নির্বাচনী গেইমে প্রথম রাউন্ড জিতলেন শেখ হাসিনা

স্বদেশ রায়
Published : 12 Nov 2018, 01:47 PM
Updated : 12 Nov 2018, 01:47 PM

দেশের ছোট-বড় প্রায় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে এসেছে। বিএনপিসহ যে বিশ দলীয় জোট গত পাঁচ বছর যাবত সরকার বিরোধী আন্দোলন করার চেষ্টা করে আসছিলো, তারাও নির্বাচনে এসেছে।

বিশেষ করে খালেদা জিয়াকে জেলে রেখেও, তারেক রহমানকে পলাতক জীবনে রেখে বিএনপি নির্বাচনে এসেছে । অর্থাৎ দেশের সব রাজনৈতিক দল এখন শেখ হাসিনা পরিচালিত আওয়ামী লীগ সরকার বা জোট সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাচ্ছে। আসন্ন এ নির্বাচন নিয়ে দেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও বিএনপি জোটের বক্তব্য ছিলো তারা শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচন হতে দেবে না। তার সঙ্গে খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় সাজা পেয়ে জেলে যাবার পরে তারা যোগ করেছিলো, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে দেশে কোনও নির্বাচন হবে না। বিএনপি নেতাদের বক্তব্য ছিলো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।

অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে সব সময় দেখা গেছে এ বিষয়ে তিনি অনেকটা ভারমুক্ত বক্তব্য রেখেছেন। তিনি কখনই বিএনপি বা তাদের বিশ দলীয় জোটের এই হুমকিকে আমলে নেননি। শেখ হাসিনার এই বিন্দুমাত্র আমলে না নেয়া নিয়ে এখান থেকে কয়েক মাস আগেও দেশে অনেকেরই ধারণা ছিল শেখ হাসিনা আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সমর্থ হবেন না।

এর পরে সেপ্টেম্বর মাসে রাজনীতি থেকে ঝরে পড়া কিছু ব্যক্তি ও কয়েক বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি মঞ্চের আবির্ভাব হয়। বিএনপি ওই মঞ্চে যোগ দেয়। বিএনপি এই মঞ্চে যোগ দেবার পরে কিছু বিএনপি নেতা ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এমন বক্তব্য রাখতে শুরু করেন যে, অক্টোবর মাসেই শেখ হাসিনার সরকারের পতন হবে। তাছাড়া এখন অবশ্য সকলে জানেন, দেশের ভেতর এক শ্রেণীর লোক শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানোর জন্যে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে জনগণের কাছে যাওয়া হয়নি, ষড়যন্ত্র করা হয়েছিলো। শেখ হাসিনা সে সব ষড়যন্ত্রের খবর পাবার পরেও ভারমুক্তভাবেই দিন পার করেন। তথাকথিত এই বিরোধীদলগুলো ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কোনও দাবিতে শেখ হাসিনা কোন পাত্তা দেননি। তার কথায় তিনি স্থির ছিলেন, সংবিধানের বাইরে তিনি একচুলও যাবেন না।

অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো বড় বেশি বিদেশমুখী হয়ে পড়ে। তারা শুধু দেশের কূটনীতিক পাড়ায় দৌড়াদৌড়ি করেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখেননি, তারা ইউরোপ আমেরিকায়ও দৌড়াদৌড়ি করেছেন। বিএনপি নেতারা দিনের পর দিন দিল্লি কাটাচ্ছেন এমন খবরও মিডিয়ায় আসে। এমনকি দেশবাসীর সঙ্গে এ ধরনের খবর নিয়ে প্রতারণাও করা হয়। যেমন বিএনপির জেনারেল সেক্রেটারির জাতিসংঘের সহকারী সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাটা কোনও অফিসিয়িাল সাক্ষাৎকার ছিলো না, তারপরেও সেটা অফিসিয়াল বলে প্রচার করা হয়। এ নিয়েও পত্র-পত্রিকায় এবং টেলিভিশনে খবর ছাপা হয়। জাতিসংঘের বরাত দিয়ে কালের কণ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে যে, এটা কোনও অফিসিয়াল বৈঠক ছিল না, এবং বিষয়টি সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিব অবগত নন। অন্যদিকে বিএনপির ভেতরের সংবাদ ছিলো, ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ ধরনের প্রতারণামূলক কাজে যেতে চাননি, তাকে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।

যাহোক, এসব কোনও কিছুতেই শেখ হাসিনার কোনও ভাবান্তর মানুষ লক্ষ্য করেনি। শেখ হাসিনা তার লক্ষ্যে ও বক্তব্যে স্থির ছিলেন- যে তার সরকারের অধীনে এবং বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। বরং তিনি তার কর্মী ও নেতাদের বারবার হুঁশিয়ার করতেন, তারা যেন ২০১৪ এর মতো কোনও সহজ নির্বাচনের কথা না ভাবে। তারা যেন কোনরূপ 'ওভার কনফিডেন্ট' না হয়। বরং তারা একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্যে যেন প্রস্তুত থাকে।

এছাড়া তিনি তার কর্মীদের বার বার বলতেন, তারা যেন মানুষের কাছে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের চিত্র নিয়ে যায়। তাদেরকে যেন বুঝিয়ে বলে দশ বছর আগে দেশটি কোথায় ছিল আর দশ বছরে তার সরকার দেশকে কোথায় নিয়ে এসেছে। শেখ হাসিনার এই আচরণ বিশ্লেষণ করলে মনে হতো তিনি ধরেই নিয়েছেন, সবদল তার অধীনে নির্বাচনে আসবে। দেশে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হবে। শেখ হাসিনার আচরণ থেকে অংক মিলিয়ে আমাদের মতো ক্ষুদ্র রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আমরা তাই লেখালেখিতে বা টকশোতে বার বার বলেছি, ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, বিএনপি শেষ অবধি নির্বাচনে যাবে। শেখ হাসিনা বিএনপিসহ সব দলকে নির্বাচনে আনতে সমর্থ হবেন।

বাস্তবে রাজনীতি নির্ভর করে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ওপর। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন রাজনীতিতে ছিলেন একজন সফল নেতা। তার সব থেকে বড় কারণটি ছিলো, তার সিনিয়র নেতারাও যখন রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছেন, সে সময়েও বঙ্গবন্ধু কোনও সিদ্ধান্তে ভুল করতেন না। শেখ হাসিনার রাজনীতিও যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে তার সঠিক সিদ্ধান্তের পাল্লাটিই আমরা বেশি ভারী পাই, যেমন পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও। এবারও ছোট্ট একটি সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়ে শেখ হাসিনা বদলে ফেললেন রাজনৈতিক পরিবেশ।

ড. কামাল শেখ হাসিনাকে বিপদে ফেলার জন্যে সংলাপের চিঠি দিয়েছিলেন। তাদের হিসাব ছিলো, শেখ হাসিনা যেভাবে বার বার বিএনপি সঙ্গে সংলাপকে নাকচ করে দিয়েছেন এখানেও তাই করবেন। কিন্তু ফরমাল একটি সংলাপের চিঠির ক্ষেত্রে যে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত ভিন্ন হবে সেটা আইনজ্ঞ ড. কামাল বুঝতে পারেননি। তিনি বুঝতে পারেননি, বয়স তার বেশি হতে পারে কিন্তু রাজনীতিতে তিনি হাসিনার থেকে অনেক কম পরিপক্ক। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাত একজন আইনজ্ঞ হিসেবে, রাজনীতিক হিসেবে নয়। তাই তার হয়তো হিসাবে ছিলো না যে বাংলাদেশে একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের রাজনীতিক শেখ হাসিনা। আর তার অবস্থান এখন বিশ্বের তিন-চার জন নেতার পরেই। যেমন তিনি যে বর্তমান মুহূর্তে সাউথ এশিয়ার মূল নেতা সেটা তার দিল্লি সফরের সময় নরেন্দ্র মোদির সামনেই বললেন মি. আদভানী। এবং নরেন্দ্র মোদিও তার ভাষণে শেখ হাসিনার প্রতি সেই সম্মানই দেখান।

এই শেখ হাসিনাকে হিসাব করতে ভুল করেছিলেন ড. কামাল। যাহোক, কামালের লিখিত সংলাপের চিঠিকে পজিটিভভাবে নিয়ে শুধু ড. কামালের জোটের সঙ্গে নয়- দেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসেন শেখ হাসিনা। বাস্তবে তার আচরণ দেখে মনে হলো, এমন একটি সুযোগের জন্যে তিনি অপেক্ষা করছিলেন। আর সংলাপে কী হলো তা তো দেশবাসী জানেন। শেখ হাসিনা প্রমাণ করলেন, তিনিই বাংলাদেশের নেতা। বিএনপি নেতা জমিরউদ্দিন সরকার তাই সত্য স্বীকার করে তার পাশে ছুটে গিয়ে বললেন, নেত্রী আসলে আপনি বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা। জমিরউদ্দিন সরকার রাজনীতি করেছেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সঙ্গে। তিনি বড় মাপের নেতা দেখেছেন। তাই তিনি মুগ্ধ হলেন শেখ হাসিনাকে দেখে।

শুধু তাই নয়, ড. কামাল থেকে শুরু করে ফ্রন্ট ও বিএনপির সব নেতা ম্লান হয়ে যান শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপের ভেতর দিয়ে। ড. কামালও বুঝতে পারলেন, ফিস নিয়ে কোর্টে দাঁড়ানো আর জনগণের উপকার করার জন্যে সঠিক রাজনীতির পক্ষে যুক্তি দেয়া ভিন্ন বিষয়। সেখানে শেখ হাসিনার সামনে তিনি নিতান্তই শিশু।

যাহোক, সংলাপের মাধ্যমে উত্তাপের রাজনীতিতে সম্পূর্ণভাবে পানি ঢেলে দিতে সমর্থ হলেন শেখ হাসিনা। তৈরি করলেন শান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ। তিনি সবাইকে বোঝাতে সমর্থ হলেন, দেশের স্বার্থে সকলের নির্বাচনে যাওয়া উচিত। সেখানে দুর্নীতির দায়ে খালেদার জেলে থাকার বিষয় সামনে আনা যেমন ঠিক নয় তেমনি রাজনৈতিক সরকারের বদলে অপশক্তি ক্ষমতায় আসার পথ করার জন্যে সংবিধানে বাইরে যাওয়া উচিত নয়। অধিকাংশ দল এই সত্য মেনে নেওয়াতে বিএনপি বা তাদের নব্যমুখ ঐক্যফ্রন্টের আর সমর্থ থাকলো না নির্বাচনের বাইরে থাকা।

কারণ, তারা ভালোমতোই বুঝতে পারলেন শেখ হাসিনা অন্য সব দলকে নির্বাচনে আনার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। এখন তারা দূরে থাকলে রাজনীতির মূল ট্রেন থেকে তারাই ছিটকে পড়বে। তাই তারাও তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচনে চলে এলো। অর্থাৎ বিএনপিসহ সব দল শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাচ্ছে এটাই বর্তমান মুহূর্তের বাস্তবতা। আর এ কাজে সমর্থ হবার ভেতর দিয়ে শেখ হাসিনা প্রমাণ করলেন, নির্বাচনী গেইমের প্রথম রাউন্ড তিনি জিতেছেন। অর্থাৎ তার সরকারের অধীনেই দেশে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে।