নতুন ভোটার, প্রথম ভোট- স্বাধীনতার পক্ষে হোক

মামুন আল মাহতাব
Published : 22 Nov 2018, 12:25 PM
Updated : 22 Nov 2018, 12:25 PM

হাইকোর্টের রায়ের ধারাবহিকতায় সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নিবন্ধন বাতিল করেছেন নির্বাচন কমিশন। স্বাধীন বাংলাদেশে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার এমন ধাক্কা খেল দলটি। প্রথমবার ছিল স্বাধীনতার পর পর। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোনও সুযোগ রাখা হয়নি। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর বহুদলীয় রাজনীতির মোড়কে চকলেট ক্যারামেলের কোটিংয়ে জামাতের পচা পেস্ট্রি আবারো বাংলাদেশকে গিলিয়েছিলেন মরহুম জিয়াউর রহমান। এরপর বহুদুর এগিয়েছে দলটি।

জাতীয় সংসদে নিজেদের সাংসদ আর এমনকি সার্বভৌম বাংলাদেশের কেবিনেটে নিজেদের মন্ত্রীও পেয়েছে জামায়াত। সফল হয়েছে দেশের একাধিক প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে, র‌্যাডিকালাইজড করতেও। আমাদের স্বাধীন বিচার বিভাগের বহু প্রশংসনীয় রায়ের অন্যতম হচ্ছে, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল সংক্রান্ত রায়টি। প্রশাসনিক আদেশে কিংবা আইন করে কোনও মৌলবাদী দলকে নিষিদ্ধ করা যায় ঠিকই এবং সম্ভবত তুলনামূলকভাবে অনেক সহজও।

কিন্তু সে ব্যবস্থাপনা যে আদৌ টেকসই কিছু নয় তার প্রমাণ তো জামায়াত নিজেই। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সুযোগ পেলেই ওই একই প্রক্রিয়ায় নিয়মের ঘড়িকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে সব সিদ্ধ করে নিতে পারে। তবে আদালতের ব্যাপারটা ভিন্ন। আদালতের রায়কে উল্টাতে পারে শুধু তার চেয়েও উচ্চতর আরেকটি আদালতের রায়ই। আর রায় যদি আসে যুক্তি আর প্রমাণের ভিত্তিতে, অনেক কিছুই অনেক পরিস্থিতিতে উল্টে দেয়া গেলেও, আদালতের রায় উল্টে দেয়াটা ঠিক ততটাই কঠিন।  অতএব আন্তরিক ধন্যবাদ বাংলাদেশের স্বাধীন, সার্বভৌম বিচার বিভাগকে।

উচ্চ আদালতের অমন রায়ের পর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়াটা ছিল প্রত্যাশিত এবং প্রত্যাশিতভাবেই নির্বাচন কমিশন তাদের উপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। খবরটা খবর হলেও অতটা খবর হয়নি সে কারণেই। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন এমন একটা সময়ে এই খবরটার জন্ম দিয়েছে- যখন বাংলাদেশের খবর মানেই জোটের জট – জোটের জটে সয়লাব প্রিন্ট, অনলাইন আর ইলেকট্রনিক মিডিয়া। অতটা সাড়া জাগায়নি খবরটি পত্রিকার পাতায় কিংবা টিভির পর্দায়, কিন্তু কোটি প্রাণে বইয়ে দিয়েছে আনন্দের ফল্গুধারা। ফেইসবুকে আর আড্ডায় এর প্রতিফলন স্পষ্টই। জামাতের রাজনৈতিক ও আদর্শিক মিত্র বিশ দলীয় জোটও যতদূর জানি এ নিয়ে সঙ্গত কারণেই মুখ খোলেনি। মুখ খোলেনি যতদূর জানি জামায়াতের নতুন মিত্র জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও। ভাল, নি:সন্দেহে ভাল! অশুভ মস্তিস্কেও যে শুভ চিন্তা মাঝেসাঝে ইতি-উতি উঁকি দেয় এটি তার উদাহরণ।

খুশি হয়েছেন অনেকে। খুশি হয়েছি আমিও। কিন্তু খুশি হয়েও খুশি হতে পারিনা কেন যেন! শুধু নিবন্ধন বাতিলই যথেষ্ঠ! এমনটা মনে করার আদৌ কি কোনও কারণ আছে যে নির্বাচন কমিশনের রেজিস্টার থেকে জামায়াতের নাম ডিলেট হওয়া মাত্রই তারা ডিলেট হয়ে গেছে আমাদের চিন্তায় আর মননে? ত

এত বছরের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিপুল বৈভবের সাথে আর্দশের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছে সংগঠনটি। ধর্মকে ব্যবহার করে সেই কন্টকহীন ঘৃণার মতাদর্শ বছরের পর বছর ধরে তারা প্রচার করেছে। তার পরিণতিতে আজ তারা আপনার-আমার চারপাশে, এমনকি আমাদের ভিতরেও।

বড় লেখা পড়তে এবং লিখতে গেলে ধৈর্য লাগে। তাই লেখাটাকে টেনে আর লম্বা না করে দুটো উদাহরণ দেই। ভদ্রলোক বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্বাধীনতার স্বপক্ষের সবচেয়ে বড় দলটি থেকে আসন্ন নির্বাচনে একটি আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। বড় শিল্পপতি। এখন অনেক শিল্পপতির মতোই জীবনের একটা পর্যায়ে এসে রাজনীতিতেও আগ্রহী। সম্প্রতি একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি গর্বিত ভঙ্গিতে বলেছেন, কোনও সংখ্যালঘুর কোনও বিষয়েই কখনই তিনি সহায়তার হাত বাড়ান না। তার সাফ জবাব একজন 'সাচ্চা' মুসলমান হিসেবে এটিকে তিনি অন্যায় বলে মনে করেন। তিনি যে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী, সেই দল আর দলের সরকার যে এ দেশের সংখ্যালঘু কমিউনিটির শেষ ভরসার স্থল, সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকরা এমনটি মনে করিয়ে দেয়ায় তিনি বলেছেন, এটি সরকারের সরকারী দায়িত্ব, ব্যক্তিগতভাবে কোনও সংখ্যালঘু তার দ্বারা উপকৃত হবেন না!

সম্প্রতি ঢাকার অভিজাত বনানী এলাকায় এক চেইন শপে গিয়েছিলাম কেনাকাটা করতে। শুক্রবার সন্ধ্যাগুলোতে সুযোগ পেলে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরির ফাঁকে মাঝেসাঝেই ওখানটায় যাওয়া পরে। যা দরকার কিনি। বেশি কিনি, সম্ভবত যা দরকার না তাও কিনি। চেইন শপটায় ঘুরতে ঘুরতে চোখ হঠাৎ আটকায় – বিক্রি হচ্ছে জীবন্ত মুরগি, পাশে লেখা 'পাকিস্তানি'!

প্রথমে বিক্রেতা আর পরে ম্যানেজার জাতীয় একজনের কাছে জানতে চাইলাম জীবিত মুরগির পাশে হঠাৎ পাকিস্তানের নামটি লেখার কারণ। সদুত্তর পাইনি। পেয়েছি অদ্ভুত যত উত্তর। এই মুরগির ডিম নাকি বিমানে করে আমদানি করা হয়। আবার বলা হলো, আমদানি হয় জীবিত মুরগির ছানাই। আমি নিশ্চিত জানি, এই কোনওটাই ঠিক না। আর যদি তর্কের খাতিরে ঠিক বলে ধরেও নেই, তাতে কী?

ওই আউটলেটটির হাজারো পণ্যের একটিতেওতো উৎপাদনকারী দেশের নাম লেখা নেই। তবে কেন শুধু জীবিত মুরগির বেলায় লেখা? অতি আগ্রহী আমি নিজের সংগ্রহের জন্য আগ্রহভরে চেইন শপটির সেই ডিসপ্লে কার্ডটির একটি ছবি তুলে সযত্নে সংরক্ষণ করছি।

আসলে সমস্যাটা অন্যখানে। সমস্যা ওদের মননে, আমাদের চিন্তায়, উনাদের চেতনায়। জামাতের নিবন্ধন বাতিল করা তাই সমস্যা সমাধানের সূচনা মাত্র, শেষ নয়। যেতে হবে আরো বহুদূর, করতে হবে অনেক কিছুই। অমন এমপি মনোনয়নপ্রত্যাশীকে যেমন নৌকার ব্যালট থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে তেমনি শপিং সেন্টারগুলোতে অমন ডিসপ্লে কার্ড যেন প্রতিবাদী করে সবাইকে।

আসছে নির্বাচনটা বড় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনও নির্বাচনই তাই, তবে এবারেরটা আরও বেশি।  কারণ এবারই সম্ভবত সর্বোচ্চ সংখ্যক তরুণ ভোটার প্রথমবারের মতো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু পাকাপাকিভাবে বাতিল করে দিতে পারে শুধু তারাই।

একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার সাম্প্রতিক আদর্শিক ডিগবাজির প্রেক্ষাপটে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন তার নিজের পুত্র এবং কন্যা। ধারণা করছি, প্রত্যেকেই সম্ভবত এবার প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা পিতা শুধু ক্ষমতার মোহে পরোক্ষ জামায়াত তোষণকে আপন করে নিয়েছেন, এমনটা মেনে নিতে পারেনি এই প্রজন্মের সন্তানরা। জাতি এমন সন্তানই চায়।  জাতির এমন সুযোগ্য সন্তানরাই আসন্ন নির্বাচনে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করবেন এমনটাই তাদের অগ্রজ হিসেবে তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা।

কিসের ঐক্য? কিসের জোট? আমরা অতশত বুঝিনা, বুঝতে চাইও না। আমাদের একটাই প্রত্যাশা, 'নতুন ভোটার, প্রথম ভোট  – স্বাধীনতার পক্ষে হোক'।