৭ নভেম্বর কী হিসেবে চিহ্নিত করবো?

আনোয়ার কবির
Published : 10 Nov 2018, 11:25 AM
Updated : 10 Nov 2018, 11:25 AM

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত সমালোচিত বিতর্কিত দিন ৭ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালে সংগঠিত এদিনের ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে যে ওলটপালট করে দেয় তার রেশ থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশের রাজনীতি। ৭ নভেম্বর অনেকের কাছে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস, অনেকের কাছে সৈনিক-জনতার অভ্যুত্থান দিবস আবার অনেকের কাছে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস। রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তিনটি বিশ্লেষণ বা মূল্যায়নের পূর্ণ নয় আংশিক সত্যতা পাওয়া যায়।

৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান, যে অভ্যুত্থানে সরাসরি সামরিক বাহিনীর সাথে সে সময়ের অন্যতম প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল জাসদ সম্পৃক্ত ছিল। জাসদ কখনো তার সংশ্লিষ্টতাকে অস্বীকার করেনি। অভ্যুত্থান পরবর্তী তার ফলাফলে নিজেদের ব্যর্থতাকে অস্বীকারের চেষ্টাও করে না। সামরিক বাহিনীর সাথে রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক নিয়ে তাদের ব্যর্থতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থায়ীভাবে সামরিক বাহিনীকে অনেকাংশে সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতার অঙ্গে পরিণত করেছিল। অনেক ক্ষেত্রে বলা যায় বুর্জোয়া রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীকে রাষ্ট্রক্ষমতার সাথে সম্পর্কের যে বিষয়টি বলা হয় সেখানে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ৭ নভেম্বর প্রথম প্রকাশ্যে হত্যার শিকার হন ২ জন সেক্টর কমান্ডার ও ১ জন সাব সেক্টর কমান্ডার। আর এই ৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে ২১ জুলাই ১৯৭৬ সালে স্বাধীন দেশে প্রথম ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন আরেকজন সেক্টর কমান্ডার। এছাড়া সেনাবাহিনীর ভেতরে ১৩ জন হত্যার শিকার হন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও কোনও সেক্টর কমান্ডারকে সরাসরি কোন যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হতে হয়নি। আর তাই হত্যার নৃশংস ভয়াবহতা ৭ নভেম্বরকে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ে পরিণত করেছে। সপরিবারে ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বর জেলে জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ড, ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সশস্ত্র বাহিনীতে হাজার হাজার সৈনিক হত্যাকাণ্ড, জিয়াউর রহমানের হত্যার পরে জেনারেল মঞ্জুর, জিয়া হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রহসনমূলক বিচারে ১৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসির ঘটনা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীসহ দেশের ইতিহাসকে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ে ঠেলে দিয়েছে।

৭ নভেম্বরকে একটি অংশ 'জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস' হিসেবে পালন করতে চান। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালনকারিরা মূলতঃ জিয়াউর রহমান ও তার দল বিএনপি এবং কয়েকটি ধর্মীয় উগ্র সাম্প্রদায়িক দল। সাম্প্রদায়িক দলগুলো মূলত: মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের জন্য জাতির বড় অংশের কাছে ঘৃণিত। সাম্প্রদায়িক দলগুলোর স্পষ্ট বক্তব্য, ৭ নভেম্বরের জন্যই জিয়াউর রহমানের হাত ধরে তাদের আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশ নেয়া সম্ভব হয়েছে। এছাড়া জিয়াউর রহমানের দল বলার চেষ্টা করে, সেদিন সিপাহী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সাধারণ সিপাহীরা বন্দিদশা থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্ত করে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে নিরাপদ করেছেন।

যারা এই বিপ্লবের তত্ত্বের কথা বলেন, তারা কখনো সেদিন কোন সিপাহীরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন, বা কোন সিপাহীরা বিপ্লব করেছিলেন সে বিষয়ে আশ্চর্যরকম নিশ্চুপ থাকেন। জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতায় থাকাকালীন বা পরবর্তীতে তার দল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় থাকাকালীন  এ বিষয়ে কোনও রকম প্রমাণ হাজির করেনি। অথচও তারা সিপাহী বিপ্লবের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সিপাহী বিপ্লব বললে তো অবশ্যই বিপ্লবী সিপাহীদের মূল্যায়ন করতে হবে, তাদেরকে জাতির সামনে পরিচয় করে দিতে হবে। অথচও জিয়াউর রহমান ও পরবতীতে তার দল ক্ষমতায় থাকাকালীন ৭ নভেম্বরকে সিপাহী বিপ্লব হিসেবে 'জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস' হিসেবে পালন করে। ভবিষ্যতেও কখনো ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রীয় ছুটিসহ গোঁজামিলের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আবারো তারা পালন করবে।

'জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস' পালনকারিরা ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের জন্য কর্নেল তাহের, জাসদ ও সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস পালনকারিদের দায়ী করেন। এ বিষয়ে ৭ নভেম্বরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া খালেদ মোশারফ, হায়দার ও হুদার অন্যতম সহযোদ্ধা কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম তার মুক্তিযুদ্ধসহ সে সময়ের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ 'একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর' গ্রন্থে লিখেছেন- "৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড তদন্ত ও বিচারের হাত থেকে চিরদিনের জন্য দায়মুক্ত থাকার ব্যবস্থা হিসেবে অত্যন্ত সুচতুরভাবেই এই দিনটিকে 'জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস' রুপে ঘোষণা করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে জিয়ার একটি মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন ছিল। সেই সঙ্গে সামরিক ও বেসামরিক সকল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত বিচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।"

৭ নভেম্বর একটি অংশ 'সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস' হিসেবে পালন করেন। মূলত এ পালনকারিরা রাজনৈতিক দল জাসদ ও তার সমর্থক অংশ। এ অংশ সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানটিকে ব্যর্থ এবং অভ্যুত্থানের মোটা দাগে ফল হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের উত্থানকে অস্বীকার করেন না। সিপাহী এবং জনতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে প্রতিবিপ্লবীরা ক্ষমতা দখল করেছেন বলে এ অংশ মনে করে থাকে। আর তাই ৭ নভেম্বরের ফল হিসেবে রাষ্ট্রযন্ত্রে একাত্তরের পরাজিত শক্তি অনুপ্রবেশের বিষয়টিও জাসদ অস্বীকার করে না। ৭ নভেম্বরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মূলত ৭ নভেম্বর সিপাহীদের অভ্যুত্থান সংগঠনের পেছনে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদ সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল।

অভ্যুত্থানের প্রথম কয়েক ঘণ্টা এই দলের একটি শক্ত অবস্থানও পরিলক্ষিত হয়। অভ্যুত্থানটির সূচনা ও পরিকল্পনাও করে কনেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। পরবতীতে কর্নেল তাহের ও জাসদ পুরোপুরিভাবে এ অভ্যুত্থান থেকে অপসৃত হন। উল্টো অভ্যুত্থানের কারণে কর্নেল তাহের, জাসদ নেতৃবৃন্দ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈনিকেরা কোর্ট মার্শালের সন্মুখীন হন। কোর্ট মার্শালে কর্নেল তাহের ফাঁসিতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। জাসদের কিছু নেতা, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃবৃন্দ ও অধিকাংশ সৈনিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে কয়েক বছরের জেল ও সশস্ত্র বাহিনী থেকে বহিস্কৃত হন। জাসদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃবৃন্দ ৭ নভেম্বরে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্য জিয়াউর রহমানের অনুগত ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অফিসার ও সৈনিকদের দায়ী করে থাকেন। আর তাই জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালীন কখনো এই হত্যকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন বা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অফিসার ও সিপাহীদের বিচারের কোনও রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি বলে তারা মনে করেন।

উল্টো হত্যাকারী অফিসার ও সিপাহীরা সেনাবাহিনীতে পুরস্কৃত হয়েছেন। নিজেদের কলঙ্ক যাতে প্রকাশিত না হয় তাই কর্নেল তাহের, জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার উপর প্রচারণার মধ্য দিয়ে হত্যাকাণ্ডের দায় চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করেন। 'সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস' পালনকারি জাসদ নেতৃবৃন্দ অভুত্থানে ব্যাপক সংখক জনতাকে সম্পৃক্ত করার ব্যর্থতাকে স্বীকার করেন এবং এই ব্যর্থতার জন্য অভ্যুত্থানটি তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় বলে জাসদের অনেকে মনে করেন। অভুত্থানে জনগণ বিশেষ করে জাসদের মতাদর্শে বিশ্বাসী ও সমর্থকদের উল্লেখযোগ্য অংশকে সম্পৃক্ত করতে না পারার ব্যর্থতার জন্য জিয়াউর রহমান ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া সৈনিক ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মিশে কর্নেল তাহের জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পেয়েছেন বলেও জাসদের অনেকে বিশ্বাস করেন।

৭ নভেম্বরের সকল বিষয়কে কলঙ্কজনক অধ্যায়ে পরিণত করে এদিনের হত্যাকাণ্ডগুলো। ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যাকারিরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের যে জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা দেশকে আবারও সে জায়গায় নিয়ে যায়। মধ্যখানে ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে হত্যাকারিদের উৎখাত ও সেনাবাহিনীর মধ্যে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। সামরিক আদালতে কর্নেল তাহের ও জাসদের বক্তব্য অনুযায়ী তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের প্রচেষ্টা নিয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতায় সামরিক আদালতে বিচারের নামে প্রহসন করে কর্নেল তহেরকে হত্যা ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

৭ নভেম্বরে সেনাবাহিনীসহ বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডগুলোর শিকার প্রায় সকলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী সৈনিক। সুতরাং এদিনকে একটি অংশ 'মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস' হিসেবে পালন বা মূল্যায়ন করে থাকে। ঐতিহাসিক বিচার বা মূল্যায়নে এ সত্যকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের পরে ১৫ অগাস্ট, ৩ নভেম্বরের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর দেশে সবচেয়ে বড় সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। সুতরাং 'মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস' পালনকারিরা ঐতিহাসিক জায়গায় কোনও রকম ইতিহাস বিকৃত করছেন বলার কোনও সুযোগ নেই। দুভার্গ্যজনক হলেও সত্য ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডগুলোর রহস্য উন্মোচন এবং হত্যাকারিদের বিচারের জন্য এখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সেসব হত্যা নিয়ে বিভিন্ন মহল নিজেদের মত নানারকম বক্তব্য প্রদান করে যাচ্ছে। অথচও হত্যাকাণ্ডগুলো পরিচালনাকারিরা অনেকে এখনো জীবিত এবং বহাল তবিয়তে রয়েছে বলে নানারকম প্রমাণ পাওয়া যায়।

৭ নভেম্বর সকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংগঠিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আদালতে মামলা ও কয়েকজনের গ্রেপ্তারের ঘটনা গত কয়েক বছর আগে ঘটলেও আসামীরা আবার প্রত্যেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। মামলাটিও অনেকটা চাপা পড়েছে বলে মনে হয়। ৭ নভেম্বর সবচেয়ে বড় যে হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হয় সেটি সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফ, এটি এম হায়দার ও সাব সেক্টর কমান্ডার খন্দকার নাজমুল হুদার। শেরে বাংলা নগরে ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে সকালে এই হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হয়। মূলত এই হত্যাকাণ্ড জিয়াউর রহমানকে এককভাবে সেনা নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করে। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা রকম মত ও বক্তব্য রয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের জন্য নির্দেশদাতা হিসেবে জিয়াউর রহমান, কর্নেল তাহের, মীর শওকত আলী এবং হত্যাকারী হিসেবে মেজর আসাদ ও মেজর জলিল নামে ২ জন অফিসার, উত্তেজিত সিপাহীদের কথা বলা হয় এবং এনিয়ে কিছু বিবরণও পাওয়া যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যতটুকু জানা যায়, এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেনাবাহিনী থেকে আজ পযন্ত কোনও কোর্ট অব ইনকোয়ারির ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আমি আমার ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সে সময়ে ১০ম বেঙ্গলে উপস্থিত থাকা কয়েকজনের সাথে আলাপ করে যেটি জানতে পেরেছি তাতে সে সময়ে ১০ম বেঙ্গলে ১২ জন অফিসার উপস্থিত ছিলেন বলে মনে হয়েছে।

উপস্থিত থাকা অফিসারগণ হলেন- ১. লে. কর্নেল নওয়াজেশ উদ্দীন (সিও ১০ম বেঙ্গল, পরবতীতে কর্নেল ও ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যাকাণ্ডের জন্য কোর্ট মার্শালে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেছেন) ২. লে. মুজিবুর রহমান (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম বিএমএর অফিসার, পরবর্তীতে মেজর, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যাকাণ্ডের জন্য কোর্ট মার্শালে মৃত্যুবরণ করেছেন) ৩. মেজর কাইউম (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সের অফিসার) ৪. কর্নেল সিরাজ ৫. ক্যাপ্টেন মোক্তাদির (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ওয়ার কোর্স বা সেকেন্ড এসএস-এর অফিসার, মেজর হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত) ৬. ক্যাপ্টেন আলম ফজলুর রহমান (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ওয়ার কোর্স বা সেকেন্ড এসএস-এর অফিসার, পরবতীতে সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল ও বিডিআর প্রধান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত) ৭. মেজর নাসির ৮. মেজর আসাদ (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সের অফিসার) ৯. মেজর জলিল (বাংলাদেশ সেনাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সের অফিসার) ১০. মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ বীর উত্তম ১১. কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা, বীর বিক্রম ও ১২. লে. কর্নেল এটিএম হায়দার, বীর উত্তম। এই অফিসারদের অধিকাংশ এখনো জীবিত। সুতরাং সরকার উদ্যোগ নিলে এ হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচন এবং হত্যাকারিদের বিচার করা খুব বেশি কঠিন নয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ নভেম্বরকে নানা মাত্রিকতায় মূল্যায়ন করা হয়। খালেদ মোশারফ সফলভাবে টিকে থাকলে কী হতো কর্নেল তাহের ও জাসদ সফল হলে কী হতো বিষয়গুলো শুধু অনুমান করা যায় মাত্র। ইতিহাসে কী হতো সে বিষয় নয়, কী হয়েছে, কেন হয়েছে সেই বিষয়ে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করা হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় ১৫ অগাস্ট ও ৩ নভেম্বরের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ৭ নভেম্বরের কারণে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করা কর্নেল তাহের ও জাসদ নেতাদের প্রহসনমূলক সামরিক আদালতের গোপন বিচারের বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টে রিভিউর মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে। এখন ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডগুলো বিশেষ করে জেনারেল খালেদ মোশারফ, লে. কর্নেল এটিএম হায়দার ও কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদার হত্যাকাণ্ডের বিচার করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হতে পারে ৭ নভেম্বরের সবচেয়ে সংবেদনশীল অধ্যায়টির গোপন রহস্যের। মীমাংসিত হতে পারে ইতিহাসের অনেক চাপা দিয়ে রাখা সত্যের। ৭ নভেম্বরকে মূল্যায়ন করতে গেলে সেদিনের হত্যাকাণ্ডগুলোকে কোনওভাবে আড়াল করা সম্ভব নয়। ইতিহাস ও জাতির কাছে ৭ নভেম্বরে হত্যার শিকার মুক্তিযোদ্ধাগণ এক জ্বলন্ত রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর রহস্য উন্মোচণের মধ্য দিয়ে ৭ নভেম্বরের মূল্যায়নের সকল ধরনের প্রতিবন্ধকতা খুলে যেতে পারে। ৭ নভেম্বরকে মূল্যায়ন করতে গেলে অবশ্যই সেদিনের হত্যার রহস্য উন্মোচিত হতে হবে। আর সেই রহস্য উন্মোচন ব্যতীত জাতির কাছে ৭ নভেম্বরের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

৭ নভেম্বর বাংলাদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার কলঙ্কিত ষড়যন্ত্রের দিন, বিশ্বাসঘাতকতার দিন, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টার দিন। যেভাবে মূল্যায়ন করা হোক না কেন সেটি কথার কথা থেকে যাবে, যদি সেদিনের হত্যাকাণ্ডগুলোর রহস্য উন্মোচন ও বিচারের ব্যবস্থা করা না হয়।