‘ঢাকা লিট ফেস্ট’-এর পৃষ্ঠপোষকতা ও ইংরেজিকে ‘লিডিং’ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা!

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 12 Nov 2018, 02:33 PM
Updated : 12 Nov 2018, 02:33 PM

আমরা জানি- বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা ও বাংলা একাডেমির সহযোগিতায় ৮-১০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হলো 'ঢাকা লিট ফেস্ট-২০১৮'। 'ঢাকা লিট ফেস্ট' শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কিছু প্রশ্ন ও বিবেচনা  পিছু ছাড়ছে না, অনেকের মতো আমারও। তা নিয়ে কিছু মতামত তুলে ধরছি। এই উৎসবের নামটি ইংরেজিতে প্রধান হয়ে আছে, তাতেই বোঝা যায় বাংলা ভাষার সাথে এর একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে আছে শুরুতেই। বাংলাকে দূরে ঠেলে রেখে ইংরেজিকে প্রধান ভাষায় পরিণত করার বাস্তবতা এই উৎসবের সকল কার্যক্রমে লক্ষ করা যায়; কখনো তা সূক্ষ্ণভাবে, কখনো  তা খোলামেলাভাবেই দেখা যাচ্ছে।

২০১১-২০১৪ সাল পর্যন্ত এই 'লিট ফেস্ট' সবার কাছে 'হে ফেস্টিভ্যাল' নামে পরিচিত ছিল। সেই সময় এই অনুষ্ঠান আয়োজন করতে কোনো সরকারি সহায়তা নেওয়া হতো না। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে আয়োজকরা বেসরকারি স্পন্সরের পাশাপাশি এই আয়োজনে সরকারি সহায়তা নিতে শুরু করেন এবং এর নামও পরিবর্তন করে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের আয়োজনে এর টাইটেল স্পন্সর ছিল বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউন এবং প্রধান স্পন্সর ছিল ব্র্যাক ব্যাংক।

গত ৮ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এবারের তিন দিনের 'ঢাকা লিট ফেস্ট-২০১৮'-এর উদ্বোধন ঘোষণা করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আশ্চর্য হতে হয় উদ্বোধনী ভাষণটি তিনি ইংরেজিতে দেন। অথচ আরও অনেক বেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন বা অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলায় ভাষণ দিয়ে থাকেন, সেখানে সংস্কৃতিমন্ত্রী  এই উৎসবে ইংরেজিতে বক্তব্য দিয়ে এক ধরনের অবস্থান নেন, যা বাংলাভাষার জন্য গৌরবের হয়ে উঠেনি।

এ সময় ঢাকা লিট ফেস্টের তিন পরিচালক, অভিনেত্রী নন্দিতা দাস এবং পুলিৎজার বিজয়ী লেখক অ্যাডাম জনসন তার সঙ্গে ছিলেন। এ আয়োজনে ১৫ দেশের দুই শতাধিক সাহিত্যিক, অভিনেতা, রাজনীতিক, গবেষক এবং বাংলাদেশের প্রায় দেড়শ' লেখক, অনুবাদক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ যোগ দিয়েছিলেন বলেন জানান আয়োজকরা। এই উৎসব চলে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা একাডেমির আয়োজনে এই উৎসব পরিচালনা করেছেন কথাসাহিত্যিক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের প্রতিষ্ঠাতা ও অর্গানিক চা এর ব্রান্ড মালিক এবং বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউনের প্রকাশক কাজী আনিস আহমেদ; আর একজন হলেন উদ্যোক্তা-অ্যাকটিভিস্ট কবি সাদাফ সায্ ও  অপরজন লন্ডনভিত্তিক কবি আহসান আকবার, যার একটি পিআর এজেন্সি আছে। ঢাকা লিট ফেস্টের টাইটেল স্পন্সর হিসেবে ছিল বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউন, কি-স্পন্সর হিসেবে ছিল ব্র্যাক ব্যাংক। গোল্ড স্পন্সর এনার্জিস, স্ট্রাটেজিক পার্টনার ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং পুরো আয়োজন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে 'যাত্রিক'।

আয়োজকরা ফেস্ট আয়োজন উপলক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে দুই কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল, কতো টাকা পেয়েছে শেষ পর্যন্ত তা আমরা জানি না। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. শেখ মুসলিমা মুন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ অর্থ চাওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। গত বছর এই অর্থের পরিমাণ ছিল এক কোটি টাকা। আর এক বছরের ব্যবধানে চাওয়া আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় দেড় কোটি টাকা।  ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক ও প্রযোজক সাদাফ সায্ একটি চিঠি দিয়ে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা চেয়েছেন বলে পত্র-পত্রিকায় খবর এসেছে। আয়োজকরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জনগণের টাকা নিয়ে এই উৎসবের আয়োজন করেন। আবার তারা ব্যাংক, বিদেশি এয়ারওয়েজ এবং স্পন্সরও নিয়ে থাকেন। তাহলে এই টাকা দিয়ে তারা কী কী করেন? এই টাকা বাংলা সাহিত্যের কোনো রকম বিশেষ উপকারে এসেছে কি? বাংলা সাহিত্য ইংরেজিতে অনুবাদ করে কি তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাঠকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন উল্লেখযোগ্যভাবে? তেমন কোনো নিদর্শন এই উৎসবে উপস্থাপন করা হয়নি।

আমরা লক্ষ করেছি- এই উৎসবের অতিথিদের সবচেয়ে দামী হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাদের আসা-যাওয়ার খরচও নিশ্চয়ই বহন করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি চত্বর সাজিয়ে বারোয়ারী মেলার মতো ঘুরেফিরে আড্ডা ও সময় কাটানোর নিছক পরিবেশও তৈরি করা হয়েছিল। একদিকে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান চলছে, তার পাশেই  জোর আওয়াজে ব্যান্ডের গান চলছে। দু-একটি বিষয়ে ভালো আলোচনা হলেও বেশিরভাগই গতানুগতিক ছিল, এধরনের আলোচনা অনেকটা একুশের বইমেলার সময় বাংলা একাডেমি করে থাকে, টিভির টকশোতেও দেখা যায়! তা আবার করার কী তাৎপর্য থাকে সরকারি টাকা খরচ করে? বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক ও আলোচকরা এই উৎসবে পূর্বে অংশগ্রহণের জন্য একহাজার টাকা সম্মানি পেতেন, এবার তা বাড়িয়ে তিন হাজার করা হয়েছিল বলে জানা যায়, তাতেই বা কতো টাকা গিয়েছে? বাকি টাকা কোথায় খরচ হলো তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

পূর্বে অনেক কবি, লেখক ও সাহিত্যিককে এই আয়োজনের বিরোধিতা করতে দেখা গেলেও এখন তাদের কাউকে কাউকে এই উৎসবে অংশ নিতে দেখা যায়! 'হে ফেস্টিভ্যাল'- এর নাম পরিবর্তন করে 'ঢাকা লিট ফেস্ট' নামকরণ করা হলেও সেখানে বাংলা সাহিত্য বিশ্ব দরবারে কতটুকু পৌঁছে যাচ্ছে, সেটিও বিবেচনা করা জরুরি। কেননা এই উৎসবে আমাদের সাহিত্য ও লেখককে বাদ দিয়েই বিদেশি ইংরেজি লেখককে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা মুখ্যভাবে করা হয়। এমন উৎসব যে কেউ করার অধিকার রাখেন, তাতে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু জনগণের করের টাকা সরকার কীভাবে কাকে প্রদান করছেন, তা নিয়ে আমরা সাধারণ মানুষেরা প্রশ্ন তুললেই পারি। এই উৎসব কারা আয়োজন করছেন?  তারা কি বাংলাদেশের কোনো শিল্প-সাহিত্যের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন? নাকি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টধর্মী  লাভজনক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান?  এসব প্রশ্ন বিবেচনা করে জনগণের টাকা খরচ করা উচিত। আমরা এখানে উদাহরণ দেই- 'উদীচী'-এর মতো প্রায় চারশ শাখা নিয়ে পরিচালিত ঐতিহ্যবাহী ও কর্মমুখর সাংস্কৃতিক সংগঠন তো তেমন অনুদান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে পায় না!  শুধু উদীচী কেন এধরনের অন্যান্য সংগঠনের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। আর একটি উদাহরণ দেই- জাতীয় কবিতা উৎসব প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বড় উৎসব করে দুইদিনব্যাপী, সেখানেও  বিভিন্ন  বিদেশি  অতিথি আসেন।

তাদের খরচ সর্বমোট মনে হয় এসময়ে ১০ লাখের বেশি হয় না! অথচ 'ঢাকা লিট ফেস্ট'-এর খরচ কোটি কোটি টাকা!  সেই অনুযায়ী এর ফলাফল কী? কারা এর উপকারভোগী- প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে? এই উৎসব বাংলাভাষা, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির কী  বা কতটুকু উপকারে আসছে?

অন্যদিকে এই উৎসবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েরর বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে বাংলা একাডেমির অনুবাদ বিভাগ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যের অনুবাদ করে তা প্রচার ও বিপণনে ভূমিকা পালন করলে আরও কার্যকর হতো বলে আমরা মনে করি।

আমরা কোনও ভাষার সাহিত্যকে অবজ্ঞা করি না, কিন্তু পাশাপাশি নিজের ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখবো, সে বিষয়ে কোনও ছাড় দেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। এমনিতে বাংলা ভাষা বিভিন্ন চাপ ও প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে, সেখানে বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও সরকারকে সবসময়ে সচেতন থাকতেই হবে, যদি শুধু বাংলা একাডেমির কথা বলি।

তাদের অন্যতম দায়িত্ব হলো, যা তাদেরই এক দলিলে উল্লেখ করা হয়েছিল- ক. জাতীয় আশা আকাঙক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও প্রসার ঘটানো; খ. জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও সকল স্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করার উদেশ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ।' তাহলে 'হে ফেস্টিভ্যাল' বা পরবর্তিতে 'ঢাকা লিট ফেস্ট' বাংলা একাডেমির উল্লিখিত দায়িত্বের সাথে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ? স্পন্সর যারা, তাদের নিশ্চয় প্রতিষ্ঠানগত উদ্দেশ্য রয়েছে, তা থাকা স্বাভাবিক! ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রধানতম উদ্দেশ্য- ইংরেজি ও ইংরেজদের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো, তবে নিশ্চিত যে বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানো নয় কিংবা বাংলা সাহিত্যের উন্নয়ন; তাহলে অনেক উদাহরণ আমরা পেতাম- নিদেনপক্ষে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ বা বিকাশের প্রমাণ পেতাম তাদের কাছ থেকে, সে ধরনের উদাহরণ নেই! আর অন্য যেসব সংস্থা সেগুলো ব্রিটিশ কাউন্সিলের অনুসারী বা ভাবাদর্শের অনেক কাছাকাছি হয়তো বা! আর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের যেসব ব্যক্তি বা লেখক আছেন, তাদের স্বার্থও একাকার হয়েছে 'হে ফেস্টিভ্যাল' বা 'ঢাকা লিট ফেস্ট' আয়োজনে, সেক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি তাদের নির্ধারিত উল্লিখিত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে একবারে 'হোস্ট' হয়ে নিয়মিত প্রতিবছর দায়িত্ব পালন করা সমীচীন হয়নি বলে মনে করি। এইকালে আগের চেয়ে সংগঠন-সংস্থা সংকীর্ণভাবে ব্যক্তির ইচ্ছে বা স্বার্থ পূরণে ব্যবহার হয়ে থাকে বেশি, তেমনি এ আয়োজনে কিছু ব্যক্তির ইচ্ছে বা ম্বার্থ পূরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

এ আয়োজন বিভিন্ন কারণে বাংলা একাডেমির আদর্শ-নীতি-উদেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। বর্তমানে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিছু উচ্চবিত্ত-বিশেষ শ্রেণি ও দেশি-বিদেশি সংস্থা দ্বারা অবহেলিত- অপমানিত ও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেই পরিস্থিতিতে এই আয়োজনে বাংলা একাডেমিরর প্রতি বাংলা ভাষাভাষী লেখক-সংস্কৃতি কর্মী ও মানুষের যে আস্থা বা ইমেজ রয়েছে, সূক্ষ্ণভাবে তাতে ধ্স নেমেছে! বাংলা একাডেমি কারো ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান নয়- এটা বিবেচনায় থাকা উচিত। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও স্বার্থের নিরিখে বাংলা একাডেমি ব্যবহৃত হোক-তা কারও কাম্য নয়।

বাংলা একাডেমি আয়তনে বেড়েছে, পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে তার নিজের আদর্শ থেকেও অনেক দূরে চলে গিয়েছে! মনে হয় বাংলা একাডেমি 'ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট' প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, নিত্যনৈমির্ত্তিক নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনে ব্যতিব্যস্ত! যার বেশিরভাগ বিভিন্ন ক্ষমতাধর ব্যক্তির তুষ্টির জন্যও হয়ে থাকে। যেসব কাজ শিল্পকলা একাডেমি বা জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র করতে পারে, সেগুলোও বাংলা একাডেমি করছে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেক বিশিষ্টজন যে ভাবে বাংলা একাডেমি চেয়েছিলেন, সেভাবে গড়ে ওঠেনি এখনো।

বাংলা একাডেমি অনুষ্ঠান-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান হোক আমরা চাই না । বাংলা সাহিত্য দেশের বাইরে পরিচিতি করানোর জন্য বাংলা একাডেমিরর নিজস্ব লিপিবদ্ধ দায়িত্ব রয়েছে, সে দায়িত্ব পালন কি হচ্ছে? সমকালীন বা গুরুত্বপূর্ণ বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য কি অনুবাদ করা হচ্ছে? না করে তার পরিবর্তে 'হে ফেস্টিভ্যাল' বা 'ঢাকা লিট ফেস্ট' পালন করা হচ্ছে! কার স্বার্থে?

বাংলা ভাষা আজ  অনেক পর্যায়ে অবহেলার শিকার হয়ে যেন কাতরাচ্ছে! এই ভাষার সহযোগী না হয়ে আগের চেয়ে রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারালয়, গণমাধ্যম ও ব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রে দূরবর্তী অবস্থানে চলে যায়- তা এক ট্রাজেডি। বাংলাদেশের সংবিধানের মোট চারটি স্থানে ভাষা প্রসঙ্গটি উল্লেখিত হলেও ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা'।  আর ২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- 'রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং  যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।'

সংবিধানে  বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার দিক-নির্দেশনা থাকলেও চার দশকের বেশি সময় পার হওয়ার পরও বাংলা দাপ্তরিকসহ রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে আবশ্যিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার  হচ্ছে না! এই সময়ে এসেও দেখা যায় সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, নামফলক দেওয়াল লিখন হচ্ছে ইংরেজিতে, সরকারি পর্যায়ের  বিভিন্ন বিলের ভাষা বাংলা নয়, ইংরেজিতে।

গণমাধ্যমের বিভিন্ন পর্যায়েও বাংলা ভাষার করুণ পরিস্থিতি। ঘরে ও বাইরে অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে- বাংলা ভাষার আলোটুকু গ্রাস করার জন্য।

একটি জাতীয় ভাষানীতি আমরা ভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছর পার হওয়ার পরও প্রণয়ন করতে পারেনি। এরফলে বাংলা ভাষা নিয়ে বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অরাজক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের দেশে শিক্ষানীতি, কৃষিনীতি, খাদ্যনীতি, ক্রীড়ানীতি, বাল্যবিবাহনীতি এবং আরও কতো নীতি আছে! কিন্তু ভাষানীতি নেই। সরকারের দু'টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, একটি হলো বাংলা একাডেমি আর একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, এই দু'টি প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা প্রচলনে কতটুকু জোরালো ভূমিকা পালন করছে, তা মূল্যায়ন করা আজ জরুরি। এদের ওপর যে  অর্পিত দায়িত্ব রয়েছে, সে-বিষয়ে তারা কতটুকু ভূমিকা পালন করছে?

বাংলা একাডেমির কথাই ভাবি- তারা কি ভাষানীতি প্রণয়নে কোনো বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছে? কিংবা বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনে কোনো বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে? বা সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছে? না, এ-রকম কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না!

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা না থাকলে, এই ভাষার সংকট আরও বাড়বে। ফ্রান্স, জাপানসহ উন্নত দেশসহ অনেক দেশে তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহারে রাষ্ট্র ও সরকারের নীতি-আইন রয়েছে এবং তা বাস্তবায়নে কঠোর ভূমিকাও রয়েছে। এজন্য তদারকি সেল আছে, এমনকি এক্ষেত্রে আইন-শৃংখলা বাহিনীকেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ভাষাবিরোধী কোনোকিছু হলেই তারা সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এই সময়ে এসে আমরা আমরা 'হে ফেস্টিভ্যাল' বা 'ঢাকা লিট ফেস্ট'-এর জন্য উৎসাহী ও নিবেদিত হয়ে পড়ছি!

যে দেশে একটি জাতীয় ভাষানীতি হলো না, বাংলাভাষা শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দিন দিন অবহেলার শিকার হচ্ছে, বাংলাভাষার সাহিত্য অনুবাদও হচ্ছে না অথচ বাংলা একাডেমি ও ভাষা ইন্সটিটিউটও কাঙ্ক্ষিতভাবে কাজ করছে না, অসহায় হয়ে যেন পড়ে আছে; সেই পরিস্থিতিতে 'ইংরেজি মিডিয়াম'কে আরও প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সরকার উদাসীনভাবে জনগণের করের কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ ও অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে 'লিট ফেস্ট' আয়োজনে এবারও এগিয়ে এসেছে। এটা কি ভাষা আন্দোলন, বাংলাভাষা, বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতিবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি? এটা কি সরকারের বিবেচনবোধসম্পন্ন দায়িত্ব পালন? 'লিট ফেস্ট'-এর মূল চারিত্র কী? এর প্রভাব কী? তা কি গভীরভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে? নাকি আবারও ইংরেজি ভাষার আধিপত্য বিস্তারে সহায়তা করে 'ঢাকা লিট ফেস্ট'-এর মতো কার্যক্রমকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ইংরেজিকে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে 'লিডিং' অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করবো?  সেটা এক বড় প্রশ্ন!