করেছে? উত্তর- না। করেছে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে। সেই এখতিয়ার বাংলাদেশ সরকার অরোরাকে দিয়েছে। আত্মসমর্পনের যে দলিল সেটা ইনস্ট্রুমেন্ট অব সারেন্ডার নামে পরিচিত। সেটার বাদিকে নিচে অরোরা যেখানে সই করেছেন, সেখানে কি লেখা দেখেন তো? লেখা: জেনারেল অফিসার কমান্ডার ইন চীফ ইন্ডিয়ান অ্যান্ড বাংলাদেশ ফোর্সেস ইন দ্য ইস্টার্ন থিয়েটার।

৪.

আমাদের আত্মসমর্পনের দলিল ভারতে এটিও একটি পরিকল্পিত মিথ্যাচার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ তিনটি। বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারত। তাই দলিলও হয়েছে তিনটি। পাকিস্তানের পক্ষে লে. জেনারেল নিয়াজী এবং বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর পক্ষে লে. জেনারেল অরোরা মোট তিনটি দলিলে সই করেছেন। ভারতে ভারতেরটা, বাংলাদেশে বাংলাদেশেরটা, পাকিস্তানেরটা পাকিস্তানে। জাতীয় জাদুঘরে আত্মসমর্পনের দলিল বাঁধাই করা আছে। আর দুইটা দলিল দিয়ে ভারত কী করবে!

৫.

এটা অস্বীকার করা যাবে না মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ভারতের সশস্ত্র সহযোগিতায়। আমাদের অস্ত্র বলতে কিছুই ছিলো না। ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে এবং অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করতে পাঠায়। যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন ভারী অস্ত্রের লড়াই শুরু হলো তখন ভারত তাদের ট্যাংক, কামান, বিমান এবং যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে মিত্রবাহিনীতে সামিল হলো। এসব আমাদের কিছুই ছিল না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পনের আগে তাদের সবগুলো ভারী অস্ত্রই নষ্ট করে ফেলে। যেসব বিমান তখনও আকাশে ওড়ার মতো ছিলো সেগুলোও ধ্বংস করে দেয়। তারপরও যেগুলো রক্ষা পায় সেগুলো বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর এখতিয়ারে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া কোনো অস্ত্র ভারত ফেরত নেয়নি।

সংক্ষেপে মোটামুটি এই হচ্ছে অপপ্রচারগুলোর সদুত্তর। যারা এসব মনগড়া আরোপে বিভ্রান্ত হন, তাদের জোর গলায় বলি: মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অত্যন্ত গর্বের অর্জন। অনেক রক্ত অনেক আব্রুর বিনিময়ে পাওয়া। কোনো ছুটকো তথ্যে বিভ্রান্ত না হয়ে সত্য অনুসন্ধান করার জরুরি। সবচেয়ে জরুরি কমনসেন্স খাটানো। যারা এসব বলে তাদের উদ্দেশ্য কি সেটা অনুধাবন করতে হবে। তবে মিথ্যা গল্প বানালেই কি মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, মুক্তিযুদ্ধের সম্মান আমাদের চোখে খাটো হয়ে যাবে? কখনও না।