আমাদের লেখালেখি

আনিসুর রহমান
Published : 7 Nov 2018, 01:56 PM
Updated : 7 Nov 2018, 01:56 PM

একবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, লেখালেখি মেধাবী মানুষের কাজ। রবীন্দ্রনাথের সময়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মেধার দিক দিয়ে সেরা। এখন মেধাবী ছেলেটার লক্ষ্য হল প্রকৌশলী হওয়া, নয়তো চিকিৎসক হওয়া। মেধাহীনদের কাছ থেকে তো মেধাবী লেখকের লেখা আশা করা যায় না। তিনি কথাগুলো বলেছিলেন আজ থেকে বছর পনের-ষোল আগে। এর মাঝে জামানা অনেকটাই পাল্টে গেছে। লেখালেখির চিত্রও বেমালুম বদলে গেছে।

তিন বছর আগে ২০১৫ সালে গোথেনবার্গ গ্রন্থমেলায় অনন্যা প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী মনিরুল হক আমাদের মনির ভাইয়ের সাথে আমাদের দেশের লেখালেখি ও প্রকাশনা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল। তিনি সুইডিশ আর্টস কাউন্সিলের ফেলোশিপ নিয়ে বইমেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। তিনি জানালেন প্রকাশনার বড় সঙ্কট হচ্ছে ভাল পাণ্ডুলিপির অভাব। বিশেষ করে কবিতার মানসম্মত পাণ্ডুলিপির বড়ই সঙ্কট।

এই যে প্রতি বছর শতশত কবিতার বই বের হচ্ছে, এগুলো কি?

তিনি দ্বি-রুক্তির মত করে বললেন, 'বের হচ্ছে'।

এর মাধ্যমে মৃদুভাষী মনির ভাই জানালেন-  এর থেকে আমরা যা বুঝে নেবার বুঝে নিই।

এর কাছাকাছি সময়ে আমাদের কবি রফিক আজাদ জানালেন, এই প্রজন্মের দুর্ভাগ্য তারা ভালো কোন সাহিত্য সম্পদক পেল না। এখানেও প্রশ্ন থাকে- তাহলে এই যে সপ্তাহান্তে প্রতি শুক্রবার পাতার পর পাতা সাহিত্যের কাগজ বের হচ্ছে, এইসব কি?

মনির ভাইয়ের শব্দ ধার করে বলাই যায় – 'বের হচ্ছে'।

একটা গল্প বলে নেই। ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকটায় আমি যখন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পার হচ্ছি তখন পরীক্ষায় নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নোত্তর পর্ব চালু হল। আর এই ব্যবস্থার ফলে প্রথম বিভাগ আর নক্ষত্রমানের হিড়িক পড়ে গেল। তখন প্রথম বিভাগে পাস করাটা বলার মত কিছু না। নক্ষত্রমান পেলে বলার মত। এই অবস্থায় এক  ছাত্রী তার নানীর বাড়িতে বেড়াতে গেছে। তার নানীর বাড়ির প্রতিবেশি আরেক মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছে- এই তুমি না মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলে?

-দিয়েছিলাম ।

-তা তোমার ফল কি?

-প্রথম বিভাগ।

-ভালই তো। তা তুমি জানাবে না?

-ভালই তো। আপনিও যে খবরটা শুনে খুব উৎফুল্ল তা কিন্তু মনে হল না।

এখন আমাদের শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকীই শেষ নয়। আরও আছে নানা উৎসব পার্বণে শত শত পাতার বিশেষ সংখ্যা, যেমন- ঈদসংখ্যা।

তাহলে ভাল পাণ্ডুলিপির সঙ্কট কেন?

সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা নাট্যনির্দেশক কামালউদ্দিন নীলু ভাই আমাকে বললেন- শুনো, আমাদের দেশে নাটক থিয়েটার বা ভাল নাটক কেমনে হবে? এই যে আমাদের নাটকের জগৎ যারা নিয়ন্ত্রণ করে- তারা দিনের সব কাজ, সব চাকরি, সব ব্যবসা, সব ঠিকাদারি সামলিয়ে তারপর নাটক করে। তখন শরীর আর মনের কতটুকু শক্তিই বা অবশিষ্ট থাকে। কথাটা সমূহ সত্য। এই সত্য আরও দৃষ্টিকটূভাবে আমাদের সামনে এসে পড়ে আমরা যখন দেখি আমাদের বাংলা একাডেমি নাটকে বিভাগে পুরস্কার দিতে হিমসিম খায়। কোনও কোনও বছর নাট্যকারই খুঁজে পায় না।

আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনের একজন নাট্যনির্দেশকের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপের সুযোগ হয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- তোমাদের দেশে নতুন নাটকের কী অবস্থা?

তিনি আমাকে জানালেন, কোন থিয়েটার কোন নতুন নাটক, নতুন নাট্যকার আর নতুন নাট্যনির্দেশক উপহার দিলো সেসবস নিয়ে প্রতিবছর ডাবলিনের থিয়েটারগুলোর মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। অন্যদিকে জর্জিয়ার শহর বাটুমিতে প্রতিবছর একটা নাট্য উৎসব হয়- নতুন নাট্যকার, নতুন নাটক, নতুন নাট্য নির্দেশক আর নতুন অভিনেতা নিয়ে। অভিজ্ঞ কুশীলবরা সেখানে উপদেষ্টার ভূমিকা নিতে পারবে কিন্তু সরাসরি অংশ নিতে পারবে না।

এবার আমাদের নিজেদের দিকে একটু নজর বোলাই। আমাদের খোদ ঢাকা শহরে থিয়েটার বলে কী আছে? ঐ শিল্পকলা? ওখানকার নাটকের মঞ্চ তো অন্য কাজেই ব্যতিব্যস্ত। সৃজনশীলতা একটা বাস্তবতা এবং একটা কার্যকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রযোজনা বেরিয়ে আসবে এটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের তরিকা না। তারপরও আমাদের যতটুকু আছে তাও আবার প্রতিষ্ঠিত মোড়লদের দখলে। এখানে কী হাওয়া থেকে নতুন নাটক ও নাট্যকার বেরিয়ে আসবে? তারপরও এ সমস্ত কর্মযজ্ঞের যে প্রণোদনার দরকার, যে নীতি দরকার সেটা কি আমাদের আছে? আমাদের খোদ সংস্কৃতিমন্ত্রী নাটকের মানুষ। আওয়ামী লীগ টানা দশ বছর ধরে ক্ষমতায়। এখন একটা সাদামাটা প্রশ্ন করি- উনারা নাটকের জন্যে কী রেখে গেলেন?

সরকারের অনেক সাফল্য আর উন্নয়নের ফিরিস্তির পরে যদি বলা যায় সবচেয়ে পেছনে পরে থাকা, অবহেলিত, আগোছালো আর  বিচ্ছিন্ন এক অপরিণামদর্শী এলাকা হচ্ছে সংস্কৃতি। এর যেন মাও নাই, বাপও নাই। আছে অপরিকল্পিত যতোসব থোক বরাদ্দ; যা  কর্পোরেট ঠিকাদারদের পোয়াবারো হওয়ার কাজে লাগছে। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কোনও আধুনিকায়ন হয় না, হতে পারে না।

যেখানে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে আসি। এই যে শতশত পাতা লেখা ছাপা হচ্ছে এসবের লেখক কারা? এর সঙ্গে একটা প্রশ্ন যোগ করে দিই- আমাদের দেশে কী পেশাদার লেখক আছেন? অথবা আমাদের দেশে লেখালেখিতে কী পেশাদার হওয়া সম্ভব?

আমার মতে, এই যে শত শত পৃষ্ঠা লেখা ছাপা হচ্ছে – এখানে পেশাদার বলে কেউ নাই। বাংলাদেশে পেশাদার লেখক বলে কাউকে খুঁজে পাওয়া এখন অসম্ভব। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো অর্থনৈতিক চরিত্র এবং সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের হর্তাকর্তাদের খাসলত সে পর্যায়ে উন্নীত হয় নি। যাদের লেখা ছাপা হয় তাদের বেশির ভাগ পদের ভারে যথাসম্ভব ভারী। একটা গল্প প্রচলিত আছে- কবি রফিক আজাদ বাংলা একাডেমির একটা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। একবার এক আমলা তার পদাধিকারের সূত্র ধরে রফিক ভাইয়ের কাছে কবিতা ছাপানোর আবদার নিয়ে হাজির। রফিক ভাই ওই কবিপ্রার্থী আমলাকে বললেন- 'আপনার বসের একটা লিখিত সুপারিশ লাগবে।'

এই গল্পের এখানেই সার।

সামরিক স্বৈরশাসকও কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। সে গল্প আমরা সকলেই কম বেশি জানি। তিনি ক্ষমতার দাপটে এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করলেন। কিন্তু ওসবে হয় না।

'সব শালাই কবি হতে চায়', চাইতেই পারে। কিন্তু কবি হওয়া যায় না। এমন কী সব কবিই কবি হতে পারেন না আখেরে। কবি হওয়ার জন্যে দরকার জীবনের সমান রক্ত। এখন সংক্ষিপ্ত কোনও পথ নাই। আমরা যারা সংক্ষিপ্ত পথের সন্ধানে আছি- সাহিত্য সম্পাদকদের কৃপায় পাতার পর পাতা জুড়ে কবিতা ছাপাচ্ছি, তাদের গন্তব্য কোথায়?

এ প্রসঙ্গে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ভাই একটা কথা বলেছেন, আমাদের তরুণরা স্বয়ম্ভূ হতে চায়। এখানে স্বয়ম্ভূ বলে কিছু নাই। মাটিতে পা নাই আকাশ ছুঁতে চায়। মনে রাখা দরকার আমাদের আগে শুধু দশক নয়, শতকের পর শতক জুড়ে কবিরা কবিতা লিখে গেছেন। আমাদের সেই ভিত্তির উপর দাঁড়াতে হবে, তবে না আকাশ।

আমাদের সাহিত্যের খেদমতগারদের প্রসঙ্গেও কিছু কথা না বলে পারছি না। নাসির উদ্দিনের সওগাত, বেগম কিংবা রনেশ দাশগুপ্ত অথবা আহসান হাবীবের হাতে গড়ে ওঠা সাহিত্য পাতা বা সাময়িকীর আধুনিকীকরণ কী করতে পেরেছে আমাদের হাল আমলের সাহিত্য কুশীলবরা? না শিখতে পেরেছেন? পদ ও পদবীর প্রটোকল সাজানো, বয়সের সীমা ধরে অগ্রাধিকার তালিকা আর পাতা সাজানোই সাহিত্য সম্পাদকের মূল যোগ্যতা না। এখানে উদ্ভাবন, আবিষ্কার, উদঘাটন, উপস্থাপন বলে একটা ব্যাপার থাকে। কর্পোরেট সিন্ডিকেট রক্ষা করা সাহিত্যের কাজ হতে পারে না। আসল প্রতিভার সন্ধান, নতুন লেখার খোঁজ আর তুলে ধরা সাহিত্য পাতার অন্যতম কাজ হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে সময়কে, সময়ের আনন্দ ও যন্ত্রণাকে নির্মোহভাবে প্রতিফলিত করা সাহিত্য সাময়িকীর কাজ। সেখানে কেরানিমার্কা সাহিত্য সম্পাদক আর কর্পোরেট মার্কা মূল সম্পাদক দিয়ে আর যাই হোক সাহিত্য হবে না। ব্যবসা হলেও হতে পারে। একজন সাহিত্য সম্পাদককে অবশ্যই লেখকের সঙ্গে কার্যকর পারস্পারিক শ্রদ্ধার যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।

একটা লেখা না ছাপলেও সাহিত্য সম্পাদকের সৎসাহস থাকতে হবে এবং লেখককে জানাতে হবে কেন তিনি লেখাটা ছাপতে অপারগ। তাতে লেখকের সুবিধা হবে বিশেষ করে নতুন লেখকের- কোথায় তার ঘাটতি। সাহিত্য সম্পাদকের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সে একমত নাও হতে পারে। এটা একটা সাহিত্যরীতি একই সঙ্গে সম্পাদকীয় রীতি। আমাদের সাহিত্য সম্পাদকেরা কয়জনে এই রীতি মেনে চলেন?

এবার আমাদের দেশে কী লেখালেখিতে পেশাদারিত্ব সম্ভব? এবার এই প্রশ্নটির উপর আলোকপাত করতে চাই। আমার জানা মতে, আহমদ ছফা ও হুমায়ূন আহমেদের পরে সেরকম পেশাদারিত্ব নিয়ে লেখালেখিতে কেউ টিকে নাই। কেউ  কেউ আছেন রুটিরুজির দায়ে অন্যকিছু  করেন। বাকি যতটুকু পারেন পেশাদারি দায় নিয়ে নিজের প্রতি সৎ থেকে লেখালেখিটুকু করেছেন, যেমন- হুমায়ুন আজাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো আরো অধ্যাপক আছেন যারা একই সঙ্গে লেখালেখিও করেন। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ আর হুমায়ূন আহমেদের মত পেশাদারি দায়টুকু নেননি। সেরকমভাবে রফিক আজাদ আর মহাদেব সাহার কথা বলা যায়। উনারা সাংবাদিকতা বা অন্য যাই কিছু করেন লেখালেখির দায়টুকু তারা সৎভাবে নিয়েছেন। নির্মলেন্দু গুণ ব্যতিক্রম অন্যভাবে- তিনি স্থির তার লেখালেখি আর কাশবন নিকেতনে। আরো ছিলেন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেকে। তারা একটা সময় পেয়েছিলেন বটে।

টি এস এলিয়ট লিখে গেছেন- যে সমাজ যে রকম তাদের ক্লাসিক সাহিত্য হবে সেরকম। ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর আমরা পেলাম একটা ভয়ঙ্কর জগাখিচুরি সময়। সামরিক স্বৈরাচারও কবি হতে চায়। এখন তো আরেক উপদ্রব কর্পোরেট লেখালেখির সঙ্গে, সাহিত্যের সঙ্গে- বিজ্ঞাপন আর ঠিকাদারি সংযোগ। সেই সঙ্গে পদের আপদ। বিচারপতি আর সচিব কবির কবিতা কি আমরা প্রথম পাতায় ছাপতে দেখি নি? কাকে কী বলবো? কোথায় যাব?

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাহিত্য বিভাগগুলো বিশেষ করে বাংলা বিভাগের কী হাল? আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরি- যতদূর জানি- বাংলা বিভাগ কখনই কোনও কবি বা লেখককে তাদের বিভাগে আমন্ত্রণ জানায় না। প্রকারান্তরে দেখেন সাংবাদিকতা বিভাগ বা বাণিজ্য অনুষদের বিভাগগুলো বিশেষ করে ব্যবসায় প্রশাসন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের বক্তৃতা বা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্যে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু বাংলা বিভাগের এত দৈন্যতা কেন? খোদ বাংলা বিভাগ যদি এত সংকীর্ণ মনের পরিচয় দেয়, আমাদের বড় মানের সাহিত্য পরিমণ্ডল গড়ে ওঠবে কীভাবে?

তবে শেষ কথা হলো, যিনি লেখালেখি করবেন-লেখক হবেন, তিনি নিজে জানবেন দায়টা কোথায় কতটুকু। তিনি এতকিছুর তোয়াক্কা না করে নিজের গরজে বেরিয়ে আসবেন। এমনটা ঘটেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। তবে জীবনটা বড় জুয়াখেলার মত হয়ে যায়। ধকলটা একটু বেশি। তবে লক্ষ্যটা স্থির রাখা চাই। লিখে যাওয়া ছাড়া, পড়ে যাওয়া ছাড়া- লেখকের সামনে বিকল্প খোলা নাই।