মাশরাফির নির্বাচন: যেখানে অসুবিধা দেখি না

কবির য়াহমদ
Published : 11 Nov 2018, 06:29 PM
Updated : 11 Nov 2018, 06:29 PM

এবছরের ২৯ মে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা আর সাকিব আল হাসানের নির্বাচন করার কথা জানিয়েছিলেন তখন বিস্ময়ে চোখ ওঠেছিল কপালে। জাতীয় দলের দুই অপরিহার্য খেলোয়াড় আবার তিন ফর্মেটের দুই অধিনায়কের খেলার সঙ্গে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত আলোচনাটা ওখানে থামে যেখানে ছিল অন্তত তারা নিজেরা তো বলেন নি! অন্য অনেক কথার মতো এই কথাকেও রাজনীতিবিদদের কথা বলে- তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলাম আমরা অনেকেই।

সেদিনের বক্তব্যে মুস্তফা কামাল মাশরাফি-সাকিব কোন দলের প্রার্থী হচ্ছেন সেটা না বললেও বোঝাই যাচ্ছিল তিনি তাদের আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছিলেন। মন্ত্রী বলেছিলেন, 'আগামী নির্বাচনে সবাই তাদেরকে (মাশরাফি ও সাকিব) সহায়তা করবেন। যদি বিএনপি থেকেও তারা দাঁড়ান তারপরও তাদেরকে সহায়তা করবেন। কোন আসন থেকে নির্বাচন করবেন সেটিও এখন বলা যাবে না'। মন্ত্রীর এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মাশরাফি বলেছিলেন, 'আসলে কামাল ভাই (আ হ মুস্তফা কামাল) যা বলেছেন, সেটা তার কথা। আমি সে সম্পর্কে কিছুই জানি না।' ওই আলোচনা ওখানেই শেষ হয়েছিল। কেবল মাশরাফিই নয় সাকিব আল হাসান ফেসবুকে তার ভেরিফায়েড পেজে দেওয়া এক পোস্টে জানিয়েছিলেন এখনই নির্বাচন নিয়ে না ভাবার কথা।

পরিকল্পনা মন্ত্রীর সেই বক্তব্যের ছয় মাসও হয়নি। এরই মধ্যে তার সে কথা অক্ষরে-অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্যে মাশরাফি-সাকিবের নির্বাচন করার কথা আবারও উঠেছে, এবং এবার ঠিক সে মুহূর্তে যখন নির্বাচনের জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত দেশ। নির্বাচনের তফসিলও ঘোষণা হয়ে গেছে।

রোববার দেশবরেণ্য এই দুই ক্রিকেটারের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের কথা ছিল। সংবাদ প্রকাশের পর নানামুখী আলোচনার এক পর্যায়ে জানা গেল সাকিব আল হাসান নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেন নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত- এনিয়ে সাকিব তাৎক্ষণিক কিছু না বললেও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাকিব আল হাসানকে আগামী বিশ্বকাপ আর ক্রিকেট খেলায় আরও মনোযোগ দিতে এখনই নির্বাচন না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে মাশরাফি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম নেওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন, এবং সেখান থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছেন।

এরপরই  নড়াইল-২ আসন থেকে প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের ফরম নিয়েছেন মাশরাফি। এখানে বলে রাখা ভালো এই আসনটিতে মহাজোট সরকারের গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য  ছিলেন ওয়ার্কাস পার্টির শেখ হাফিজুর রহমান।

এই দুই ক্রিকেটারের আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা আসার পর যে আলোচনা মুখ্য হয়ে উঠেছিল সেটা হচ্ছে, এখনই তাদের ক্রিকেট ছেড়ে কিংবা ক্রিকেটের পাশাপাশি রাজনীতিতে জড়ানো উচিত কিনা। অনেকের শঙ্কা ছিল এর মাধ্যমে দেশসেরা এ দুই ক্রিকেটারের ক্রিকেট ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়বে। দেশের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক ও বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান কেবল বাংলাদেশই নয়, সারাবিশ্বের বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগেও খেলে যাচ্ছেন। এত এত ক্রিকেটের ভিড়ে তিনি জনপ্রতিনিধি হয়ে গেলে কীভাবে সবকিছু সামলাবেন। অনেকের শঙ্কা ছিল এত চাপ সামলাতে পারবেন না সাকিব। এতে করে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার সংক্ষিপ্ত হয়ে যেতে পারে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের ক্রিকেট। এত চাপ সহ্য সামলাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত দেশের ওয়ানডে ও টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েও ফেলতে পারেন এই অলরাউন্ডার- এমন আলোচনাও চলছিল। এর বাইরে ইতিবাচক আলোচনাও ছিল অনেকের মত ছিল সাকিব-মাশরাফিদের মত ক্রিকেটারদের রাজনীতিতেও আসা উচিত। তারকারা এভাবে রাজনীতিতে আসলে দেশের রাজনীতির অবস্থাই পরিবর্তন হয়ে যাবে।

তবে এত এত আলোচনা শেষে চূড়ান্ত মন্তব্য করার মত অবস্থায় যেতে হয়নি, এর আগেই আলোচনায় জল ঢেলে দিয়েছেন সাকিব নিজেই; নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে। যদিও সাকিবের সিদ্ধান্তের পরের দিন ওবায়দুল কাদেরের মুখ থেকে জানা গেল সাকিবের নির্বাচনের না যাওয়ার পেছনে প্রধানমন্ত্রীর ছিল ভূমিকা।

সাকিব নির্বাচন না করলেও মাশরাফি নির্বাচন করছেন, এবং সেটা নড়াইলের একটি আসন থেকে। সাকিবের মত মাশরাফি ক্রিকেট ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে নেই, ক্যারিয়ারের শেষাংশে উপনীত মাশরাফি। আগামী জুনে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপের মাধ্যমেই তিনি তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ করবেন। অবসরের এই পথপরিক্রমায় মাশরাফি ইতোমধ্যে টেস্ট ক্রিকেট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসরে গেছেন। বাকি ক্রিকেট যে মাধ্যম সেটা ওয়ানডে, এবং বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের তিনিই অধিনায়ক।

ক্রিকেটারদের রাজনীতিতে আসার উদাহরণ এই উপমহাদেশের নতুন কিছু নয়। ভারতের সেই মনসুর আলী খান পাতৌদি থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়াসহ অনেকেই এসেছেন রাজনীতিতে। কেউ কেউ সফল হয়েছেন, আবার কেউবা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে ক্রিকেটার রাজনীতিবিদ হিসেবে সবচেয়ে সফল হওয়া নাম পাকিস্তানের ইমরান খান। রাজনীতিতে নামার ২৩ বছর পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কেবল তারাই নন ক্রিকেটার রাজনীতিবিদ হিসেবে আরও আছেন নবজ্যোত সিং সিধু, বিনোদ কাম্বলি, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, অর্জুনা রানাতুঙ্গা এবং বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়। জয়াসুরিয়া বাদে বাকি সকলেই ক্রিকেট ছেড়ে রাজনীতিতে পা দিয়েছেন।

মাশরাফি ক্রিকেট খেলা অবস্থায় রাজনীতিতে আসছেন, নির্বাচন করছেন। তবে এটা নজিরবিহীন নয়, এমন নজির আগেই স্থাপন করেছেন শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়া। জয়াসুরিয়া জাতীয় দলে থাকাবস্থায় রাজনীতিতে নেমেছিলেন, নির্বাচন করেছিলেন এবং নির্বাচনে জিতে সংসদেও গিয়েছিলেন, রানাতুঙ্গার মতো মন্ত্রী না হলেও উপমন্ত্রীও হয়েছিলেন।

সনাথ জয়াসুরিয়া ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাহেন্দ্র রাজাপাকসের ইউনাইটেড পিপল ফ্রিডম অ্যালায়েন্সে যোগ দেন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এমপি হয়ে যাওয়ার পরও খেলা চালিয়ে যান জয়াসুরিয়া। ২৮ জুন ২০১১ সালে দেশের হয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন তিনি। এবং এরও এক বছর পর শ্রীলঙ্কার ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। ২০১২ সালে জয়াসুরিয়া খুলনা রয়েল বেঙ্গলসের (কেআরবি) হয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) খেলেও যান। জয়াসুরিয়া যেমন ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষের দিকে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছিলেন, মাশরাফিও সেই একই পথে। এখানে জয়াসুরিয়ার সঙ্গে মাশরাফির একটা বড় মিল।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না মাশরাফি, এমনকি রাজনীতির মাঠেও ছিলেন না তিনি। অবশ্য সে সুযোগও ছিল না তার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রে ভর্তি হলেও লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি তিনি ক্রিকেট-ব্যস্ততায়। ১৭ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার চলমান তার, যার শুরু হয়েছিল ২০০১ সালের নভেম্বরে। টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে শুরু হলে আগামী বছরের জুনের ওয়ানডে দিয়ে ক্রিকেট ক্যারিয়ার সমাপ্তির আলোচনা রয়েছে। ক্রিকেটের কারণে লেখাপড়া শেষ করতে না পারলেও তিনি যে মানুষের সংস্পর্শে ছিলেন না তা নয়। মাশরাফির নিজের শহর নড়াইলে গড়েছেন তিনি 'নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন'; এবং এর মাধ্যমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। এই ফাউন্ডেশন নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা হয় যখন গতবছরের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) রংপুর রাইডার্সকে শিরোপা জিতিয়ে তিনি মানবতার সেবার জন্যে অ্যাম্বুলেন্স চান দলের মালিকের কাছ থেকে। এলাকার মানুষের প্রতি তার এমন মমত্ব, অঙ্গিকার গণমানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগের সাক্ষর বহন করে।

একটা সময়ে রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের আধিক্য থাকলেও সময়ের ফেরে সেখানে রাজনীতিবিদদের সংখ্যা কমার ধারা চালু হয়েছে। ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসর কাটানোর একটা জায়গা হয়ে পড়েছে রাজনীতি, বিশেষ করে জনপ্রতিনিধি হয়ে যাওয়ার রাজনীতি। এমন অবস্থায় মাশরাফির মত একজন তরুণ রাজনীতিতে আসলে সেটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা যেতে পারে। যদিও তিনি এখনই এজন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত কিনা এও দেখার বিষয়। তবে তিনি যে প্রস্তুতির মধ্যেই ছিলেন সে প্রমাণ পাওয়া যায় 'নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশনের' মাধ্যমে মানুষের কাছাকাছি থাকার চেষ্টায়। তার বয়স, পাশাপাশি নেতৃত্বগুণ তাকে বাকি সকল সীমাবদ্ধতার বিপরীতে তাকে এই মাধ্যমে কিছুটা হলেও যোগ্য করে তুলছে।

খেলোয়াড়ি জীবনের সাফল্য, নেতৃত্ব গুণ ও ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা বাংলাদেশ ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফিকে আজ এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে, যেখানে দেশের ৩০০ আসনের মাত্র একটি আসনের একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েও তিনি এমন আলোচনায়। এখন পর্যন্ত বলা যায় খেলোয়াড়ী জীবনে সফল এক ব্যক্তিত্ব মাশরাফি। তিনি শুধু বাংলাদেশের সফল একজন অধিনায়কই নন বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক। তার নেতৃত্বে দেশে বাংলাদেশ দুর্দান্ত এক দল; তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ওঠেছিল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে, চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে, এবং দুইবার খেলেছে খেলেছে এশিয়া কাপের ফাইনালও। মাঠে খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষা বদলে দেওয়ার অন্যতম কারিগর তিনি। যখন মাঠে থাকেন তখন পুরো দল জেগে ওঠে বিপুল উদ্যমে।

এমন এক অধিনায়ক, এমন এক ব্যক্তিত্ব অবসরের দুয়ারে এক পা দিয়ে যখন গণমানুষের সেবার নিমিত্তে রাজনীতিতে নাম লেখান তখন একে স্বাগত না জানানোর যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। মাশরাফি জনপ্রতিনিধি হলে ক্ষতি কী? ক্ষতির বড় কিছু দেখিনা, বরং লাভটাই দেখি। এই লাভ মাশরাফিকে ব্যবহারের মাধ্যমে, ক্রিকেট মাঠে মাশরাফি যেমন নিজেকে আর দলকে ব্যবহার করেছেন, রাজনীতির মাঠেও সে ব্যবহার হবে বলে আশাবাদী।

বলাকা'য় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, "ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা/ ওরে সবুজ ওরে অবুঝ/ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা/ রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে/আজকে যে যা বলে বলুক তোরে/ সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ করে/ পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা"।

কবির আহ্বান ছিল নবীনের তরে, আমরাও তো সকল ক্ষেত্রে নবীনের এমন অংশগ্রহণ চেয়ে এসেছি। এই মাশরাফি নবীনের আরও এক প্রতিনিধি, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় উল্লেখ চাওয়াটার মতোই!