অত:পর নির্বাচনে বিএনপি

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 15 Nov 2018, 02:30 PM
Updated : 15 Nov 2018, 02:30 PM

তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অনেকটা বিস্মিত করে দিয়েই বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে সম্মত হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে করা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসে, অল্প সময়ের ব্যবধানে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার যথাক্রমে ৭ ও ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং লন্ডনে থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড লাভের মতো ঘটনা  উপেক্ষা করে নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত দলের বাইরের অনেক সাধারণ মানুষকেও হতবাক করেছে।

ইংরেজিতে একটা কথা আছে "Double jeopardy," যার বাংলা করলে দাঁড়ায় "শাঁখের করাত" বা উভয় সঙ্কট। বিএনপিকে এ অবস্থার মধ্যে দিয়েই নির্বাচনে আসবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং বর্জন দুটোই বিএনপির জন্য রিস্কি। অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারকে বৈধতা দিল। বিএনপির সিদ্ধান্তের ফলে দেশে শান্তি বজায় থাকা এবং সামাজিক- অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথটা মসৃণ হবে। তবে, এতে সাংগঠনিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দলটি। ইতিমধ্যে, দলটির তৃণমূল কর্মীরা ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে এত কর্মীকে হত্যা, জেল, মামলা, আত্মগোপনের মুখে ঠেলে দেবার যৌক্তিকতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।

খালেদা জিয়ার অনুস্পস্থিতিতে সরকার সাত দফার কোন দাবি না মানা সত্ত্বেও নির্বাচনে যেয়ে দলের নেতারা আপোষের পথে হাঁটছেন কিনা এ প্রশ্নও অনেকে তুলছেন। তবে, নির্বাচন বর্জন করলেও দলের বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা ধরে রাখা যেত কিনা সেটাও বিএনপি নেতৃত্বকে বিবেচনায় নিতে হয়েছে।

কর্নেল তাহেরের অভ্যুত্থানের ফসল হিসাবে সামরিক শাসক জিয়া ক্ষমতা দখল করে দম্ভোক্তি করে বলেছিলেন "I will make politics difficult for the politicians," অর্থাৎ, আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলব।

ইতিহাসের নির্মম ট্রাজেডি হল প্রতিষ্ঠা হবার তার ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন সময় বর্তমানে পার করছে বিএনপি। এর সূচনাটা হয়েছিল ২০০৭ সালে ১/১১ এর সময় থেকে,বিএনপি সরকারের নিয়োগকৃত মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন-ইয়াজউদ্দিনের ছদ্মবেশি সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে। সেসময় থেকে দিন যত গড়িয়েছে, বিএনপির রাজনীতি ততই গভীর থেকে গভীরতম সঙ্কটে নিপতিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ সঙ্কট উত্তরণের কোনও পথ বিএনপির নেতাকর্মীরা তো দেখছেই না; বরং, আগামী দিনগুলিতে দলটি আরো গভীর সঙ্কটে নিপতিত  হতে যাচ্ছে বলেই তাঁরাসহ পর্যবেক্ষদের ধারণা।

বিএনপির চেয়াপারসন বেগম খালেদা জিয়া হাইকোর্টের রায়ে দুর্নীতির মামলায় দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড ভোগ করছেন। আইনগতপন্থায় তার বেরিয়ে আসবার সমস্ত পথ রুদ্ধ। তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে। ১/১১ এর সরকারের কাছে ভবিষ্যতে  রাজনীতি না করবার মুচলেকা দিয়ে তিনি দেশত্যাগ করেছিলেন। পরবর্তীতে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তিনি দেশে ফিরে আসাটা নিরাপদ মনে করেননি।

বর্তমানে ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ নানাবিধ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমানের ফিরে আসবার পথ রুদ্ধ। তাঁর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা মোকাবেলা করবার চেয়ে তিনি বিদেশে নিরাপদ দূরত্বে থাকাকেই শ্রেয় মনে করছেন।

দলের অনেক সিনিয়র নেতা গত হয়েছেন, কেউ কেউ পলাতক এবং নিরুদ্দেশ। দল ছেড়েছেন কেউ কেউ। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকে জেলে,অনেকের নামে রয়েছে মামলা,হুলিয়া মাথায় নিয়ে কেউ কেউ ফেরারি জীবন যাপন করছেন। জামায়াত এবং তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতৃত্বে দুই দুইবার অমানবিক পেট্রল বোমা নির্ভর ব্যর্থ সন্ত্রাসবাদী 'আন্দোলন' দাঁড় করাতে যেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত এবং আহত হয়েছেন অনেকে। এ পেট্রল বোমা সন্ত্রাসের করুণ বলি হয়েছে নারী শিশুসহ বহু সাধারণ মানুষ। তাদের পুড়ে যাওয়া শরীরের যন্ত্রণার আর্তনাদে সেসময় ভারী উঠেছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল।

সরকার বা সরকারী দল নয় বিএনপি তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ঠিক করেছিল সাধারণ জনগণকে। জামায়াতের সাথে হাত মিলিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ জনগণকে লক্ষ্যবস্তু করে এরকম সন্ত্রাসবাদে যুক্ত হবার প্রক্রিয়ায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষ যাদের মাঝে অনেক বিএনপি সমর্থকও ছিলেন। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবার ব্যর্থতাই বিএনপিকে জামায়াতের সাথে হাত মিলিয়ে সন্ত্রাসবাদিতার দিকে নিয়ে গেছে কিনা এ প্রশ্নটা এখনো রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে।

বিএনপি বা জাতীয় পার্টির মত ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে রাষ্ট্র কাঠামো ব্যবহার করে গঠিত দলগুলোতে একটা বড় সংখ্যক নেতাকর্মী যোগ দেন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক নানা সুবিধা পাবার আশায়। ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে বিভিন্ন দলছুট এবং সাবেক আমলা নির্ভর বিএনপির প্রতি জনগণের বড় একটা অংশের সমর্থন থাকলেও এ দলটি কখনো এককভাবে নেতৃত্ব দিয়ে তাদেরকে আন্দোলনের মাঠে নামাতে পারেনি, এমনকি দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকবার অভিজ্ঞতার পরেও।

তবে, একথাও অনস্বীকার্য যে ক্ষমাতাসীন আওয়ামী লীগেও নানা সময়ে বহু সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী 'মৌ লোভীদের' ভীড় দেখা যায়। বিএনপির মত আওয়ামী লীগেও আমরা সাবেক সামরিক বেসামরিক আমলাদেরকে নেতৃত্ব পর্যায়ে দেখেছি। কিন্তু, বিএনপির সাথে আওয়ামী লীগের মোটা দাগের যে পার্থক্য তাহল আওয়ামী লীগ যখনই বিরোধীদলে গিয়েছে তখনই তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছে। তারা অন্যদলের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেরাই আন্দোলন গড়েছে, সে আন্দোলনে বিএনপিসহ (এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়) অন্যরা এসে যোগ দিয়েছে।

বিরোধী দলে থাকবার সময় এবং কঠিন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত তার কর্মীবাহিনীকে মোবিলাইজ করতে পেরেছে। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে যখন আওয়ামী লীগ তার সমস্ত প্রথম শ্রেনীর নেতৃত্ব হারিয়ে আব্দুল মালেক উকিল এবং আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছিল তখনো এর ব্যত্য়য় দেখা যায়নি।

সামরিক শাসক জিয়ার প্রবল দমন পীড়নে দলটির বিধ্বস্ত অবস্থা হলেও বঙ্গবন্ধু পরিবার থেকে আসা নেতৃত্বের অনুপস্থিত কাল পর্বেও কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের জেল, জুলুম, হুলিয়া, হামলা, মামলা মাথায় নিয়েই রাজপথ, জনপদে সরব থাকতে দেখা গেছে।

আওয়ামী লীগকে তার ইতিহাসে কখনই গত কয়েক বছর যাবৎ বিএনপির সাংগঠনিকভাবে যেরকম ম্রিয়মান অবস্থা, তেমন অবস্থায় দেখা যায়নি। এ সাংগঠনিক ক্ষমতার ফলেই তারা  ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফরম থেকে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করে বিএনপি সরকারকেও ফেলে দিতে পেরেছে। এর মূল কারণটা হল আন্দোলন সংগ্রামের মুহূর্তে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের রাজপথে থাকা, পুলিশ বা সরকারী দলের সমর্থকদের মোকাবেলা করা। ২১শে অগাস্ট গ্রেনেড হামলার সময়ও দেখা গেছে নেতৃবৃন্দকে নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে নেত্রীর জীবন রক্ষার প্রচেষ্টা নিতে। এর বিপরীতে অনেকের হয়ত মনে আছে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় একবার খালেদা জিয়াকে রাজপথে রেখে নেতাকর্মীরা পালিয়ে গিয়েছিল।

গত দশ বছরে দেখা গেছে আন্দোলনের ডাক দিয়ে বিএনপির নেতারা ঘরে বসে আছেন। বিরোধী দলে দীর্ঘসময় থাকবার পরেও বিএনপির নেতারা আয়েসী জীবনের অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। এ সমস্ত নেতারা অনেকটাই যেন 'কাচের প্রাসাদে বসে আন্দোলন করতে চেয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে তাদের কর্মীদের উপরে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে যতটা সক্রিয়, ঠিক ততটাই নিস্ক্রিয় থেকেছেন মাঠের লড়াইয়ে।

আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম পাঁচ-ছয় বছর জামায়াত আইনি-বেআইনি নানা উপায়ে রাজনীতির মাঠে অত্যন্ত সক্রিয় ছিল যেটা তাদেরকে পূর্বে কখনোই দেখা যায় নাই। এরশাদ বা খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে তাদেরকে দেখা গেছে গা বাঁচিয়ে আন্দোলনের মাঠে নামতে। তাই এরশাদ বা খালেদা জিয়া সরকার বিরোধী আন্দোলনে তাদের কাউকে নিহত হতে দেখা যায় না। এর পাশাপাশি তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করত যাতে গ্রেপ্তার এড়ানো যায়। কিন্তু, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যখন জামায়াতের অনেক কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি দাড় করায় তখন জামায়াত এবং তার ছাত্র সংগঠন শিবির কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত সবাইকে মোবিলাইজ করে তা প্রতিহত করবার চেষ্টা করে। জামায়াত বিএনপিসহ অন্যান্য সমমনা দলগুলোকে এ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করে এবং বিএনপি অনেকটাই জামায়াতের সাথে সুর মিলিয়ে এ বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।

এরশাদ এবং খালেদা বিরোধী আন্দোলনে জামায়াতের ভূমিকা দেখে অনেকে প্রথম দিকে ভেবেছিলেন যে জামায়াত বোধহয় কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। কিন্তু, এ প্রতিরোধ গড়ে তুলবার ফলে জামায়াতকে দিতে হয় চরম মূল্য। বর্তমানে রেজিস্ট্রেশন বাতিলের ফলে অনেকটা নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের পর্যায়ে চলে গেছে জামায়াত। এর পাশাপাশি, জামায়েতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের রায় কার্যকর এবং সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে যাবার ফলে আন্দোলনের পথ থেকে দলটি নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আর এতে বিএনপির দুর্বলতা জনগণের চোখে প্রকট ভাবে ধরা পড়ে।

দলটির ডাকা হরতালের মত কর্মসূচিতে দলের কোনও কর্মীকে মাঠে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠে। জনগণের চোখে ধরা পড়ে জামায়াতকে মাঠে বা সেভাবে পাশে না পেয়ে যেকোনও অরাজনৈতিক আন্দোলন- যেমন বিসিএস এ কোটা বিরোধী বা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদ সড়কের দাবী- হলেও তাকেই যেন আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে বিএনপি। এর আগেও ২০১৩ সালে অনেকের কাছে মনে হয়েছে হেফাজতের কাঁধে ভর দিয়ে যেন বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে দলটি।

বিডিআর বিদ্রোহের সময়ও দলের নেতাকর্মীদের মাঝে একটা চাপা উল্লাস পরিলক্ষিত হয়েছে। এ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠে যে কর্নেল তাহেরের অভ্যুত্থানের ফসল হিসাবে ক্ষমতায় আসা বিএনপি অন্যের উপর নির্ভরশীলতার মনস্তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। দীর্ঘ রাজনীতি করবার অভিজ্ঞতা থেকে তারা একটা বিষয় এখনো শিখে উঠতে পারেনি যে কেউ তার সফলতার ফসল অন্যের গোলায় দিয়ে আসবে না।

দলের এ দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থায় দীর্ঘ রাজনৈতিক অধ্যায়ের অনেকটাই যেন শেষ প্রান্তে এসে দলের চেয়ারপারসন স্বয়ং খালেদা জিয়াকেই তার জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম পরিস্থিতির  মুখোমুখি হতে হয়। জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের দুই কোটি টাকা দুর্নীতির মামলার রায় ঘনিয়ে আসে। রায়ের কিছুদিন আগে হঠাৎ করে তিনি তার বড় ছেলে তারেক রহমানকে দেখে আসবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যখন লন্ডনে অবস্থান করছিলেন তখন দেশে একটা গুঞ্জন উঠে যে তিনি হয়ত আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু,সকল জল্পনার অবসান ঘটিয়ে তিনি দেশে ফিরে আদালতের রায় শোনবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার ছেলের মতো বিদেশে পালিয়ে থাকবার সিদ্ধান্ত নেননি। এ সিদ্ধান্তটি ১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীনে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করবার ফলে তার দল তাঁকে যে আপসহীন খেতাব দিয়েছিল তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

কী ভেবে খালেদা জিয়া দেশে ফিরেছিলেন? তিনি কি ভেবেছিলেন তিনি জেলে গেলে দেশজুড়ে এর একটা বিশাল প্রতিক্রিয়া হবে? জনগণ তার মুক্তির দাবীতে রাস্তায় নেমে আসবে, নেত্রী হিসাবে তার মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পাবে? তিনি যদি এ হিসাব করে থাকেন তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে হয় বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা না বুঝে তিনি কল্পজগতে বাস করছিলেন। এমনকি তার দল সম্পর্কেও তিনি কোনও সঠিক ধারণা রাখতেন না।

যে বিএনপি কারণে অকারণে বহু হরতাল ডেকেছে, সেই তারাই তাদের দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতে কোনও হরতাল ডাকেনি। খালেদার মুক্তির দাবিতে বিএনপি যে কর্মসূচীগূলি পালন করেছে তা অনেকটাই দায়সারা, লোক দেখানো গোছের বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের সাথে কথা বলে এর যে উত্তর পাওয়া গেছে তাহলো পুলিশ তাদের কর্মসূচি পালন করতে না দেয়াতে তারা তা করতে পারেনি। এর উত্তরে যখন বলা হল, অতীতে তারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনওতো পুলিশ সরকারের বিরুদ্ধে কর্মসূচী পালন করতে দেয়নি, আওয়ামী লীগতো তারপরেও তাদের কর্মসূচী পালন করেছে- আপনারা পারছেন না কেন, এর কোন সদুত্তর তারা কেউ দিতে পারেননি।

বাস্তবতা হল বিএনপির প্রতি জনগণের একটা বড় অংশের শর্তহীন সমর্থন রয়েছে হাওয়া ভবনের কেলেঙ্কারী, পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস ইত্যাদির সাথে যুক্ত থাকবার পরেও। এ জনগোষ্ঠীর মূল অংশটা হল তারা, যারা মুসলিম লীগের উত্তরাধিকারকে ধারণ করে মনে করেন বাঙ্গালি জাতি এবং জাতীয়তাবাদের পরিচয়ের সাথে কোনও না কোনওভাবে মুসলিম আত্মপরিচয় যুক্ত থাকতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম এ ধারার রাজনীতি করেছিল ন্যাপ (ভাসানী) এবং তারপর থেকে বিএনপি। কিন্তু, এতবড় সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপির সুবিধাবাদী এবং বিলাসী নেতৃত্বের ফলে এ জনগোষ্ঠীকে তারা কোনও আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারেনি।

বিএনপির মত দলের মূল সমস্যা হল দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকবার ফলে দলে নেতা না জন্মে অনুসারী তৈরি হয়। ফলে, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে অনেকটা যেন সে শূন্যতা পূরণের লক্ষ্য নিয়েই যেন ড. কামাল হোসেনকে প্রধান মেনে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে। বিএনপি গঠিত হবার পর এই প্রথম দলের বাইরে কাউকে প্রধান মেনে জোট গঠন করল। অবশ্য আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নির্বাচনের সময় আমরা আওয়ামী লীগকেও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহর নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিতে দেখেছি, যে নির্বাচনী কোয়ালিশনে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীও ছিলেন।

বিএনপি যে সমস্ত নেতৃবৃন্দের সাথে ঐক্যফ্রন্ট করেছে তাদের সবাই একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং কেউ কেউ কঠিনভাবে বিএনপি বিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন। উদাহারণস্বরূপ বলা যায় বাংলাদেশে সেক্যুলার 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' প্রবক্তা, রাজনীতির রহস্য পুরুষ হিসাবে পরিচিত সিরাজুল আলম খানের অনুসারী আ স ম আব্দুর রবের কথা। জিয়া সরকারের সময় কর্নেল তাহেরের সামরিক আইনে গোপন বিচার প্রক্রিয়ায় রবের দশ বছর জেল হয়েছিল। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন।

কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ভারতের সহায়তায় সীমান্ত জেলাগুলোতে জিয়া সরকারে বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। মান্না বাসদ ছাত্রলীগের নেতা হিসাবে জিয়া সরকার বিরোধী আন্দোলনে ছিলেন এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১/১১ এর সময় তিনি এবং সুলতান মোহাম্মদ মনসুর 'সংস্কারবাদী' পথ অবলম্বন করায় দল থেকে বাদ পড়েন। তবে, সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বিএনপি নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েই খালেদা জিয়ার সমালোচনাকারী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীসহ ১/১১ এর 'সংস্কারবাদী' হিসাবে বহিষ্কৃত হওয়া সবাইকে দলে ফিরিয়ে এনেছে।

খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপি নেতৃত্ব একটা বিষয় উপলব্ধি করতে পেরেছে  দলের বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা এবং আয়েশী নেতৃত্ব দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আন্দোলন করে আদায় করে নেয়া সম্ভব নয়। উল্লেখ্য যে, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তারা করে আসছিলেন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে যে দু'বার তারা ক্ষমতায় ছিলেন তার কোনবারই তারা সেধরনের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি, যার জন্য দু'বারই তাদেরকে চরম মাশুল দিতে হয়েছে।

প্রথমবার আন্দোলনের মাধ্যমে তারা  ক্ষমতাচ্যুত হলেও, দ্বিতীয়বার ১/১১ এর সময় তারা যে মাশুল দিয়েছে তা তাদেরকে ক্রমশই কঠিন থেকে কঠিনতর অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় নির্বাচনকেন্দ্রিক দল হিসাবে আরেকটি নির্বাচনের বাইরে থাকলে দল হিসাবে এর ভবিষ্যত কী হতে পারে এটিইও নির্বাচনে যাবার হিসাবের মধ্যে ছিল।

এসবের বাইরে আন্তর্জাতিক বিষয়কেও দলটিকে হিসাবে নিতে হয়েছে। বিএনপি নেতৃত্ব এ বিষয়টি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আসবার পর অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবার ট্র্যাডিশন থেকে সরে আসবার চেষ্টার ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগের মতো আর বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবে না। এর সবকিছুর ফলেই নির্বাচনে না যেয়ে বিএনপির সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না।

দশ বছর পর বিএনপি যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে সেখানে তারা কোনও উন্নয়নের বার্তা নিয়ে নয় বরং খালেদা জিয়ার মুক্তির স্লোগান নিয়ে নামবেন। এ স্লোগানটি নিয়ে তারা ব্যাপকভাবে ভোটের প্রচারে নামতে পারলে, বিএনপির পিছনে যে বিরাট নীরব সমর্থন রয়েছে, যাদেরকে আন্দোলনের মাঠে পাওয়া না গেলেও ভোটকেন্দ্রে পাওয়া যাবে, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হয়েছে এমন ধারণা দল নির্বিশেষে অধিকাংশ জনগণের মাঝে তৈরি না হলেও।

তবে নির্বাচনে আশানুরূপ ফল না হলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বর্তমান সরকারের সাথে আপসকামিতার অভিযোগ মোকাবেলা করতে হবে। সরকার প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ভোটের হিসাবে পরিবর্তন করেছে শুধু এটা বলে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যাবে না।

ভোটের পর আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে সেটি হল তূলনামূলকভাবে সেক্যুলার ধারার দলগুলির সাথে বিএনপির এ ঐক্য শুধুমাত্র ভোটের রাজনীতির জন্য কৌশলগত না আদর্শিক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' নীতি থেকে সরে আসা, সৌদি যুবরাজ সালমানের সংস্কার নীতি এবং পুনরুত্থিত রাশিয়ার 'ইসলামপন্থী' জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ইসলামপন্থার মূলধারার রাজনীতিকেই বিশ্বব্যাপী কোণঠাসা অবস্থানে নিয়ে গেছে। বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব এ অবস্থা বুঝতে পেরেই কি 'ইসলামপন্থী' দলগুলোর সাথে নিজেদের দূরত্ব বাড়িয়ে সেক্যুলার দলগুলির সাথে ভিড়ে নিজেদের ইমেজ পরিবর্তন করতে চাচ্ছে কিনা- ভোটের পরে ক্রমশ এ বিষয়টাও পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

ফল ভালো না হলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের আপসকামিতার অভিযোগের যথাযথ জবাব এবং দলের ইমেজ পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রশ্নে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সময়োপযোগী উত্তর সামনের দিনগুলিতে বিএনপির রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দিবে।