পুলিশ বাহিনীর নারী-নিপীড়ন

সায়দিয়া গুলরুখ
Published : 15 June 2012, 02:23 PM
Updated : 15 June 2012, 02:23 PM

গত ২৯শে মে দুপুরবেলা ঢাকার আদালত চত্বরে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর কয়েকজন সদস্য একজন নারীকে যৌন নিপীড়নের চেষ্টা করেন। একই দিনে বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলাতে আরেকজন নারীকে পুলিশ যৌন নিপীড়ন করেন।

শ্লীলতাহানির মানে কি? বঙ্গীয় শব্দকোষ বা চলন্তিকা বাংলা অভিধানে 'শ্লীলতাহানি' শব্দটি নেই, আছে শ্লীল। বঙ্গীয় শব্দকোষে শ্লীল মানে শোভান্বিত, শোভন, অজুগুপ্সিত, অনিন্দিত; আর চলন্তিকায় শ্লীল মানে শিষ্ট বা ভদ্র।

বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই বা কী? তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট মতে, "দেশের সব নাগরিককে সেবা প্রদান এবং বাংলাদেশে বসবাস ও কাজ করার আরও নিরাপদ পরিবেশ হিসেবে গড়ে তোলা।"

২৯শে মে আদালত চত্বরে আসলে কী ঘটেছিল? বাবা-মার সাথে স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলা করার জন্য আদালতে এসেছিলেন ঘটনার শিকার নারী। বেলা ১২টার দিকে আদালত চত্বর থেকে বেরুবার পথে পুলিশ তাদের পথ রোধ করে মটরসাইকেলের চাবি নিয়ে নেয়। এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে পুলিশ তার বাবাকে মারধর করা শুরু করে। মারধরের এক পর্যায়ে বাবার গলার সোনার চেইন (মূল্য আনুমানিক ৫৫ হাজার টাকা) ছিড়ে নেয়। মারতে মারতে আদালত সংলগ্ন পুলিশ ক্লাবে নিয়ে যায়। সেখানে তিনজনকে আলাদা কক্ষে রাখা হয়। একটি কক্ষে তার বাবার উপর অত্যাচার করা হয়, খামচি দিয়ে চোখ উপড়ে ফেলার ভয় দেখানো হয়। অন্য কক্ষে, আক্রমনের শিকার নারী বলেন, দুজন পুলিশ সদস্য আমাকে জড়িয়ে ধরেন। এদের একজন জামান (পোশাকের নাম ফলক অনুযায়ী) আমার সঙ্গে চরম অশালীন আচরণ করেন। আমার গালে-গলায় চুমু দেন। মোটা কালোমতো এক পুলিশ সদস্য গলা থেকে চেইন খুলে নেন। আমি প্রতিবাদ করলে গালে চড় মারে। এতে আমার কানের দুল চামড়া কেটে ভেতরে ঢুকে যায়। তখন আমি চিৎকার করে মাকে ডাকতে থাকি। চিৎকার শুনে মাও চিৎকার করতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশেরই কয়েকজন কর্মকর্তা এসে আমাদের উদ্ধার করেন (প্রথম আলো, ২৯ মে, ২০১২)।"

ঘটনার এখানেই কিন্তু শেষ হয়নি।
দুপুরে পুলিশের খপ্পর থেকে ছাড়া পেয়ে বাবার মোটর সাইকেলের খোঁজে মা-মেয়ে আদালত চত্বরে ফিরে আসেন তখন তারা সাংবাদিক ও আইনজীবীদের সাহায্য চান, ঘটনার বিচার দাবি করেন। এ সময় সহমর্মী সাংবাদিক এবং আইনজীবীদেরসহ মা -মেয়ের উপর দ্বিতীয় দফা নির্যাতন করা হয়। তাদেরকে আবারও থানায় নিয়ে আসা হয়। রাত দশটায় আইন সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, সুলতানা কামাল নিজে থানায় গিয়ে পুরো পরিবারকে পুলিশি আটক থেকে উদ্ধার করেন।

ঘটনার শেষ এখানেও নয়।

পুলিশি আটক থেকে ছাড়া পাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই তারা এই নির্যাতনের বিচার দাবি করেন। পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে মামলা নিতে রাজি হয় না। বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের আইনানুযায়ী যে কোনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ/অভিযোগের ক্ষেত্রে এজাহার (ফাস্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট) দাখিল করার অধিকার আছে। তাই নয় কি?

অনেক চেষ্টার পর যৌন নিপীড়নের শিকার নারীর মা বুধবার (৩০ মে, ২০১২) রাত দুটার পর চার পুলিশ এবং পুলিশের এক সোর্সের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন।

তাহলে, পুলিশ কি শ্লীল, শিষ্ট, ভদ্র, অনিন্দনীয় আচরণ করেছে? এ ঘটনায় বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী লঙ্ঘিত হয়নি? এই প্রশ্নটার জবাবে সকল সাংবাদিক, ব্লগার কিন্তু বিনা দ্বিধায় বলবেন, "হ্যা, ২৯শে মে, ২০১২, আদালত চত্বরে পুলিশ অশ্লীল অশিষ্ট, অভদ্র আচরণ করেছে।" সোনার চেইন চুরি করা থেকে শুরু করে জোরপূর্বক চুমু খাওয়া, পরবর্তীতে অপরাধ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা, শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত নারীর মামলা করার অধিকার খর্ব করার চেষ্টা – এই সবগুলো অপরাধে দোষী হল পুলিশ। তা সত্বেও, প্রকাশিত সংবাদ যৌন নিপীড়নের ঘটনাটিকে কোনও না কোনভাবে নারীর শ্লীলতাহানি' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। চোর যখন চুরি করে তখন যে অপরাধের শিকার তার, নাকি অপরাধকারী চোরের সম্মানহানি হয়?

আমি এটা মানি যে, আমাদের দেশে শ্লীলতাহানির যে অর্থগত ইতিহাস তাতে করে পুলিশ বা পুরুষালী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ ধারণাটি খাটে না। পুরুষের সমান তার চাকরি-বাকরি, জমি-জমার উপর নির্ভর করে।

সামাজিকভাবে আশা করা হয়, নারী তার আচার-আচরণের মাধ্যমে শ্লীলতা বজায় রাখবে, আর পুরুষ নারীর শ্লীলতার রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এই লিঙ্গায়িত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তার সম্মান ক্ষুন্ন হয়, ধুলিস্যাত হয়। অর্থাৎ পুলিশ অশ্লীল, অশালীন, আশোভন, অশিষ্ট আচরণ করলেও তার শ্লীলতাহানি সামাজিকভাবে সম্ভব নয় কিন্তু তার সম্মানহানি সম্ভব।

এই আলোচনার সূত্র ধরে সংবাদটির যদি কল্পিত উপসংহার টানি এইভাবে: "কতিপয় পুলিশের এরূপ অনৈতিক, আগ্রাসী ও আশোভন আচরণের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সম্মানহানি ঘটেছে।"

বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীর সম্মানহানি কি হয়নি? জনগণের কাছে পুলিশবাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি? হয়েছে। ২৯শে মে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীর নারীর প্রতি সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ১৯৫০ সালে ইলা মিত্র নাচোলের পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিত হন। তারপরে ইয়াসমিন বা সীমা। আরও অনেক ঘটনা সংবাদপত্রের মনোযোগের আড়ালে ঘটছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আদালত চত্বরের ঘটনা এর শেষ নয়।

পুলিশবাহিনীর সদস্যদের নারীর প্রতি সহিংসতামূলক দৃষ্টিভঙ্গীর বহিঃপ্রকাশ ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের মতন চুড়ান্ত আক্রমণের ছাড়া্ও সারাক্ষণই ঘটতে থাকে। রাস্তাঘাটে মেয়েদের হয়রানিমূলক মন্তব্য করার ঘটনা বিরল নয়। আমি নিজেই একাধিকবার পুলিশের এ ধরনের মৌখিক হয়রানির শিকার হয়েছি। বাংলাদেশ পুলিশবাহিনী দৈনন্দিন পরিচালনায় পুরুষালী আচরণকে প্রশ্রয় দেয়, উৎসাহিত করে। এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে শ্লীলতাহানির মতন পুরুষতান্ত্রিক ধারণা দিয়ে চ্যালেঞ্জ করা যায় কি?

আমি বিশ্লেষণের তীরটা উল্টো দিকে ঘোরাতে চাই, নিপীড়নের শিকার নারীর শ্লীলতা থেকে সরিয়ে বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীর দিকে তাক করতে চাই, তাহলে যৌন নিপীড়নের মতন অপরাধ নিয়ে বিরাজমান ভাবনা-চিন্তার মজ্জাগত সংকটটি ধরা পড়ে।

লক্ষ্য করুন, আমি কেবল একটি শব্দ প্রতিস্থাপন করে আরেকটি শব্দ ব্যবহারের কথা বলছি না। আমি যৌন নিপীড়নের মতন ঘটনার ক্ষেত্রে সাংবাদিক ব্লগার, নারী সংগঠকদের মধ্যকার বিদ্যমান মতাদর্শিক সংকটের কথা বলছি। বাংলাদেশের আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের তালিকায় আদালত চত্বরে সংঘটিত ঘটনাটি ধর্ষণের চেষ্টা (attempt to rape) হিসেবে চিহ্নিত, তা সত্ত্বেও নারীর শ্লীলতার বিষয়টিই আলোচনার মূলকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই সংবাদ ভাষ্য অনুযায়ী, পুরুষ অপরাধ করেছে, কিন্তু যে অপরাধের শিকার তার শ্লীলতাহানিও ঘটেছে। সংবাদমাধ্যম, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি যৌন নিপীড়কের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিলেও, নারীর উপর শ্লীল-অশ্লীলতার যে মতাদর্শিক শাসন জারি আছে তা রুখে দাঁড়ান না। এই সংকটের উদাহরণ হিসেবে প্রকাশিত সংবাদের কিছু নমুনা তুলে ধরছি।

একটি ব্লগ চ্যানেল আই-য়ে প্রদর্শিত ইউটিউবের ক্লিপটি সম্পাদকীয় নোটসহ সরাসরি তুলে দিয়েছে। তাদের নোটে বলা হয়, "এবার পুলিশ প্রকাশ্য দিবালোকে ঢাকার নিম্ন আদালত চত্বরের পাশে পুলিশ ক্লাবের ভেতরে নিয়ে এক তরুণীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করল (alalodulal.org, ২৯মে, ২০১২)।"

পরের দিন বিস্তারিত জানার জন্য আরেকটি বাংলা দৈনিক খুলে দেখি, পত্রিকার লীড নিউজ "আদালত পাড়ায় পুলিশি নিষ্ঠুরতা।" খবরে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। একটা ছবিও ছাপা হয়েছে। ছবিটিতে আক্রান্ত-প্রতিবাদী নারীর মুখচ্ছবি অস্পষ্ট করা হয়েছে। ছবির নিচে ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণ, "দুপুর ১২টা, বাবা-মাকে আদালত সংলগ্ন পুলিশ ক্লাবে নিয়ে নির্যাতন। মেয়ের শ্লীলতাহানি দুপুর ৩.৩০, থানা থেকে বের হয়ে সাংবাদিক ও আইনজীবীদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মা ও মেয়ের সাহায্য প্রার্থনা…. (প্রথম আলো ৩০ শে মে, ২০১২)।" একই পত্রিকা আরও একটি ছোট নিউজ ছাপা হয়, "পুলিশের বিরূদ্ধে শ্লীলতাহানি চেষ্টার অভিযোগ (প্রথম আলো, ৩০শে মে, ২০১২)"।

২৯শে মে, ২০১২ রাতে টিভি চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত প্রোগ্রামের পাশাপাশি স্ক্রীনে ব্রেকিং নিউজ আকারে যে খবরটি যাচ্ছিল, তা অনেকটা এরকম, "ঢাকার আদালত পাড়ায় বিচারপ্রার্থী নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা।"

দুইদিন পরে প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম দেখা যায়, "এক পুলিশ সাময়িক বরখাস্ত/ মেয়ের শ্লীলতাহানি, মা-বাবাকে নির্যাতন (প্রথম আলো, ১ জুন, ২০১২)।"

আরও দুইদিন পরে "শ্লীলতাহানি/ এসি-ওসিসহ তিনজনকে প্রত্যাহার : সাময়িক বরখাস্ত আরও তিন (সমকাল, ৩ জুন, ২০১২)।"

তারপর দিন, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি একটি মানববন্ধন আয়োজন করে। তাদের ব্যানারে বক্তব্য ছিল, "রাজধানীর আদালত চত্বরে বিচারপ্রার্থী তরুণীকে পুলিশ সদস্য কর্তৃক শ্লীলতাহানিসহ তরুণী, তার পিতা-মাতা, সাংবাদিক এবং আইনজীবিদের প্রকাশ্যে নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন।" এই মানব্বন্ধনের খবরটি প্রকাশিত হয় নিম্নোক্ত শিরোনামে, "আদালত চত্বরে তরুণীর শ্লীলতাহানির বিচার দাবী (সমকাল, ৪ জুন, ২০১২)।"

এখানে উল্লেখ্য যে, ব্লগ, দৈনিক পত্রিকা ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে আদালত চত্বরের খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে যৌন নিপীড়কের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ঘটনার মুহূর্তে মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেবল সাংবাদিক নন, আইনজীবী, নারী আন্দোলনের সংগঠক, মানবাধিকার কর্মী যৌন নিপীড়নের শিকার নারীটির পাশে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের এ ভূমিকা আগামী সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করেছে।

আমার প্রশ্নটি অন্যখানে।

আমাদের দেশে সামাজিক মান-সম্মানের লিঙ্গায়িত বাস্তবতায় স্বামী ছাড়া অন্য কোনও পুরুষ নারীর গায়ে হাত দিলে নারীর সম্মানহানি হয়, নারীর শ্লীলতাহানি ঘটে। উপরিল্লেখিত সংবাদ ও প্রতিবাদী ব্যানারে এই পুরুষতান্ত্রিক ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করা হয় না। পুরুষ জোরপূর্বক নারীর শরীরে হাত দিয়েছে তাই যৌন নিপীড়ন ঘটেছে, এই পুরুষটি যেহেতু তার স্বামী নন, তাই নিরাপরাধ নারীর শ্লীলতাহানিও ঘটেছে বলে ধরে নেন, বা বিষয়টি নিয়ে সংকটে ভোগেন।

এমনকি বিবেকবান সাংবাদিক, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সংগঠকবৃন্দও এই পিতৃতান্ত্রিক সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হন।

শাসকের ভাষা/ধারণা দিয়ে শাসন যন্ত্র ভাঙ্গা যায় কি?