অপরিণত নবজাতকের যত্নে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার

বেগম শরিফুন নাহার এবং ওয়াহিদা সিরাজ
Published : 17 Nov 2018, 08:44 AM
Updated : 17 Nov 2018, 08:44 AM

কোনও পরিবার বা বাবা মায়ের কাছে তার নবজাতকের মৃত্যু কাম্য নয়। আমরা যারা শিশু স্বাস্থ্য ও শিশুর জীবন নিয়ে কাজ করি প্রতিনিয়ত চেষ্টায় থাকি আমাদের দেশে নবজাতকের মৃত্যুর কারণ ও তার প্রতিকার বের করার।

গবেষণা মতে, সময়ের আগে জন্মগ্রহণের জন্য জটিলতার কারণে নবজাতকের মৃত্যু ঘটে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। ৩৫ শতাংশ নবজাতক মৃত্যুর জন্য দায়ী এই অপরিণত জন্ম। সারা বিশ্বে প্রতিবছর ১৫ মিলিয়ন বা দেড়কোটি অপরিণত শিশু জন্ম নেয়।

বাংলাদেশের চিত্র আশঙ্কাজনক। যেসব কারণে নবজাতক মৃত্যু ঘটছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ- অপরিণত নবজাতকের জন্ম জটিলতা। প্রতিবছর এদেশে পাঁচ বছরের নিচে বয়স এমন শিশুদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার শিশু অপরিণত জন্মের জটিলতার কারণে মারা যায়। এর মধ্যে অপরিণত নবজাতকের জন্ম জটিলতার কারণে মৃত্যু ঘটে ৩০ শতাংশের।

সময়ের আগেই জন্মানো অর্থাৎ অপরিণত শিশুর জন্য সবচেয়ে মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয় শরীরের তাপমাত্রা কমে গিয়ে। এছাড়াও, শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা, ইনফেকশন, খেতে না পারা, জন্ডিস, রক্তশূন্যতা- সর্বোপরি শিশুকে বাঁচিয়ে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়ে।

আমরা চাই প্রতিটি শিশু বাঁচুক। এই প্রত্যাশা থেকেই অপরিণত শিশুকে ইনকিউবেটরে রাখা বা অন্যান্য ব্যায়বহুল পদ্ধতি অবলম্বন না করে বিজ্ঞানসম্মত, বিশ্বমানের অথচ অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী একটি সেবা অবলম্বনের কথা আমরা চিন্তা করি, যার নাম 'ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার।'

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার হল সময়ের পূর্বে (৩৭ সপ্তাহের আগে) ও স্বল্প ওজন  (২০০০ গ্রামের নিচে) নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের মায়ের ত্বকের সাথে শিশুর ত্বক লাগিয়ে রেখে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে এনে মায়ের গর্ভের পরিবেশ তৈরি করার একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। পরিবারের অন্য কোনও সদস্যের বুকের সাথে লাগিয়ে রেখেও এই সেবা দেয়া যায়। তবে মায়ের সাথে সন্তানের বন্ধনের তুলনা অন্যকিছুর সাথে চলে না।

১৯৭০ সালের শেষের দিকে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটাতে অপরিণত শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। সেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু মারা গিয়েছিল। ১৯৭৮ সালে শিশু বিশেষজ্ঞ ড. এডগার রে এবং ড. হেক্টর মার্টিনেজ প্রথম ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি শুরু করেন এবং সফলতা পান।

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতিতে আসলে গোটা পরিবার উপকার পায়। সময়ের পূর্বে ও স্বল্প ওজন  নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের  প্রধান সমস্যা তামমাত্রা কমে যাওয়া; গবেষণা বলছে, এই পদ্ধতিতে  শিশুদের  তামমাত্রা কমে যাওয়া রোধ হয় ৬৬% ক্ষেত্রে; কারণ শিশু মায়ের শরীরের তাপ ব্যবহার করে তার শরীরকে গরম রাখে । মায়ের শরীরের তাপ ব্যবহার করে বলে নিজ দেহের চর্বি ব্যবহৃত হয় না; শিশুর ক্যালোরি সংরক্ষিত হয়  ফলে শিশুর ওজন দ্রুত বাড়ে। হরমোনের মাধ্যমে মার বুকের দুধ তৈরিতে শিশুর স্পর্শ  ও গন্ধ সাহায্য করে ফলে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো সহজ হয়, বেশি সময় ধরে মায়ের দুধ পানের সুযোগ পায়। এই শিশুদের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার ঝুঁকি থাকে ; মার শ্বাস শিশুর শ্বাসকে উদ্দীপ্ত করে, ফলে শ্বাস সহজে বন্ধ হয়না। এই পদ্ধতিতে রাখলে শিশুর ভালো ঘুম হয় এবং তার মস্তিষ্কের দ্রুত বিকাশ ঘটে। ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, গবেষণা মতে হাসপাতালজনিত সংক্রমণ ৫৫% কম হয় ক্ষেত্রে । মা ও শিশুর মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হয়, পরিবেশের সাথে সে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। শিশুর যত্নে মায়ের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। সর্বোপরি মা ও শিশু দুইজনের জন্যই পদ্ধতিটি উপকারি। এছাড়া পদ্ধতি শিখে গেলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই শিশুকে নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করতে পারেন মা।

চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতাল থেকে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার শুরু করতে  হবে ও পরিবারের সহযোগিতায় প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ ঘণ্টা শিশুকে বুকের সাথে লাগিয়ে রাখতে হবে। মেডিকেল চিকিৎসা যেমন, শিরায় স্যালাইন বা অক্সিজেন গ্রহণরত অবস্থায়ও এই পদ্ধতি চলতে পারে। শিশুকে প্রতিদিন গোসল করানোর প্রয়োজন নেই। তবে কখনো প্রয়োজন হলে খুবই কম সময়ের মধ্যে হালকা কুসুম গরম পানিতে গোসল করাতে হবে। গোসলের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শরীর ভালভাবে মুছে কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়ে আবারো শুরু করতে হবে। এ সময় শিশুকে নিয়মিত মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। শিশুর মা ও পরিবারের অন্যান্য পরিচর্যাকারীকে পরিষ্কার থাকতে হবে; শিশুর সুরক্ষার জন্য নবজাতককে ধরার আগে, খাওয়ানোর আগে, মলমূত্র পরিষ্কার করার পরে তাদের হাত পরিষ্কার প্রয়োজন । মা শিশুকে ক্যাঙ্গারু অবস্থানে রেখেও সাধারণ কাজকর্ম করতে পারবেন। হাঁটাহাঁটি, ওঠাবসা, হাতের কাজ, বসে থেকে করা যায় এমন হালকা কাজ মায়ের ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার সেবা প্রদানের সময় একঘেঁয়েমি দূর করবে।

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার- বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি; আমরা সচেতন হতে পারলে সাশ্রয়ী এই সেবার ব্যবহারের মাধ্যমে অপরিণত নবজাতকের জন্ম জটিলতার কারণে মৃত্যু অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

ছবি: সেইভ দ্য চিলড্রেনের সৌজন্যে।