জামায়াতেও মুক্তিযোদ্ধা আছে!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 2 Dec 2018, 01:51 PM
Updated : 2 Dec 2018, 01:51 PM

বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ সবসময়ই আমাদের প্রেরণার উৎস। কারণ মুক্তিযুদ্ধ না হলে আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেতাম না। পেতাম না আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে এগিয়ে চলছে। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ গৌরবের আসনে সমাসীন। এটা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদেরই অবদান।

কিন্তু এই দেশকে যারা মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারিনি, তারা আজও নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের অগ্রযাত্রাকে পিছিয়ে দিতে চায়। এদের মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী নামক দলটি। সবচেয়ে দু:খজনক হচ্ছে, এই্ দলটির সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ও রক্ষাকর্তা হিসেবে এগিয়ে এসেছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন এই দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ভারী অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন আক্রান্ত দেশবাসীর পক্ষে না দাঁড়িয়ে আক্রমণকারীর পাশে দাঁড়ায় জামায়াত। সেসময় রেডিওতে দেয়া এক ভাষণে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাশে থাকার উদাত্ত  আহ্বান জানান। এরপর ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে নিয়ে গোলাম আযম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে পরামর্শ করেন। বুদ্ধি দেন বাঙালি নিধনের। আর জামায়াতের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠন করা হয় রাজাকার বাহিনী। এই দলের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ গড়ে তোলে খুনি বাহিনী আলবদর, যারা জড়িত ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যায়।

পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার দায়ে মুক্তিযুদ্ধের পর নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতকে। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তাদেরকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। পাকিস্তানি পাসপোর্টে দেশে আসার সুযোগ পান গোলাম আযম, ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও তিনি দেশ ছাড়েননি। পরে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি নাগরিকত্বও পান।

১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ও বিএনপি আসনভিত্তিক সমঝোতা গড়ে তোলে। আর ১৯৯৯ সালে জোটবদ্ধ হয় দুই দল। ২০০১ সালে এই জোট ক্ষমতায় আসার পর আলবদর বাহিনীর দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ হন মন্ত্রী।

জামায়াত একটি অভিশপ্ত দল। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এই দলের অনেক নেতা অভিযুক্ত। জঙ্গিবাদই দলটির আদর্শ। অথচ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সম্প্রতি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামীতেও মুক্তিযোদ্ধা আছে!

এবার চট্টগ্রাম-৬ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী। জয়পুরহাট-১ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন আরেক মানবতাবিরোধী অপরাধী আবদুল আলীমের ছেলে ফয়সাল আলীম। আরেক দণ্ডিত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদীকে পিরোজপুর-১ আসনে ছাড় দিয়েছে বিএনপি। শুধু তাই নয়, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধন বাতিল হওয়া মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামীকে এবার ধানের শীষ প্রতীক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।

বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান যে মন্তব্য করেছেন, এর মধ্য দিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকেও খাটো করেছেন। একটি যুদ্ধাপরাধী দলের পক্ষে এমন মন্তব্য বিবেক-বিবেচনাহীন নির্লজ্জ দালালি ছাড়া কিছু নয়!

জামায়াতের মতে গণতন্ত্র হলো কুফরি মতবাদ। আর মুক্তিযুদ্ধ তো তারা স্বীকারই করে না। তারা বলে ওটা ছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এর থেকে বড় অপমান আর কিছু হতে পারে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৬৮ বছর পর নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে যারা এখনো বেঁচে আছে, তাদের বিচার করার লক্ষ্যে ওদেরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি জার্মানি একটা গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, যার নাম দিয়েছে, 'অপারেশন লাস্ট চান্স' ।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই নাৎসি যুদ্ধাপরাধীরা যে অপরাধ করেছে তা সব কালের সীমা ভেদ করে এখনও দগদগে। তাই মানবতার কল্যাণের জন্য তাদের বিচার অপরিহার্য। আর বাংলাদেশে মাত্র ৪৭ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে জামায়াত-বিএনপি যা বলছে, তাকে বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী বলা যায়?

যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত বিচারিক আদালত রায়ে উল্লেখ করেছে, জামায়াতে ইসলামী যে একটা সন্ত্রাসী সংগঠন তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ সংগঠনের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় কোনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে না রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আদালত। এহেন জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় যাবার জন্য গাঁটছড়া বেঁধেছে। এখন আবার এই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় মগ্ন হয়েছে! স্বার্থের জন্য, ক্ষমতার জন্য নজরুল ইসলাম খানরা আর কত বিবেকভর্তা উপহার দেবেন? জামায়াতের মহিমাকীর্ত্তন করবেন?

কেউ ভোলেনি ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা এবং পঁচাত্তরের পর থেকে আজ পর্যন্ত জামায়াতকে পুনর্বাসিত করতে বিএনপির আমরণ চেষ্টার কথা। সুতরাং মুখে শেখ ফরিদ বগলে ইট, এমন ভাব প্রকাশের জন্য দু-একজন পদস্খলিত মুক্তিযোদ্ধাকে জামায়াতের সঙ্গে একই মঞ্চে বসিয়ে মানুষকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না।

নজরুল ইসলাম খানরা কী করে অস্বীকার করবেন যে, ১৯৭৫-এর পর জামায়াতকে ফিরিয়ে সেই রাজনীতিকে বৈধতা দেয় বিএনপি? সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের আপস খুবই দৃশ্যমান৷ তবে বিএনপি জামায়াতকে না ফেরালে গল্পটা নিশ্চয়ই অন্যরকম হতো৷

দলের নামে 'ইসলামী' শব্দটি থাকলেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী কী কী অপকর্ম করেছিল তা তো সবাই জানেন৷ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার আর ধর্ষিতা নারীর স্মৃতিতে সেসব আছে, ইতিহাসের পাতায়ও তা লেখা আছে৷ তারপরও বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান এমন মন্তব্য করেন কীভাবে-সেটাই বিস্ময়ের!

জেনারেল জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

তিনি ১৯৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ন্যাশন্যাল পার্টি (বিএনপি) গঠন করেন। সে সময় তার দলে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও আওয়ামী লীগের পক্ষের খুব বেশি সংখ্যক লোক যোগ দেননি। প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতবিরোধী নেতা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী কিছু বাম ঘরানার রাজনীতিবিদ, পাকিস্তানপন্থি কিছু সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা দলটির নেতৃত্বে আসেন। দলটির উপরে কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে দুধের সরের মতো ভেসে থাকতে দেখা যায়। অন্যদিকে দলটির অভ্যন্তরে বিলীন হয়ে যায় মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীসহ পাকিস্তান শাসনামলের ধর্মভিত্তিক ও আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর লাখ লাখ নেতা-কর্মী-সমর্থক। ফলে পুনরুজ্জীবন লাভ করলেও ধর্মভিত্তিক দলগুলো এবং আওয়ামী লীগবিরোধী জাসদসহ সব দল নেতা-কর্মী-সমর্থক হারিয়ে কাগুজে দল হয়ে যায় এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিএনপি ফুলেফেঁপে ওঠে। যেভাবেই বলা হোক না কেন, বিএনপি কখনোই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির রাজনৈতিক দল ছিল না। দলটিতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষক-প্রেমিক কিছু সংখ্যক উদ্দেশ্যবাদী মুক্তিযোদ্ধা ছিল মাত্র। দলটির কর্মকাণ্ড তারই সাক্ষ্য বহন করে।

একদা বিএনপি নেতা এবং বর্তমানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা কর্নেল অলি আহমেদ তার 'আমার সংগ্রাম আমার রাজনীতি' নামক বইতে একাত্তরের রাজাকার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানিয়ে বলেছিলেন, "একবার যে বেঈমানি করে বা দালালী করে সে সারাজীবনই বেঈমানি ও দালালী করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।"

আরেকটি সাক্ষাৎকারে তিনি জাতি, ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে ঐক্যের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী খুনিদের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ''অন্যথায় সময় ও সুযোগ পেলে তারা এ দেশের দেশপ্রেমিক জনতার ওপর গোখরো সাপের মতো বিষাক্ত ছোবল মারতে পারে।" [পৃ. ২৮৪]

যে রাজাকারদের নিয়ে কর্নেল অলি এক সময় উল্লিখিত সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, সেই রাজাকারের সমর্থনেই আজ কর্নেল অলির জোটের নেতা নজরুল ইসলাম খান মাঠে নেমেছেন। কিন্তু জনাব খান, ইতিহাসকে অস্বীকার করবেন কীভাবে? ইতিহাস যে জামায়াত এবং বিএনপিকে সমানভাবে কলঙ্কিত করে রেখেছে!

পরিশেষে নজরুল ইসলাম খানকে সবিনয়ে বলি, বিএনপির রাজনীতি করতে গিয়ে আর কত বিবেককে নিলামে তুলবেন? আর কত নিচে নামবেন? সামান্য একটু পদ-পদবি-ক্ষমতার জন্য রাজাকার-আলবদরদের পায়ের নিচে নিজেকে সমর্পণ করবেন? দোহাই আপনার, এভাবে নিজেকে অপমান করবেন না। স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতীদের কাছে আপনি আপনার সত্তাকে বন্ধক দিচ্ছেন দিন, দয়া করে একাত্তরের শহীদ এবং মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করবেন না।