জাতীয় সংসদ নির্বাচন: উগ্রবাদের ঝাঁকে, বেছে নেব কাকে?

হেলাল হোসেন ঢালী
Published : 3 Dec 2018, 01:34 PM
Updated : 3 Dec 2018, 01:34 PM

বাংলাদেশের আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশটির ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন – এই প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে ৩০শে ডিসেম্বর, ভোটের দিন। কিন্তু ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে নাগরিকরা যে সকল বিষয় বিবেচনায় রাখবেন তাতে অন্তত দুটি বিষয় ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা যেতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট আদর্শিক গতিপথ; দ্বিতীয়ত, দেশ ও মানবতার সার্বিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক মহলে ভবিষ্যত বাংলাদেশের অবস্থান।

২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণ-জয়ন্তীতে পৌঁছাবে এবং সঙ্গত কারণেই এই সুবর্ণ জয়ন্তীকে কেন্দ্র করে দেশটিতে যে সকল অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করা হবে সে সকল অনুষ্ঠান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা, এবং বাংলাদেশের মানুষের আশা আকাঙক্ষা ও বাস্তবায়নের প্রতিফলন থাকবে। আসন্ন সুবর্ণ জয়ন্তি উৎসব তাই কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এমনটা নয়; এ উৎসব হবে বর্তমান তরুণ সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাংলাদেশের ইতিহাস, চেতনা ও সমৃদ্ধি পৌঁছে দেওয়ার এক অনন্য সুযোগ ও মাধ্যম। তাই ভবিষ্যত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানবে কি না তা অনেকাংশে নির্ভর করবে ওই সময় কারা রাস্ট্র ক্ষমতায় থাকছে। ফলে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে একজন নিরপেক্ষ নাগরিক হিসেবে আপনি কাদের ভোট দিবেন সেটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

এবারের নির্বাচনে যে সকল রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তি অংশ নিচ্ছেন তাদের মধ্যে দুটো আদর্শিক ভিত্তি প্রণিধানযোগ্য –

এক. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মকালীন বা মুক্তিযুদ্ধকালীন চেতনা। এই চেতনা কোনও সুনির্দিষ্ট আদর্শিক ভিত্তির যেমন ধর্ম, রাজনৈতিক মতবাদ, কিংবা পশ্চিমা মতাদর্শের মানদণ্ডে বিচার করা মুশকিল। এই চেতনাকে একটি সংকরায়িত আদর্শিক চেতনা বলা যেতে পারে। যা একান্তই বাংলাদেশের নিজস্ব আদর্শ, মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশের নিজস্ব চেতনা। এর দলিল বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান যার মূলনীতি: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।

দুই. বিভিন্ন মতাদর্শভিত্তিক যেমন ধর্ম (ধর্ম বিশ্বাস, ধর্মহীনতা, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, দেওবন্দী, মওদুদী, সালাফি, শিয়া, সুন্নি, আহমদিয়া, ইসমাঈলি, আহলে হাদীস ইত্যাদি), রাজনৈতিক আদর্শ (মার্কসবাদ, মাওবাদ, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ ইত্যাদি), এবং ব্যক্তি (পীর, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ইত্যাদি) ভিত্তিক চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের আগে পরে গড়ে ওঠা এসকল আদর্শ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় এসব আদর্শের দলিল বাংলাদেশের বিভিন্ন বামপন্থী ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর উপস্থিতি ও কর্মকাণ্ড।

অনেক ক্ষেত্রেই এই দুই মতাদর্শের ধারক-বাহক ও অনুসারীদের আদর্শের বিচ্যুতি হয় এবং তারা তাদের আদর্শের বাইরের সংস্কৃতিরও অনুকরণ করে। কিন্তু সেটা তারা তাদের আদর্শকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাময়িক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে বলেই প্রচার করে। উদাহরণস্বরূপ- সারাজীবন সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে শেষদিকে পুঁজিবাদী হিসেবে আখ্যায়িত কিংবা ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক দলের সাথে ঐক্য করা; দীর্ঘ সময় ধর্মীয় সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে একসময় তাদেরই নাস্তিক আখ্যা দেওয়া দলের সাথে ঐক্য গঠন করা; অতীতে ধর্মীয় মৌলবাদী দল হিসেবে আখ্যা দিয়ে বর্তমানে তাদের সাথে ঐক্য করা ইত্যাদি । এসব কিছুকেই তারা আদর্শিক কৌশল হিসেবে প্রচার করে।

বাংলাদেশের দৈনন্দিন সংস্কৃতিতেও এই আদর্শিক অবস্থান, আদর্শিক বিচ্যুতি এবং আদর্শিক কৌশলের প্রকাশ দেখা যায়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিচার করলেও দেখা যায়- এদেশের মানুষ প্রত্যেকেই অন্য ধর্মের জন্য ঘোষিত সরকারী ছুটি উপভোগ করে, বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেই শুরু হয় বড় বড় সব ধর্মের পবিত্র গ্রন্থপাঠ দিয়ে; চরম ধার্মিক এবং বামপন্থীর পাশাপাশি অনেকেই সকাল বেলা ফজরের নামাজ পড়ে দুপুরে দুনিয়ার মজদুরদের এক হওয়ার আহ্বান জানায়; আবার সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়ার আগে বাসায় ধূপ জ্বালিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে শুনতে ঘুমাতে যায়। কিংবা, পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে দিন শুরু করে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের সম্মানে ফুল নিবেদন করে আবার চায়ের টেবিলে শেক্সপিয়ার এবং ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে হিন্দিতে তুমুল আড্ডাও দেয়। ঘুষ, দুর্নীতি, ঋণ খেলাপ করে কোনও মন্দির, মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে।

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে সকল দল বা গোষ্ঠী অংশ নিচ্ছে তারা আপাতত উপরোক্ত বিভিন্ন ধারার মতাদর্শেরই অধিকারী। এবং সব মতাদর্শধারীরাই যখনই যারা ক্ষমতায় গেছে কিংবা ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছে তারা ভিন্ন মতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ করেছে। শুধু কণ্ঠরোধ করেই ছাড়েনি, কণ্ঠচ্ছিন্ন (জবাই) করতেও দ্বিধা করেনি। অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে যতগুলো মত ও পথ তৈরি হয়েছে তাদের আদর্শিক ভিত্তি যাই হোক না কেন – তারা সবাই প্রচার, প্রকাশ এবং চর্চায় উগ্র। নিজেদের মত, বিশ্বাস ও কর্মপন্থার বাইরে তারা অন্য কারোর অবস্থানই মেনে নিতে রাজি নয়। এই উগ্রবাদ এতটাই বিস্তার লাভ করেছে যে, এটা চাল চলন, আচার ব্যবহার, প্রচার, প্রকাশ ছাড়িয়ে আজ কোনও কোনও দল গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সহিংস রূপ লাভকরেছে। যে সকল দল বা গোষ্ঠী আজ সহিংস উগ্রবাদের বিপক্ষে কথা বলছে তারাও তাদের অসহিংস উগ্রতার ব্যাপারে সজাগ নয়। এই উগ্রতার জন্ম যে শুধু বাংলাদেশেই হয়েছে তা নয়, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডার কোনও কোনও প্রদেশ, এবং আমাদের প্রতিবেশি চীন, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার সহ পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশেই ঘটেছে।

এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের মানুষ যাকেই ভোট দেন না কেন তারা কোনও না কোনওভাবে উগ্রবাদী। কেউ সহিংস উগ্রবাদ চর্চা করছে তো কেউ অসহিংস উগ্রবাদ চর্চা করছে। এখন বাংলাদেশের নাগরিকরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক বাংলাদেশের নিজস্ব যে চেতনা গড়ে উঠেছে সেই আদর্শের পক্ষে ভোট দিবেন, না কি একটি নির্দিষ্ট ধর্ম, রাজনৈতিক মতবাদ, বা পশ্চিমা ভাবধারায় উজ্জ্বীবিত আদর্শের পক্ষে ভোট দিবেন তার ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কোন বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে।

যারা উপরোক্ত কোনও এক আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত কিংবা নিজের জীবনে ওই সকল আদর্শের সক্রিয় চর্চা করেন, তারা চোখ বন্ধ করে যার যার দলের মার্কায় ভোট দিবেন, এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু যারা আদর্শিক টানাপড়েনে ওই সকল দলের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন, কিংবা জনসংখ্যার বিপুল অংশ যারা নিজেদের আদর্শিক অবস্থান নিয়ে নিশ্চিত নন এবং নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে চান তাদের বিবেচ্য বিষয় কী হবে?

এক্ষেত্রে হয়তো ভোটাররা দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অদৃশ্যমান গুণগত উন্নয়ন দুই-ই বিচার করবেন। তারা বিবেচনা করবেন স্বাধীনতা পরবর্তী যারা যারা ক্ষমতায় এসেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কারা উন্নয়ন করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ভোটাররা প্রথমেই দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন (যেমন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান হার, দারিদ্রতা হ্রাস, সার্বজনীন শিক্ষার হার বৃদ্ধি, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, কল্যাণভাতা প্রচলন ও বৃদ্ধি সহ নানাবিধ বিষয় উন্নয়ণ) বিবেচনা করবেন।

দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি ভোটাররা গুণগত উন্নয়নের বিষয়টিও বিবেচনা করবেন। গুণগত উন্নয়ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের মতো দৃশ্যমান নয়, এটা অনেকটা অদৃশ্য কেননা এ উন্নয়ন প্রস্ফুটিত হয় দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যক্তি যাচাই করতে পারে দেশে গুণগত পরিবর্তন বা উন্নয়ন কতোটা হয়েছে। গুণগত উন্নয়নের অভিজ্ঞতা নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর মূল ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন সময়ের সহিংস-অসহিংস ভূমিকা ও আধিপত্য বিস্তার, দলের নেতা কর্মীদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দেশে আইনের শাসন, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ ইত্যাদির উপর। এই গুণগত উন্নয়নের বিচার দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতাধর, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, সামন্ত শ্রেণি, এবং সুশীল জনগোষ্ঠীর পক্ষে নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য। কেননা এরা প্রত্যেকেই তুলনামূলক সুবিধাভোগীদের কাতারে পড়েন এবং স্বীকৃত এবং অস্বীকৃত নানা পন্থায় এদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা সর্বসাধারণের চেয়ে ভিন্ন হওয়ার কথা। তাই গুণগত উন্নয়ন বা পরিবর্তন এই সর্বসাধারণরাই ভালো পরিমাপ করতে পারবেন। সঙ্গত কারণেই, যারা সহিংসতাকে ত্যাগ করতে পেরেছেন এবং স্বজনপ্রীতি পরিহার করে আইন ও নিয়মনীতিভিত্তিক একটি ব্যবস্থার প্রচলন করতে পেরেছেন তাদেরকেই হয়তো সাধারণ গোষ্ঠী ভোট দিবেন।

তাই আসছে ৩০শে ডিসেম্বর নির্বাচনে ভোটাররা কাদেরকে বা কোন দলকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন তা নির্ভর করছে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শিক অবস্থান স্পষ্ট কি না, তারা অতীতে কতটা দৃশ্যমান অবকাঠামোগত এবং অদৃশ্যমান গুণগত উন্নয়ন করেছেন, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের আদর্শিক অবস্থান ও ভবিষ্যতের উন্নয়ণ প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট কি না, এবং অতীতে দেওয়া নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করেছেন কি না ইত্যাদি বিষয়ের ওপর। তবে ভোটাররা আদৌ ভোট দিবেন  কি না কিংবা ভোট দিতে পারবেন কি না, তা পুরোটাই নির্ভর করবে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ হবে কি না তার ওপর।