বাদ যাবে না কোনও ‘দেবরাজ’

Published : 19 Nov 2018, 02:56 PM
Updated : 19 Nov 2018, 02:56 PM

কাহিনীটি তো অনেকেরই জানা। অহল্যা ও দেবরাজ ইন্দ্রের সেই ঘটনা। ঋষি গৌতমের স্ত্রী অহল্যার প্রতি আসক্তি ছিল দেবরাজের। গৌতমের অনুপস্থিতিতে তাই তারই ছদ্মবেশ ধরে অহল্যার কাছে আসেন তিনি, তার সঙ্গে শারিরীক সম্পর্কও  গড়েন।  এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত গৌতম দেবরাজকে শাপ দেন যেন তার সারা দেহে যোনি চিহ্ন দেখা দেয়। পরে অবশ্য ইন্দ্রের সকাতর ক্ষমা ভিক্ষায় সেগুলোকে লোচন চিহ্নে পরিণত করা হয়। সম্প্রতি মি টু আন্দোলনে আবার এই পুরনো কাহিনীটি মনে পড়লো।

কারণ মি টু আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য, সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত অনেকেরই মুখোস খুলে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বলে পারছি না। আমাদের মানসিকতায় একটা বড় ধরনের গলদ রয়েছে। আমরা প্রায়শই 'প্রতিভবান' ও 'উন্নত' মানুষের মধ্যে ধারণাগুলো গুলিয়ে ফেলি। একজন মানুষ মেধাবী হতে পারে, প্রতিভাবান হতে পারে, বিখ্যাতও হতে পারে। তারমানে কিন্তু এই নয় যে মানুষ হিসেবে বা মানবিক গুণাবলীর দিক থেকে সে অবধারিতভাবে উন্নত হবে।

আবার অনেক অমেধাবী, অপ্রতিভাবান ও অখ্যাত মানুষও মানবিক গুণাবলীর দিক থেকে অনেক উন্নত হতে পারে। কারও প্রতিভার কদর করার অর্থ এই নয় যে, তার যে কোনও অন্যায় বা নিপীড়নমূলক আচরণকেও সমর্থন  করতে হবে বা তার বিষয়ে বুদ্ধিবিবেচনা হারিয়ে ফেলতে হবে। কোন মানুষ সম্পর্কেই অন্ধত্ব কখনও কাম্য নয়। আমরা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই কথাগুলো ভুলে যাই। যখন কোন মানুষের প্রতিভায় আমরা মুগ্ধ হই, তার ভক্ত হয়ে যাই, তখন তার নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে প্রাণপণে চোখ বুজে থাকতে চাই। এই বন্ধ হওয়া চোখকেই খুলে দিতে চাচ্ছে মি টু আন্দোলন। অনেক দেবপ্রতিমার খড়-মাটি দেখা যাচ্ছে। যারা অভিযোগ করছেন তাদের সাহসের তারিফ না করে পারছি না। কারণ, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় যখন কোন নারী তার বিরুদ্ধে সংঘটিত যৌন হয়রানির বিষয় প্রকাশ করেন তখন সেই নারীকে 'খারাপ' নারী হিসেবে চিহ্নিত করতে রীতিমতো উঠে পড়ে লাগে সমাজের একদল মানুষ। কারণ দেখা যায়, যৌন নিপীড়ক সেই অভিযুক্ত হয়তো কারও বন্ধু, কারও ভাই, কারও পুত্র, কারও স্বামী, কারও শিক্ষক, কারও চাকরিদাতা ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধারণত নিপীড়ক ব্যক্তিটি হন ক্ষমতাবান। অথবা নিপীড়নের সময় ক্ষমতাবান ছিলেন। ক্ষমতার প্রতি আমাদের মোহ রয়েছে। আর ওই ব্যক্তির কাছে অনেকেরই হয়তো রয়েছে ব্যক্তিগত স্বার্থ। অথবা রয়েছে অন্ধ ভক্তি বা প্রীতি বা অন্য কোনকিছু। ফলে আমরা তখন অভিযোগকারীকেই দোষী বলে মনে করি। এমনও হতে পারে অভিযোগকারীর প্রতি আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ আছে, কিংবা হয়তো তারও কিছু আচরণগত সমস্যা রয়েছে বলে আমার জানা, কিংবা হয়তো অভিযোগকারীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি না।  অভিযোগকারী ধোয়া তুলসিপাতা না হতে পারে, তার নিজেরও চারিত্রিক নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য থাকতেই পারে। মোটকথা অভিযোগকারী যদি একজন খারাপ মানুষও হয়, তারমানে কিন্তু এই নয় যে তার অভিযোগটি মিথ্যা কিংবা গুরুত্বহীন। অভিযোগকারীর ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তার প্রতি সংঘটিত যৌন হয়রানির বিচার পাওয়ার অধিকার বা সেটি প্রকাশের অধিকার খর্ব হয়ে যায় না।

এবার আরেকটি কথা বলি। যৌন হয়রানি যে শুধু পুরুষই করে তা নয়। নারীও করতে পারে। মূলত এটি ক্ষমতা প্রকাশের বিকৃত খেলা। একজন ক্ষমতাবান অন্য একজন ক্ষমতাহীনকে যৌন হয়রানি করে নিজের ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করে। শিশুরা ও কিশোরবয়সীরা তাদের তুলনায় বয়স্কদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার বেশি হয়। কারণ বয়স্করা তাদের তুলনায় সামাজিকভাবে ক্ষমতাবান। আমাদের সমাজে, পরিবারে ও কর্মক্ষেত্রে যেহেতু পুরুষরাই তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষমতার জায়গায় থাকে তাই তাদেরকেই বেশি নিপীড়কের ভূমিকায় দেখা যায়।

কিন্তু কোনও নারীও নিশ্চিতভাবেই নিপীড়ক হতে পারে যদি সে ক্ষমতার জায়গায় থাকে এবং সেই ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটিয়ে অন্যকে যৌন হয়রানি করে। মি টু আন্দোলন তাই কোনওভাবেই কেবলমাত্র নারীর আন্দোলন নয়। এটি নারী-পুরুষ উভয়েরই মানবিক অধিকার অর্জনের আন্দোলন। সকল বিবেকবান মানুষেরই এই আন্দোলনে সামিল হওয়া নৈতিক কর্তব্য। কিন্তু মুশকিল হলো আমাদের বিবেকের চেয়ে স্বার্থবুদ্ধি ও অন্ধভক্তি অনেক বেশি। সমাজের ক্ষমতাবান অনেককেই দেখছি মি টু আন্দোলনে অভিযোগকারীকেই দোষী সাব্যস্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন এবং মি টু আন্দোলনের বিপরীতে ভূমিকা রাখছেন। কারণটা কি থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ার ভয়? যার থলেতে বিড়ালের অস্তিত্ব নেই তার কিন্তু মি টু আন্দোলনে ভয় পাওয়ার বা এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কোন কারণ নেই। ভয় তারাই পাবেন যাদের নিজেদেরও ওই দোষ আছে। তেনারা হলেন ইউ টু।

আরেকটি কথা অনেকে বলছেন যে, মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে টানাটানি করা ঠিক হচ্ছে না। এক্ষেত্রে বলতে চাই মানুষ মৃত হলেই সকল পাপের দায় থেকে রেহাই পেতে পারে না। বিশেষ করে ভিকটিম যেখানে জীবিত এবং এখনও ভুক্তভোগী। নিপীড়ক জীবিত বা মৃত যাই হোক ভিকটিমের অধিকার আছে তার উপর সংঘটিত অন্যায়কে জনসমক্ষে তুলে ধরার। হ্যা, তারপর অবশ্যই সাক্ষ্যপ্রমাণের পালা আসতে পারে।

জীবিত নিপীড়কদের উদ্দেশ্যে আমার একটা পরামর্শ আছে। যদি নিজেকে অপরাধী বলে জানেন তাহলে অভিযুক্ত হওয়ার আগে নিজেই স্বীকারোক্তি প্রদান করুন। স্বীকারোক্তিতে পাপ পুরো না কাটলেও পাবলিক সেন্টিমেন্ট অন্তত আপনার পক্ষে যেতে পারে। সেটাই বা কম কি?

মোট কথা মি টু আন্দোলনকে আমি সমর্থন জানাচ্ছি। অহল্যারা তো অনেক বছর ধরেই ভুগছে। এবার দরকার ইন্দ্র ও জিউসদের চরিত্র তুলে ধরা। যাতে অন্যরা সাবধান হতে পারে।