যাত্রীর চাইতে মাল্লামাঝি বেশি, সাবধান কর্ণধার

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 13 Nov 2018, 01:19 PM
Updated : 13 Nov 2018, 01:19 PM
দেশে সবদলের অংশগ্রহণে একটি সাধারণ নির্বাচন হবে সেটাই জনগণের চাওয়া। দীর্ঘসময় ধরে রাজনীতি একমুখি। বাস্তবে বিরোধী দল বলে কিছু না থাকায় জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা হয়ে আছে প্রশ্নময়। কী কারণে বা কাদের জন্য তা হয়েছে সে তর্কে না গিয়েও বলা যায় এর অবসান জরুরী। গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশের হিত কামনায় মানুষ চায় সবাই কথা বলুক। যার যা বলার বা করার করতে পারুক। শেখ হাসিনার একক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ আজ এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে আয় উন্নতি বাড়ার পাশাপাশি মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা খুব প্রয়োজন। উত্তপ্ত রাজনীতি তা কখনোই হতে দেয়না। যেসব দেশে রাজনীতি মানে মারামারি হানাহানি সেখানে সামাজিক উন্নতি সুদূর পরাহত। তাই তাঁর অর্জিত উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্যই একটি গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন জরুরী।
বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট এবার নির্বাচনে আসছে এটাই বড় খবর। যে ভুল বিএনপি করেছিল নির্বাচনে যাবার পরিবর্তে সহিংসতা, পেট্রোল বোমাসহ নানা নাশকতায় তাদের যে কীর্তি- তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দলটির তৃণমূল পর্যায়ের কোনও সমর্থনই কাজে আসবেনা। এটা তারা বুঝেছে কি না জানিনা, তবে ট্রাজেডি হলো তাদের নির্বাচনমুখী করার কাজটি করেছে মূলত আওয়ামী পরিত্যক্ত কিংবা আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে যাওয়া মানুষরা।
ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট হবার পর তরতর করে সংলাপ হয়ে গেলো । এক দফা নয় দুই দফার  এই সংলাপে যারা গণভবনে শিরোনাম হলেন তাদের ভেতর নিবেদিত বা কড়া বিএনপির কয় জন নেতা ছিলেন? রব, মান্না, জাফরুল্লাহ চৌধুরী বা ড. কামাল হোসেন কে বাদ দিলে সবেধন নীলমনি ছিলেন মির্জা ফখরুল। এই ভদ্রলোকের শারীরিক ভাষা ও কথাবার্তা মার্জিত। অনেকে বলেন, তিনি নাকি মিথ্যা বই সত্য বলতে জানেননা। সেটা যদি মানি ও তার দল আর ঐক্যফ্রন্টের বাস্তবতাই এর জন্য মূল দায়ী।। সে যাই হোক সরকার এই নবগঠিত ফ্রন্টের আরো এক দাবীর সাথে সহমত পোষণ করে নির্বাচনের তারিখ এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ধার্য করেছেন। সব ঠিক থাকলে সেদিন বাংলাদেশে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এই নির্বাচনকে ঘিরে মানুষজনের শঙ্কা বা উদ্বেগ আছে। তারা ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাবেন- এটাই স্বাভাবিক। গত নির্বাচন যেমন বিরোধী দলের বয়কটে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল, তেমনি বাংলাদেশের যেকোনও নির্বাচনই কোনও না কোনওভাবে সহিংসতা আর কারচুপির অভিযোগে দুষ্ট। সে জায়গায় নির্বাচন কেমন হবে তা নিয়ে সংশয় থাকাটাই যৌক্তিক। বলছি নির্বাচনে মানুষের চেবে প্রার্থীদের আগ্রহের কথা। নমিনেশন ফরম সংগ্রহের হিড়িকে বলাবাহুল্য সরকারী দল আওয়ামী লীগই এগিয়ে। দুই টার্মের টানা সরকার আর শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার ঈর্ষণীয় সাফল্যে প্রার্থীদের ধারণা তারা নৌকায় চড়লেই বৈতরণী পার হতে পারবেন।
হেভি ওয়েট, লাইট ওয়েট, নো ওয়েট বা নবীন-প্রবীণ সবাই লাইন দিয়ে তিরিশ হাজার টাকায় ফরম কিনছেন। এটা কী বা কেন তা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়েনা। কিছুদিন আগে আমাদের রসিক রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের ভাষণে তার স্বভাবসুলভ রসিকতার পাশাপাশি কিছু মূল্যবান কথা বলেছিলেন।
তার কথাগুলো এখন সত্যি বলে প্রমাণিত হতে চলেছে। তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন চাইলেই যেমন কেউ গায়ক-নায়ক-বিজ্ঞানী বা খেলোয়াড় হতে পারেনা তেমনি ইচ্ছে হলেই নেতা হবেন এটা কেমন ধারা? রসিকতা করে বলেছিলেন বুয়েট বা সেনাবাহিনীতে যেমন তাকে নেয়া হবেনা, তেমনি রাজনীতিতেও কী সবাই কে নেয়া জায়েজ? তার অভিমত ছিলো মাঠ পর্যায়ে রাজনীতি করে আসা মানুষরাই দলের হাল ধরুক। যারা রাজনীতিকে ধ্যান জ্ঞান বলে মেনে নিয়ে ত্যাগ স্বীকার সহ তৃণমূলে কাজ করেন তাদের মূল্যায়ন করার এই চাওয়া কতটা জরুরী আজ তা চোখে দেখছি আমরা।
আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে এত মানুষ, এত নামী, দামী এবং অনামী মানুষ কি ফর্ম কিনতেন আদৌ? একথা বলিনা নবীনরা আসবেনা। বরং তারা আসলেই দেশের প্রগতি উন্নতি আরও ত্বরান্বিত হবে। নবীন রক্তের প্রয়োজন বড় বেশি। কিন্তু কোন নবীন? যারা সুযোগ সন্ধানী? যারা টু পাইস কামানো আর আখের গোছানোর জন্য আসবেন তারা? দেশের কথাতো আছেই, বিদেশেও দেখি আইন নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে যার ইচ্ছা পোস্টার তৈরি করছেন। জানান দিচ্ছেন তারা নাকি প্রার্থী হতে চান। যারা নমিনেশন ফরম কিনছেন তাদেরটা না হয় বুঝলাম। কিনেন নি কিন্তু খায়েশ আছে তারাও পোস্টার তৈরি করে বাজারে ছাড়ছেন। মাথার ওপর বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি ঝোলালেই সব সম্ভব? না, দল বা ত্যাগী নেতারা তা মানবেন? এই প্রবণতা মারাত্মক। এতে নতুন করে বিভ্রান্তি আর জটিলতা বাড়বে।
মাশরাফিদের মতো সেলিব্রেটিদের কথা আলাদা। তারা স্ব স্ব জায়গায় উজ্জ্বল। দেশ জাতিকে অহংকারী করতে পারা তারকারা আসা আর হিরো আলমের মতো লোকেরা নমিনেশন ফরম কেনা এক বিষয় না।
জানি বিএনপিতেও তাই হবে। কারণ সবাই মনে করেন তাদের তৃণমূলের ভোটব্যাংক ব্যাপক। ধানের শীষ না হলে যে জেতা যাবেনা, সেটা বহুকালের পোড় খাওয়া আসম রব, মান্না, কাদের সিদ্দিকী বুঝলে- এরা না বোঝার কী আছে? কিন্তু তাদের প্লাস পয়েন্ট তারা ভুল করলেও সাবধানী থাকবেন। যেকোনও মূল্যে জিতে আসার লড়াইয়ে তারা ভুল করতে চাইবেন বলে মনে হয়না। আর বিএনপি জিতবে কি জিতবেনা তার হিসেব নিকেশ মূলত গায়েবী হিসেব।
এখনো এমন কোনও প্রমাণ নাই যে তাদের প্রতি মানুষ চরম দুর্বল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যদি আসতে না পারে, বিশেষত শেখ হাসিনা যদি না থাকেন তবে প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীর মুসলমান , সংখ্যালঘুসহ নানা সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন সংশয়ও অস্বাভাবিক না। দেশে কতটা সহিংসতা বা প্রতিশোধের রাজনীতি হতে পারে তার আভাস আমরা ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের গলাতেই শুনেছি। তারা নির্বচন কমিশনের অফিসে গিয়ে বলে এসেছেন, ২০১৯ সালে দেশ থাকতে হবে এমন বিবেচনায় যেন কাজ করেন। যেকোনও সভ্যদেশে এটা হুমকি বা থ্রেট হলেও আমরা সহ্য করতে করতে এগুলোকে গা সওয়া বলে ধরে নিয়েছি।
এমন কঠিন বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের নমিনেশন ফরম কেনার হিড়িক কী হুজুগ না আন্তরিকতা? মাঠে থাকেন না, এলাকায় যান না, এমন মানুষ কী ভালো, সহজ, স্বাভাবিক নির্বাচনে জিতে আসতে পারেন? অবাক হচ্ছি, দেশের বাইরের মানুষদের আচরণে। তারাই বলে দিচ্ছেন, কত শতাংশ মানুষ এই সরকার চায় আর কত শতাংশ চায় না। দেশের জনগণ কী ঘাস কাটেন? না তারা এতই বোকা যে এসব বোঝেন না? আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দুশমন তার অন্তর্কোন্দল। বড় দলে এটা স্বাভাবিক হলেও এই দলে বেশি। যারা ফরম কিনে ব্যর্থ হবেন বা আশাহত হবেন, তারা যে দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে গোপনে কাজ করবেন না এর গ্যারান্টি আছে?  তাছাড়া তাদের নমিনেশান দিলে দীর্ঘকাল মাঠ জুড়ে থাকা কর্মী বা নেতারা কী ছেড়ে কথা বলবেন? অথচ বিজয় নিশ্চিত করতে হলে এসব আস্ফালন আর ছেলেমানুষি বন্ধ করতে হবে।
পরিবেশ কতটা ভয়ানক হলে নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নির্বাচন করে জয়ী  হওয়া পীরগঞ্জের নূর মন্ডল আওয়ামী লীগের নমিনেশন ফরম নিতে পারেন। চট্টগ্রামের খ্যাতিমান প্রয়াত আওয়ামী নেতা এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরীকে হারিয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হ ওয়া মঞ্জুর আলমও কিনেছেন নৌকার ফরম। এর মানে কি? ত্যাগী নেতা কর্মীরা আঙুল চুষবেন? না তারা এদের জন্য কাজ করবেন? মূলত এসব উটকো ঝামেলা শেখ হাসিনাকেই সামলাতে হবে। তা  না হলে নৌকার তীরে ভেড়া কঠিন হবে পড়বে। আরোহীর চাইতে বেশি মাল্লামাঝি আর যাই হোক সুখকর ঈঙ্গিত বহন করেনা।  ঐক্যফ্রন্ট বা আওয়ামী লীগ সবার দায়িত্ব সুসময়ের কোকিলদের চিহ্ণিত করা। নির্বাচনে সৎ,যোগ্য বা ভালো প্রার্থী যেমন দরকার তেমনি দরকার কোকিলের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।তবেই না আমাদের ভোটাভুটি কাজে আসবে। নির্বাচন হবে প্রাণবন্ত।
বসন্তের কোকিলের ভিড়ে বা হুজুগে নেতাদের ভিড়ে যেন পথ না হারায় রাজনীতি। তাহলে আবারো দুর্ভোগ আর অভিযোগের অন্ত থাকবেনা। একেকটি আসনের জন্য এত প্রার্থীর আবদার আর যাই হোক ভালো ঠেকছেনা। জয়-পরাজয়ের মালিক জনগণ হলেও সাবধানতার বিকল্প নাই।