নির্বাচনী সহিংসতার শঙ্কা

কবির য়াহমদ
Published : 18 Nov 2018, 11:59 AM
Updated : 18 Nov 2018, 11:59 AM

একাদশ সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) ইতোমধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। প্রথম তফসিলের পর রাজনৈতিক দল ও জোটের দাবির মুখে ভোটের তারিখও পিছিয়েছে। রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। মনোনয়ন সংক্রান্ত প্রস্তুতির বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করার পর্যায়ে তারা।

এরই মধ্যে দুই দফা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে গেছে। দুইজন লোক মারা গেছে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে বিএনপির সমর্থকেরা। পুলিশের গাড়িতেও আগুন দিয়েছে তারা। গাড়ি পুড়ানোর সেই দৃশ্য গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একাধিক মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তারও হয়েছে অর্ধশতাধিক। এর বাইরে গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়িতে আগুন দেওয়া নাশকতাকারী পুলিশ খুঁজছে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বিক্রির প্রথম ধাপে রাজধানীর মোহাম্মদপুর আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে দুইজন লোক মারা গেছে। আর বিএনপির মনোনয়ন ফরম বিক্রির এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এই ঘটনাগুলো আসন্ন নির্বাচন নিয়ে উৎকণ্ঠার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই উৎকণ্ঠা নির্বাচন অনুষ্ঠানের যতটা না, তারচেয়ে বেশি জননিরাপত্তার। কারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুদলই জিততে যায়, এবং সেটা হতে পারে যেকোনও মূল্যে। মোহাম্মদপুরের খুনের ঘটনা, নয়াপল্টনের নাশকতার ঘটনা সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন দশ বছর ধরে। এই সময়ে বিএনপি ছিল মাঠছাড়া। একাদশ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দলটি দলটি যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, এরপর নয়াপল্টনকে ঘিরে জনস্রোতের সৃষ্টি হয়। সেই জনস্রোতে নয়াপল্টনের আশপাশের এলাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। টানা দুই দিন সে এলাকা প্রায় অবরুদ্ধ রাখার পর তৃতীয় দিনে পুলিশ সেখানে শৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষত জনদুর্ভোগ লাঘবে সামান্যতম হলেও পদক্ষেপ নিতে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের দ্বারা। এক পর্যায়ে সেটা গাড়ি পুড়ানো পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্থিরচিত্র ও ভিডিওচিত্রে কতিপয় হেলমেটধারী যুবকের দেখা মেলে যারাসহ আরও কিছু লোক পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার নেতৃত্ব দেয়। তাদের হাতে লাঠিসোঁটারও দেখা মেলে, ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে তারা। কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন সংগ্রহ করতে কেউ লাঠিসোঁটা কিংবা ইটপাটকেল নিয়ে হাজির হবে- এটা স্বাভাবিক চিন্তা নয়। এর পেছনে নিশ্চয়ই সন্ত্রাস ও নাশকতার পরিকল্পনা কিংবা প্রস্তুতির ব্যাপার রয়েছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই যে পুলিশের 'হামলা' প্রতিরোধে বিএনপির নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা হাতে নিয়েছে, তবে এই লাঠিসোঁটার মজুত ও যোগান নিশ্চয়ই আগে থেকে ছিল। সেক্ষেত্রে প্রশ্নটা স্বাভাবিক যে কেন এমন প্রস্তুতি থাকবে মারামারির, কীভাবেই থাকে এমন মজুত?

পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের এমন ভূমিকায় একবাক্যে পুলিশের ওপর সকল দায় চাপিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ওখানে যদি বিএনপি নেতাকর্মীরা খালি হাতে থাকত তাহলে একবাক্য বলা যেত পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ করেছে। কিন্তু সেখানকার অবস্থা ছিল ভিন্ন। বিএনপি আগ্রাসী নেতাকর্মীদের অবস্থান তাদেরকে অপরাধীর কাতারে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। মারামারি কিংবা নাশকতার পরিকল্পনা যে এর পেছনে ছিল না সেটা কে বলবে?

নয়াপল্টনের সংঘর্ষের ঘটনার পর স্বাভাবিকভাবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরষ্পরবিরোধী অবস্থান পরিষ্কার করেছে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, সরকারের নির্দেশে পুলিশ বিনা উসকানিতে তাদের ওপর হামলা করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, 'ইস্যু তৈরির উদ্দেশ্যে' পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, হেলমেটধারী ছাত্রলীগ নেতারা হামলা করেছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্য থেকে এনিয়ে পরিষ্কার কোন ধারণা পাওয়া যাবে না। তারা  দায় এড়িয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ওপর দায় চাপানো যায় এমন বক্তব্য দিয়ে গেছেন।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য থেকে এই ঘটনা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য পাওয়া না গেলেও পুলিশ বলছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে 'ইস্যু তৈরির চেষ্টা' থেকে এমন ঘটনা ঘটেছে। এটা পুলিশের প্রাথমিক বক্তব্য, তদন্ত শেষে নিশ্চয়ই পুরো বর্ণনা আসবে তাদের তরফ থেকে। তবে ইস্যু তৈরির যে চেষ্টার কথা বলছে পুলিশ সেখানে কিছুটা হলেও যুক্তি রয়েছে। কারণ বিএনপি নির্বাচনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেও একইভাবে নির্বাচন পেছানোর দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের দাবি আমলে নিয়ে ইসি ইতোমধ্যেই নির্বাচনের তারিখে পিছিয়েছেও। নির্বাচনকালীন দলীয় সরকার নিরপেক্ষ আচরণ করছে না বলেও তাদের অভিযোগ। কেবল সরকারের বিরুদ্ধেই তাদের অভিযোগ নয়, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও তাদের এন্তার অভিযোগ। এমন অবস্থায় নিজেরা পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়িতে আগুন না দিলেও (দিতেও পারে, যদিও সেটা তদন্ত ও প্রমাণসাপেক্ষ) এমন ঘটনা ঘটলে সেটা তাদের চলমান অভিযোগগুলোকে শক্তিমান করে। তবে একই সঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার সময়ে বিএনপির নেত্রী নিপুণ রায়ের ভূমিকা যেখানে একটি টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়েও তার হাতে একটা লাঠি ধরা ছিল। এই লাঠি যতটা না আত্মরক্ষার, তারচেয়ে বেশি আগ্রাসী ভূমিকার।

নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে এই সংঘর্ষের ঘটনা, গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশের গাড়িতে আগুনের ঘটনার প্রাথমিকভাবে নানা জনের নানা মতের প্রকাশ হয়েছে। তবে এরআগের টানা দুইদিন সহ ওইদিনের লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশে নিশ্চয়ই সরকার সমর্থক কোনও সন্ত্রাসীর এমন আগ্রাসী হয়ে ওখানে ঢোকার কথা না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল যতই এই হামলার পেছনে সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের যোগের দাবি করুন না কেন এত মানুষের মধ্যে কথিত ওসব সরকার সমর্থকের সেখানে অনুপ্রবেশের কথা না। তাছাড়া বিএনপি নেত্রী সহ বিএনপির পরিচিত কেউ কেউ সে হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বলেও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, স্থিরচিত্র ও ভিডিওচিত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

হামলা, আগুন, নাশকতার এই ঘটনা আগামী নির্বাচন শান্তিপূর্ণ না হওয়ার একটা ইঙ্গিত তা বলা যায়। এটা হলে সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগের যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং এর শরিক দল বিএনপির সাত দফা দাবির বেশিরভাগই সরকার মানেনি বলে তাদের অভিযোগ। তবু তারা নির্বাচনে যাচ্ছে, এবং বলছে 'আন্দোলনের অংশ' হিসেবে এই নির্বাচনে যাওয়া। নির্বাচনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ রাখছে বলেও জানিয়েছে। এমন অবস্থায় নির্বাচনকে ঘিরে নানা ধরনের সাবোটাজের শঙ্কা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের দশম সাধারণ নির্বাচনে যায়নি বিএনপি। এবারও একই দাবি ছিল তাদের, এরসঙ্গে যোগ হয়েছে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও। সরকারের সঙ্গে  এ দাবিগুলোসহ আরও কিছু দাবি নিয়ে দুই দফা সংলাপ করেও কিছু অর্জন করতে পারেনি তারা। তার ওপর রয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার দণ্ডজনিত কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্যতার বিষয়টি।

যদিও বিএনপি তাদের নেত্রীর জন্যে তিনটি আসনে প্রার্থিতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফৌজদারি মামলায় দুই বছরের বেশি দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রার্থী হতে আইনত অযোগ্য। নির্বাচন কমিশন খালেদা জিয়ার প্রার্থিতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার ওপর এখনই ন্যস্ত করে দিলেও হাই কোর্টে খালেদা জিয়ার আপিল গৃহীত না হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না, সেটা নিশ্চিত। এমন অবস্থায় শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলে 'লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড' তৈরিতে সরকার ও নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে এমন অজুহাতের পাশাপাশি নয়াপল্টনের ঘটনাও তাদের অজুহাত উপস্থাপনে সহায়ক হতে পারে।

তারপরও বিএনপি যদি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচনে থাকে তাহলে আগামী নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্যে কঠিন এক কাজ। আর নির্বাচনে না থাকলেও একইভাবে আরও কঠিন হয়ে যাবে শান্তি ও স্থিতি বজায় রাখা। কারণ দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত দেশব্যাপী যে নাশকতা করেছিল ক'বছরে দল দুটির সন্ত্রাস-নির্ভর সমর্থকেরা দৃশ্যমানভাবে রাজনীতির মাঠছাড়া হলেও তারা প্রকৃত হারিয়ে যায়নি- অদ্যকার এ ঘটনা সে প্রমাণই দিচ্ছে।

নির্বাচন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার। আমরা চাই নির্বাচন হোক অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও অবাধ; এর সঙ্গে সবচাইতে বড় চাওয়া হচ্ছে নির্বাচন হোক শান্তিপূর্ণ। নির্বাচনের জন্যে, গণতন্ত্রের জন্যে কোনো প্রাণের অপচয় কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।