উন্নয়নের ঢাক বাজাতে চান বাজান, কিন্তু টাকাটা কোত্থেকে আসবে সেটাও একটু বলুন!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 10 Dec 2018, 10:02 AM
Updated : 10 Dec 2018, 10:02 AM

আমাদের দেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কোথাও নেই। আমি যদি আমার বউয়ের জন্য অত্যন্ত দামি একটা উপহার নিয়ে যাই, এ জন্য বউয়ের কাছে তেমন কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। টাকার কথা জিজ্ঞেস করলে বড় জোর বলি: তোমাকে না জানিয়ে একজনের একটা কাজ করে দিয়েছিলাম, সেখান থেকেই এই টাকা পেয়েছি। বউ এই বিবৃতিতেই খুশি! আসলে সে খুশি দামি উপহার পেয়ে! সে কখনও তলিয়ে জানতে চায় না, কখন, কোথায়, কার কাজ করেছি, এই বাবদ আসলেই এত টাকা পাওয়া যায় কিনা! আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক পরিমণ্ডলে যেমন আয়-ব্যয়ের কোনো স্বচ্ছতা নেই, ঠিক তেমনি নেই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও। আমাদের রাজনৈতিক দল, সরকার কীভাবে টাকা আয় করে, কোথায় কীভাবে তা ব্যয় করে সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। কিন্তু নির্বাচনের আগে উন্নয়নের হরেকরকম স্বপ্ন দেখায় রাজনৈতিক দলগুলো। এজন্য দলের বিশেষজ্ঞ প্যানেল বসিয়ে সুন্দর সুন্দর কথামালা সাজিয়ে তৈরি করা হয় ভোটার আকৃষ্টের নির্বাচনী ইশতেহার। তবে অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, সেসব উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য খরচাপাতির জোগান কোন প্রক্রিয়ায় কোথা থেকে আসবে তার উৎস সম্পর্কে কিছুই স্পষ্ট করা হয় না।

এর কারণ কি? কারণ হতে পারে, ভোটের মাঠে রাজনৈতিক দলগুলোর করের ভয়। কেননা উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সিংহভাগ অর্থই আসে জনগণের পকেট থেকে যাওয়া করের টাকা থেকে। এ কারণে ভোট চাইতে গিয়ে জনগণকে করের কথা বলা হয় না। তাহলে তারা ভোট হারাবেন। এতে সরকার গঠনের স্বপ্নও ধূলিসাৎ হতে পারে। বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান এবং দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থা সেই বিশাল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাত্র ৫ শতাংশ অর্থের জোগান দিচ্ছে। বাকি ৯৫ শতাংশ অর্থই জনগণের দেয়া কর। কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ কর ব্যবস্থাটি দেশে কেমন হবে, এর আওতা কিভাবে বাড়ানো হবে, কারা করের আওতায় পড়বে, কর দেয়ার হারটি কতটা সহনীয় থাকবে- সেটি প্রত্যক্ষ না পরোক্ষ করে? একইভাবে দেশে বিদ্যমান আড়াই কোটি দরিদ্র ও ৯ কোটি নিম্নবিত্তের স্থির আয়কে ওই কর ব্যবস্থা কোনোভাবে সংকুচিত করবে কিনা? এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও শিল্পের উৎপাদন ব্যয়, পণ্য ও সেবামূল্যের ওপর সৃষ্ট প্রভাব কেমন হবে- এসব নিয়ে রাজনৈতিক কোনো অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে দেখা যায় না।

এর কারণ হলো রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব। দেশে যদি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাটা পুরোপুরি কার্যকর থাকত তাহলে ক্ষমতায় যেই আসুক দেশের বৃহৎ স্বার্থে সম্প্রসারণমূলক ও সহনীয় একটি উত্তম কর ব্যবস্থার চিন্তা রাজনৈতিক দর্শন থেকেই আসত। তা দলীয়ভাবে নেতাকর্মীদের মধ্যেও চর্চা করা হতো। সেটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে নির্বাচনী ইশতেহারে কর বিষয়ক সাহসী পরিকল্পনা নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়ারও স্বচ্ছ সাহস থাকত। কিন্তু আমাদের দেশে এই চর্চা নেই। বড় দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে থাকে কেবল শত শত উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এসব উন্নয়ন করতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা ইশতেহারেই স্থান পায় না। সব সামর্থ্যবানের করের আওতায় আনার সুস্পষ্ট ঘোষণা কেউ দেয়নি। এদিকে কর বিষয়ক আগাম প্রস্তুতি ও কৌশলী পরিকল্পনা না থাকার কারণে শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক সরকারকেও পুরো মেয়াদে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার রাজস্ব আয়ে আমলানির্ভর হয়েই থাকতে হয়। আর আমলাদের সুবিধে হলো, সাধারণের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে করদাতার বাস্তব অবস্থার দিকেও খুব একটা নজর তারা রাখে না। যেনতেনভাবে তারা সরকারের লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আদায়ে কর্মকৌশল তৈরি করে কাজ চালিয়ে নেয়। সরকারও সেটিই অনুমোদন করে। এসব কারণে দেশে ঘনঘন রাজস্বনীতির পরিবর্তন হয়। প্রতি বছর উদ্যোক্তার ওপর নতুন হারের করভার চেপে বসছে। অন্যদিকে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

রাজনৈতিক দলগুলো উন্নয়নের জন্য যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নের জন্য কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে তারও একটা হিসাব থাকা দরকার। একই সঙ্গে সেই অর্থটা কিভাবে সংকুলান করা হবে অভ্যন্তরীণ করের মাধ্যমে না আন্তর্জাতিক ঋণ বা অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে তার উল্লেখ থাকা উচিত। বিশেষ করে কর আদায় ব্যবস্থায় পরোক্ষ করের চেয়ে প্রত্যক্ষ করের সম্প্রসারণের বাস্তবসম্মত কৌশল রাজনৈতিক দলগুলো থেকে এলে তা বাস্তবায়ন সহজ হয়। বাংলাদেশ এখনও পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। রাজস্ব বোর্ডের সর্বশেষ হিসাব বলছে, এটা মোট রাজস্বের ৬৬ শতাংশ। এর ফলে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব ধরনের পণ্য, ভোগ, সেবা এবং বিনোদন কোনো কিছুই ভ্যাটের বাইরে থাকছে না। এ পরিস্থিতিতে দেশের অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ এবং প্রায় আড়াই কোটির মতো হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীও পণ্য ও সেবা ভোগের ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তের সঙ্গে সমান হারে ধার্যকৃত ভ্যাট পরিশোধ করছে।

মানুষ পরিশ্রম করে টাকা-পয়সা রোজগার করে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উপার্জিত এই অর্থের একটা অংশ সে রাষ্ট্রকে দেয়। এর পোশাকি নাম- কর বা ট্যাক্স। এই টাকা দিয়েই সরকার তার দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করার পাশাপাশি নানা ধরনের 'উন্নয়ন' কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। আমরা 'উন্নয়ন' নিয়ে মাতোয়ারা। কিন্তু উন্নয়নের এই টাকাটা কার কাছ থেকে কত হারে  নেয়া হচ্ছে; আর কার কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে না- এসব নিয়ে আমাদের কোনো মাথা-ব্যথা নেই। এমনকি শত শত এমনকি হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করলে বা লুটপাট করলেও এর কোনো নিদান নেই! বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থপ্রতিষ্ঠান ও দেশীয় ব্যাংক থেকে সরকার প্রচুর টাকা ধার নিচ্ছে যা শোধ করতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকেই- এ নিয়েও আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। তাছাড়া এই টাকাটা কোথায় কীভাবে ব্যয় করা হচ্ছে, ব্যয় বেশি হয়ে যাচ্ছে কিনা; যে সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেগুলো আরো কম টাকায় করা যেত কিনা- এসব নিয়েও আমাদের কোনো ভাবনা-চিন্তা নাই। ভেবে দেখুন, ইউরোপে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ২৮ কোটি টাকা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ ব্যয় ১০ কোটি টাকা। আর চীনে তা গড়ে ১৩ কোটি টাকা। কিন্তু বাংলাদেশের তিনটি মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ব্যয় ধরা হচ্ছে কিলোমিটারপ্রতি গড়ে ৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক চার লেন নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা। ফলে মহাসড়ক নির্মাণ সবচেয়ে ব্যয়বহুল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। অথবা ভাবুন, ভারত, চীন কিংবা মালয়েশিয়াতে প্রতি কিলোমিটার ফ্লাইওভার বানানোর খরচ ৮০-৯০ কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশে এই খরচ ১৩৫ থেকে ৩১৬ কোটি টাকা। ভাবা যায়!

আমাদের মনে রাখা দরকার, উন্নয়ন নিয়ে যে রাজনীতি- তার পেছনে কিন্তু আমার-আপনার করের টাকা। দোকানে কোনো জিনিস কিনতে গেলে আমরা খুটে-বেছে দেখি। জিনিসের কোয়লিটি ভালো কিনা, দাম ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমাদের এই বিবেচনাবোধ কাজ করে না। কিন্তু ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই। আমি-আপনি টাকা দিচ্ছি- সেই টাকার বিনিময়ে রাষ্ট্র আমাদের কী দিচ্ছে; এবং যা দিচ্ছে গুণে-মানে তা ভালো কিনা; দামটা ঠিক আছে কিনা- এসব জিনিস নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কারণ বাংলাদেশ এখন আর ধনী দেশগুলোর দান-খয়রাতের ওপর চলে না। নিজেদের টাকায় আমরা চলি। আমাদের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে, দিন দিন আরো বাড়ছে। ফলে করারোপের মাধ্যমে টাকা-পয়সা সংগ্রহ ও এর ব্যবহারে আরো বেশি 'প্রুডেন্ট' বা বিচক্ষণ হতে হবে। এটা সরকারের কাজ। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাজ।

শুধু 'উন্নয়ন'-এর ঢাক বাজালেই চলবে না। আর এই উন্নয়ন নিয়ে মাতোয়ারা হলে চলবে না। কতো টাকা দিয়ে কতটুকু উন্নয়ন হচ্ছে, এর চেয়ে কম টাকায় সেটুকু উন্নয়ন করা যেত কিনা- এসব ভাবনার দরকার আছে। এটা কেবল সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। করদাতা হিসেবে আমার- আপনার দায়িত্ব আছে। আমার-আপনার টাকাটা যথাযথভাবে বা প্রুডেন্টলি ব্যয় হচ্ছে কিনা- সেটাও দেখা দরকার। যে কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এটা একটা মৌলিক দিক। এর মাধ্যমেই 'উন্নয়নের রাজনীতি'টাকে নজরদারির মধ্যে রাখা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এসব ব্যাপারে স্পষ্ট অঙ্গীকার থাকা দরকার। তাদের পরিষ্কার করে বলতে হবে, কোন জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে কতো টাকা ট্যাক্স আকারে তুলবেন; কার কাছ থেকে কোন শর্তে এবং কতো সুদে কী পরিমাণ টাকা ধার করবেন; সংগৃহীত মোট অর্থ কতো বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করবেন ইত্যাদি। এর ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মূল নীতির প্রশ্নে তাদের অবস্থানটা জানা যাবে। মোট কথা, রাষ্ট্রের বাজেট (আয় ও ব্যয়) নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারে আলাদা একটা চ্যাপ্টার থাকা চাই। এটা দেখে বোঝা যাবে, কোন দল কীভাবে জনগণের করের টাকার সদ্ব্যব্যবহার করবে।