ভোটার ঐক্যফ্রন্ট!

হাসান ইমাম
Published : 14 Nov 2018, 01:06 PM
Updated : 14 Nov 2018, 01:06 PM

ভোট বড় বিষম বস্তু। ভোটের আগে জোট, ভোটের আগে ভাঙন— রাজনৈতিক সমীকরণের সাধারণ যোগ-বিয়োগ। অঙ্ক কষে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন জোটবদ্ধ হয়, তেমনি পুরনো মিত্রকেও ঘাড় ধাক্কা দিতে কসুর করে না এতটুকু। রাজনীতি যখন আদর্শ থেকে দূরে, নীতি যখন কিছু বাক্যসমষ্টি মাত্র, তখন ভোট শুধুই 'হিসাব'। তাই এই হিসাবে যে দল বা জোট যত বেশি পোক্ত, কুরসি তত বেশি তাদের হাতের নাগালে। তাই রাজনৈতিক শক্তির কাছে ভোট তথা নির্বাচন ক্ষমতার চাবিকাঠি বৈ আর কিছু নয়!

কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে ভাতের বন্দোবস্তেরই অন্য নাম ভোট। যে দল বা জোটকে ভোট দিয়ে মসনদে যাওয়ার দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে, তারা কতটা মানবিক শাসন জারি রাখবে, তার ওপর নির্ভর করবে সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ। তারা দুবেলা দুমুঠো খেতে পাবে নাকি অনাহারী থাকবে, তা ভোটের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। তাই জনগণের দানাপানির নির্ণায়ক ভোট; ভোট রাজনীতিকের জন্য ক্ষমতার সম্প্রসারণ-সংকোচন হলেও আমজনতার অস্তিত্বের পাটাতন।

কিন্তু ভোটের আগে নিজেদের আখের গোছাতে রাজনৈতিক শক্তি যতটা গলদঘর্ম হয়, আমজনতা কি তাদের স্বার্থ হাসিলে ততটা বিচলতি? ভোটার সংখ্যা, নারী-পুরুষ ভোটারের অনুপাত, তরুণ সমাজের অবস্থান, নতুন ভোটারের অন্তর্ভুক্তি, কর্মজীবী কত শতাংশ, গ্রামনির্ভর মানুষের সংখ্যা, সংখ্যালঘু ভোট— ইত্যাদি নানা পরিসংখ্যানে যখন ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলো, তখন ভোটাররা রাজনৈতিক দলগুলোর চেহারা-চরিত্র, অতীত-ইতিহাস, প্রতিশ্রুতি আর প্রতিশ্রুতিভঙ্গের খতিয়ানে কতটা চোখ বুলিয়ে দেখে?

অন্য অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আমলযোগ্য ফারাক হলো— এখানে প্রতীকনির্ভর রাজনীতি বরাবরই দাঁও মারে। প্রার্থীর ব্যক্তিচরিত্র, অতীত কর্মকাণ্ড, বর্তমান অবস্থান ইত্যাদি যা-ই হোক, যেমন-তেমনই হোক, অমুক-তমুক প্রতীকে নির্বাচন করা মানেই একধরনের জয়-পরাজয়ের নিশ্চয়তা।

মোটাদাগে, বাংলাদেশের সমাজে প্রতীক দেখে ভোট দেওয়ার সংস্কৃতি বেশ জাঁকালো। প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা, মতাদর্শগত অবস্থান বা অতীত কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখা হয় না। যোগ্য বা ভালো প্রার্থীর প্রধান মানদণ্ডই তিনি কোন দল বা জোটের লোক! এই যখন অবস্থা তখন নেতৃত্বগুণ, জনপ্রিয়তা, নীতি-আদর্শ, জনসংযোগ বা মানুষের জন্য লড়াই করার, ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা আড়ালে পড়ে যায়। এতে প্রতীকনির্ভর রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত হলেও পরাজয় ঘটে গণমানুষের; তাদের ভাতের থালা শূন্য থেকে যায়, মর্যাদাপূর্ণ জীবন থাকে অধরা। তাই ভোটের আগে ভোটারদেরও জোটবদ্ধ হওয়ার মোক্ষম সময়।

২.

আগামী পাঁচ বছরের দেশের-জনগণের সম্ভাব্য চালচিত্র নির্ধারণ করার একটি দিন— ভোটের দিন। কিতাবে যা-ই লেখা থাকুক বা না থাকুক, এই একটা দিন ভোটারদেরই পোয়াবারো। দেশের মালিকানা, সাংবিধানিক অধিকার ইত্যাদি ওজনদার কথায় না গিয়েও এটুকু অন্তত বলাই যায়, সাধারণ মানুষের একটি ভোট হতে পারে তাদের 'ভূত' অথবা 'ভবিষ্যৎ'। অর্থাৎ ভূত-ভবিষ্যৎ থেকে শিক্ষা না নিয়ে কেবল দলীয় পরিচয় বা প্রতীক দেখে ভোট দেওয়ার অর্থ হবে 'ভূতের ভবিষ্যৎ' বেছে নেওয়া!

কেননা, সবদিক বিবেচনায় না নিয়ে কেবল দলীয় পরিচয়ের জৌলুস, বিশেষ প্রতীকের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে ভুল প্রার্থী-দল-জোটকে বেছে নেওয়ার খেসারত দিতে হবে ভোটারদেরই। এই খেসারতের মেয়াদকাল সরল অঙ্কে পাঁচ বছর। তবে রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক (কু!) সংস্কৃতি আমলে নিলে এর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ রেশ থাকে অনেক, অনেক দিন। অনেক সময় রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে মিথ্যা করে সাধারণ মানুষকে ভুগতে হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মতক!

তাই প্রতীক নয়, নয় কোনো দলীয় তাবেদারি, ভোট হোক প্রার্থীর যোগ্যতা দেখে; ব্যক্তিকে দেখে। ভালো প্রার্থী, যোগ্য প্রার্থী বলতে যা বোঝায়, সেই বিবেচনায় প্রতীকে পড়ুক সিল।

ভোট হোক জোটের-দলের-প্রার্থীর আমলনামার প্রতিফলন। ভোটের বাক্স হোক ভোটারের ভবিষ্যতের ভ্রূণ। সাধারণ মানুষের সরল অঙ্কের কাছে পরাজিত হোক রাজনীতির প্যাঁচালো পরিসংখ্যান।