সংলাপে লাভ হলো কার?

স্বদেশ রায়
Published : 8 Nov 2018, 01:29 PM
Updated : 8 Nov 2018, 01:29 PM

এখন মনে হচ্ছে কোনওরূপ ছক না পেতে দাবার চালটি দিয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। তার হয়তো ধারণা ছিলো শেখ হাসিনা এ খেলায় অংশগ্রহণ করবেন না, তাতে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় জিতে যাবেন। কিন্তু দাবার চালটি দেখেই ছক পেতে খেলতে বসে গেলেন শেখ হাসিনা। এক তারিখ থেকে সাত তারিখ পর্যন্ত যে খেলা হলো তার নাম সংলাপ। এই সংলাপ এখন শেষ। শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ওবায়দুল কাদের বলে দিয়েছেন আর সংলাপ হবে না। শেখ হাসিনাও বলেছেন, সংলাপ শেষ, এখন কোনও সমস্যা হলে আলোচনা করতে আসতে পারেন।

সংলাপ যখন শেষ হয়ে গেছে তখন স্বাভাবিকই এখন হিসাব-নিকাশ করা যায়, এ সংলাপে লাভ হলো কার? এই হিসাব করতে গেলে প্রথমেই দেখতে হবে সংলাপ শেষে শেষ কথাটি কী বললেন ড. কামাল হোসেন। কারণ, সংলাপের অধ্যায়টি তিনি শুরু করেছিলেন। তিনি প্রথম সংলাপ চেয়ে শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছিলেন। তাই সংলাপ শেষে তিনি কী বলেন সেটা অনেক গুরুত্ব রাখে। সংলাপ শেষে সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল যা বলেছেন, তার সারকথা, 'বল এখন সরকারের কোর্টে।' বল সরকারের কোর্টে ফেলতে পেরেছেন ড. কামাল, না সরকার বল ড. কামালের কোর্টে ফেলে দিয়েছেন সরকার তা বিশ্লেষণের আগে দেখা যেতে পারে সংলাপের ভেতর দিয়ে কোন পক্ষ কী পেল?

৭ তারিখের সংলাপ শেষে রাতেই সংলাপোত্তর করণীয় নিয়ে বিএনপির মূল নেতারা তাদের গুলশান অফিসে আলোচনায় বসেছিলেন, সেখানে তাদের দলীয় করণীয় এর বাইরে যে বিষয়টি ঘুরে ফিরে এসেছে তা হলো, সরকার শান্তিপূর্ণ অবস্থার ভেতর দিয়ে ইলেকশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৩ তে তারা শান্তিপূর্ণ অবস্থার ভেতর দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেনি। দৃশ্যত, তাদের অনেকে বিষয়টি তাদের জন্যে পরাজয় মনে করলেও বাস্তবে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পোঁছাতে পারেননি।

বিএনপির সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বিষয়টি বিএনপির নিজস্ব বিষয়। তবে এখান থেকে যে সত্যটি বের হয়ে এসেছে তা হলো, সরকার এবার শান্তিপূর্ণ অবস্থার ভেতর দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর সরকারকে এই শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিতে অনেকখানি সাহায্য করেছে এই সংলাপ। এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা এমন একটি খেলায় অংশগ্রহণের জন্যে উদগ্রীব ছিলেন, না হয় তার হাতে বল তুলে দেয়া হয়েছে। আর যারা বল তুলে দিয়েছিলেন তারা ভাবতে পারেননি তিনি এতগুলো উইকেট নিয়ে নেবেন।

নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি তাদের নিজস্ব বাস্তবতায় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছে।  তারা তাদের কলেবর বাড়িয়েছে বলে মনে করছেন তাদের নেতারা। বাস্তবে পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা দেখার জন্যে এখনও সপ্তাহ দুয়েক অন্তত অপেক্ষা করতে হবে।  আগামী সপ্তাহ দুয়েকের ভেতর এই কলেবরে পরিবর্তন আসতেও পারে। তবে অপর দিকে যে বিষয়টি হলো, আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা তার জোট বাড়ানোর চেষ্টা করেননি। ইচ্ছে করলে তিনি বাড়াতে পারতেন, তিনি একটু ইঙ্গিত দিলে আ স ম আব্দুর রব ও কাদের সিদ্দিকী এ দিকেই থাকতেন।

শেখ হাসিনা সে প্রয়োজনীয়তা মনে করেননি। বরং তিনি তার মহাজোটকে আর না বাড়িয়ে মনোযোগী হলেন, কত বেশি দলকে এবার নির্বাচনের মাঠে আনা যায়। ২০১৩-তে শেখ হাসিনার সব থেকে বড় পরাজয় ছিলো, তিনি তার চৌদ্দ দলীয় জোটের বাইরে একমাত্র জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনতে পেরেছিলেন, তবে সেটা ছিলো অনেক টানা হেচড়ার বিষয়।

কারণ, এরশাদ ওইভাবে নির্বাচনে আসেননি। সে কারণে ২০১৩ এর নির্বাচনের শতভাগ আইনগত ভিত্তি থাকলেও এর জনভিত্তি  দৃশ্যমান নয়। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, জনভিত্তি দৃশ্যমান না হবার পরেও শেখ হাসিনা পাঁচ বছর সাফল্যের সঙ্গে সরকার চালালেন কি শুধু প্রশাসন দিয়ে! মোটেই তা নয়। কারণ বাংলাদেশের ৩০০ আসনেই আওয়ামী লীগ হারুক বা জিতুক তাদের ৪০ পারসেণ্টের ওপরে ভোট আছে। এই চল্লিশ পারসেন্টের ওপরের জনভিত্তিই আওয়ামী লীগ বা মহাজোট সরকারকে গত পাঁচ বছর সাফল্যের সঙ্গে টিকিয়ে রেখেছে। তাই যে কোনও ধরনের নির্বাচন করে যদি আইনগত ভিত্তি পান শেখ হাসিনা তাহলে তার নিজস্ব ক্যারিশমা ও জনভিত্তি সব মিলে সরকারে সাফল্যের সঙ্গে টিকে থাকা তার জন্য সমস্যা নয়। তার জন্যে যেটা বড় বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছিলো, তাহলো একটা জন অংশগ্রহণমূলক  নির্বাচনের ভেতর দিয়ে  ক্ষমতায় আসা। বিশেষ করে বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলেও যেন নির্বাচনটি জন অংশগ্রহনমূলক হয়, কোনও মতে ২০১৩ এর পুনরাবৃত্তি না হয়। এই সংলাপের ভেতর দিয়ে শেখ হাসিনার জন্যে সে সুযোগ এসেছে। বিশেষ করে ড. কামাল তার গণফোরামের পক্ষ থেকে সংলাপ চেয়ে চিঠি দিলে শেখ হাসিনা সংলাপটি আর একটি দল বা জোটের সঙ্গে সীমাবদ্ধ রাখেননি।

তিনি জানিয়ে দেন সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তিনি বসবেন। ১ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর এই সাতদিনে বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশনে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত সবকটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শেখ হাসিনা সংলাপে বসেছেন। সেখানে একমাত্র ড. কামালের নেতৃত্বাধীন ঐক্যজোট ছাড়া বাদবাকী সকলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে জানিয়েছে।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সংলাপের পরে এখন ড. কামালের ঐক্যজোট ছাড়া বাদবাকী সকলে নির্বাচনে যেতে রাজী।  তারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। অর্থাৎ ২০১৩ তে বিরোধী জোট যেটা পেরেছিলো অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মহাজোট ছাড়া সবাইকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে এবার সংলাপের ভেতর দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেলো, ড. কামালের নেতৃত্বাধীন ঐক্যজোট ছাড়া আর সকলে নির্বাচনে যাচ্ছে। ড. কামাল সংলাপ নামক এই দাবার চালটি দিয়েছিলেন, আর সেটাকে ছক পেতে খেলে শেখ হাসিনা এখন অনেকখানি ড. কামালকে একঘরে করে ফেলেছেন। কারণ সংলাপ শেষে অন্যতম একটি ফল হলো, একমাত্র ড. কামালের জোট ছাড়া বাদবাকী সকলে নির্বাচনে যাচ্ছে। আর তারা সকলেই সংবিধান মেনে নির্বাচনে যাচ্ছে।

এর বাইরে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন অসাংবিধানিক কিছু দাবিতে গোঁ ধরে বসে আছেন। যার দুটিই বিচার বিভাগের বিষয়। যেমন- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছেন ড. কামাল হোসেন। এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আদালতই বাতিল করেছে। তাই এখন এটা বহাল করতে গেলে সরকারই আইনগতভাবে বেকায়দায় পড়ে যাবে। ঠিক একই অবস্থা বেগম জিয়ার মুক্তির দাবি। বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের এক্তিয়ার। বেগম জিয়ার সাজা মাফ করার কোন ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের নেই। এখন বেগম জিয়া  কেবল ছাড়া পেতে পারেন, যদি তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে এভাবে আবেদন করেন যে, তিনি হাই কোর্টের রায় মেনে নিয়েছেন। উচ্চ আদালতে আর যাবেন না।

পাশাপাশি তার অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইলে-  রাষ্ট্রপতি যদি তাকে ক্ষমা করেন, তাহলে তিনি জেল থেকে বের হতে পারেন। এছাড়া সাজা মওকুফ করার এক্তিয়ার একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের। প্রধানমন্ত্রীর কিছু করার নেই। তারপরেও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল তার মুক্তি চাচ্ছেন এবং দুর্নীতির দায়ে সাজা প্রাপ্তকে রাজবন্দি বলছেন। অবশ্য তিনি যা মনে করেন তা বলার স্বাধীনতা তার আছে।

এখানে অবশ্য একটা বিষয় মনে করা দরকার, ড. কামাল এই জোট গঠন করে প্রথমেই বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন। ওই মতবিনিময় অনুষ্ঠানে কূটনীতিকরা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই জোট নির্বাচনে জিতলে প্রধানমন্ত্রী হবে কে? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তিনি কিন্তু বলেননি বেগম জিয়া হবে। কারণ তিনি জানেন, বেগম জিয়ার মুক্তি পাবার কোনও পথ নেই। তাই তিনি এখন রাজনীতির মাঠে যেটা বলছেন, সেটা সত্য না কূটনীতিকদের যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটাই সত্য- তাও একটা বড় প্রশ্ন। তবে কূটনীতিকদের কাছে বর্তমান সরকারের যে অনমনীয়তার কথা তিনি তুলে ধরেছিলেন, এখন সেই কূটনীতিকরাই দেখতে পাচ্ছেন, শেখ হাসিনা নমনীয়। তিনি সব দলের সঙ্গে সংলাপে বসেছেন। ড. কামালের সঙ্গে দুইবার বসেছেন। এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে একমাত্র ড. কামালের জোট ছাড়া আর সকলে একমত।

তাই হাসিনা ও কামালের বাইরে অন্য অবস্থান থেকে দেখলে এখন কি মনে হয় না বল এখন ড. কামালের কোর্টে। কারণ, শেখ হাসিনা জন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করে ফেলেছেন এই সংলাপের মাধ্যমে। এখন ড. কামালকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি তার জোট নিয়ে নির্বাচনে যাবেন কি যাবেন না? বলটি এখন বাস্তবে তাকেই খেলতে হবে। আর সেজন্য কোনও সংলাপ নয়। বরং তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি তার জোট নিয়ে কী করবেন?