আসন্ন নির্বাচন: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রভাব কতটুকু ?

Published : 4 Nov 2018, 01:58 PM
Updated : 4 Nov 2018, 01:58 PM

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আবশ্যক, গণতন্ত্র আবশ্যক নয়। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) এর ৩২ বছরব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক, কিন্তু গণতান্ত্রিক স্বাধীনতায় প্রবৃদ্ধির উপর কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পরে। চীনের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। চীন একটা মুক্ত অর্থনীতির দেশ, কিন্তু মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশ নয়। চীনের সরকার অ-গণতান্ত্রিক হলেও স্থিতিশীল। এই কারণে চীনের প্রবৃদ্ধি বেশি ও স্থিতিশীল। শেখ হাসিনা সরকারের ১০ বছরে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পর্কে ভিন্নমত থাকতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সম্পর্কে কারো কোনও ভিন্নমত নেই।

এই কারণে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালার উপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে। এই আস্থা ও বিশ্বাস বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সবচেয়ে বোরো উপাদান। এই কারণে অনেক প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও দেশের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে।

বিষয়টি পরিসংখ্যানের আলোকে দেখা যাক. আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর  ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল  পর্যন্ত আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৫ থেকে ৫ দশমিক ৩ এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। এই সময়ে মাথাপিছু আয় ৬৫৬ ডলার থেকে ১০৩০ ডলারে উন্নীত।

দ্বিতীয় মেয়াদে  ২০১৪ থেকে  ২০১৮ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২ থেকে ৬ দশমিক ৩ এর মধ্যে রয়েছে। মাথাপিছু আয় ১৭৩৩ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ( প্রবৃদ্ধি আন্তর্জাতিক সূচকে ধরা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ক্রয়ক্ষমতার তুলনায় ধরা হলে, প্রবৃদ্ধি ৭ এর উপর হবে)

২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ভারতের প্রবৃদ্ধি আমাদের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু পরবর্তী ৫ বছরে ভারতের প্রবৃদ্ধি আমাদের প্রায় সমান ছিল।

তবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে বেশি এগিয়েছে। ভারতের মাথাপিছু যায় ২০০৮ সালে ছিল ১০৩৮, যা ২০১৮ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৩৬ ডলারে।

লক্ষণীয় যে ১০ বছরে ভারতের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে। আর কিন্তু আমাদের মাথাপিছু আয় ২ দশমিক ৬ গুণ বেড়েছে। (প্রবৃদ্ধির হার কম হয়েও মাথাপিছু আয় বেশি বৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণ আমাদের রেমিটেন্স বেড়েছে  আর জনসংখ্যা ভারতের তুলনায় কম হারে বেড়েছে। ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ আর বাংলাদেশের বৃদ্ধির হার ১ শতাংশ)

উপরের তথ্যগুলো বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে নেওয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক স্থিরতার উপর কোনো দেশের প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভর করে। বর্তমান সরকারের প্রথম ৫ বছরের তুলনায় দ্বিতীয় ৫ বছরের অর্থনৈতিক সাফল্য অনেক বেশি। অথচ বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বেশি হয়েছে।

সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিরতা বেড়েছে। এই কারণে প্রবৃদ্ধি প্রথম মেয়াদের চেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে বেশি বেড়েছে। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমাদের অর্থনীতি কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়লেও কয়েক মাস পরেই উন্নয়নের ধারায় গতিবেগ আসে।

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ৫০ বছর ধরে ১৬৯ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে। ফলাফলে দেখা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতায় উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হওয়ার কারণে  অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। স্থিতিশীলতা না থাকলে নীতিমালার কার্যকারিতার সময়কাল কমে যায়, সমষ্টিগত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কার্যকারিতা হ্রাস পায়। বারবার নিয়ম কানুন পাল্টালে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরিমাপ করা হয়, কতোবার মন্ত্রীসভা পরিবর্তন হয় তার উপর। সরকার পরিবর্তন হলে মন্ত্রিসভার পরিবর্তন হয়ই। একই সরকারের মধ্যেও  বারবার মন্ত্রী পাল্টানোও স্থিতিশীলতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। অধ্যাপক ও বিশিষ্ট গবেষক আলবার্তো এলিসিন ৩২ বছর ১১৩ টি দেশের অর্থনৈতিক ডাটা সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন, যখনি যে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে তখন প্রবৃদ্ধির হার ও বিনিয়োগ কমে গেছে। এলিসনের গবেষণায় দেখা গেছে, অস্থিতিশীল পরিবেশে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায় ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা করে যায়।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সূচক প্রতিবছর কমছে। Economist Intelligence Unit's (EIU) Democracy Index এর বাৎসরিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের সূচক ২০১৬ থেকে ২০১৭ এ ৫ দশমিক ৭৩ থেকে ৫৪৩ এসে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ এ এই সূচক ছিল ৬,২. পক্ষান্তরে সরকারের স্থিতিশীলতার সূচক ক্রমশ বাড়ছে। গণতন্ত্র কমে যাওয়া আর স্থিতিশীলতা বেড়ে যাওয়া প্রবৃদ্ধি বান্ধব। এই প্রক্রিয়া আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করেছে। (আমার ধারণা গণতন্ত্রের সূচক কমছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ও বিচার বিভাগের কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে, রাজনৈতিক কারণে ততটা নয়।)

যদিও বিশ্বব্যাংকের সূচকে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বাড়লেও অবস্থান এখনো অনেক নিচের দিকে। ব্যাংকার সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৭২ থেকে উন্নীত হয়ে ১৬৭ তম  স্থানে এসেছে।  এই সূচকের নির্ণায়কগুলির মধ্যে আছে রাজনৈতিক গেরেপ্তার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই নির্ণায়কগুলো বিবেচনা করা হয় না। বিনিয়োগকারীরা দেখেন, সরকার ও নীতি পাল্টানোর ঝুঁকি কতটুকু ইত্যাদি। বিরোধীদলের বিচার প্রক্রিয়া বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে না।

নির্বাচনকালীন সময়ে যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যায়। ২০১৬ মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালেও  পুঁজিবাজারের সূচক কমে যায়. যখনই ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে গেলো, পুঁজিবাজারের সূচক আবার বাড়তে থাকে। পুঁজিবাজারের সূচক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পারষ্পরিক সম্পর্কযুক্ত। পুঁজিবাজার কোনও ধরনের অনিশ্চয়তা পছন্দ করে না। যখন পর্যন্ত কি হবে না হবে পরিষ্কার বোঝা যায় না, তখন পর্যন্ত পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হয় না। ভালো বা খারাপ একটা কিছু নিশ্চিতভাবে হয়ে গেলে, পুঁজিবাজার তা মেনে নেয়। ট্রাম্প যেদিন থেকে নির্বাচিত হয়ে গেলো, তার পর থেকে বিনিয়োগকারীরা আবার মাঠে ফিরে এলো।

কোনও বিদেশি কোম্পানি যখন অন্য কোনও দেশে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করে, তখন তারা শুধুমাত্র আইএমএফ ও বড় বড় সংস্থার জরিপ ও বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করে না। প্রত্যেকটি কোম্পানি তাদের নিজস্ব গবেষণা করে। ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ মনে করছে। ডেনমার্কের চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশকে কমপক্ষে ১০ বছর স্থিতিশীল থাকবে মনে করে।

শেখ হাসিনা সরকারের ১০ বছর শাসনামলে বৈদেশিক বিনিয়োগ ৩ গুণ বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ৯৬১ মিলিয়ন দলের যা ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে বেড়ে দুই হাজার ৬০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগের অন্যতম শর্ত দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতিমালা। এই শর্তপূরণে সরকার সফল হয়েছে।

দেশে স্থিতিশীল সরকার থাকলে রেমিটেন্সও বাড়ে। এই কারণে জনশক্তি রপ্তানি কমে গেলেও বিগত বছরগুলো বিপুল পরিমাণে বাড়ছে। বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকমের রিপোর্টে দেখা যায়, গত অর্থ বছরের চেয়ে এই বছরে রেমিটেন্সের প্রবাহ শতকরা ১৭ ভাগ বেড়েছে।

দেশি ও বিদেশি কর্পোরেট মহলে আস্থা সৃষ্টি হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত স্থির ও চাপের মুখে কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয় না। এই আস্থা বিনিয়োগের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।

দীর্ঘ ১০ বছরে কোনো মন্ত্রীকে হঠাৎ করে বরখাস্ত করা হয়নি।  কোনও অঘটন ঘটলেও, কোনো মন্ত্রী পদ হারান নি। প্রধানমন্ত্রীর এই সহনশীলতা ও বিচক্ষণতা স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক হয়েছে।

মন্ত্রীসভা  ছোট না করার স্বপক্ষে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, তা যুক্তিসঙ্গত। সব মন্ত্রীর আওতাভুক্ত অনেক চলমান প্রকল্প আছে। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা ছোট করলে প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মাত্র দুই এক মাসের জন্য সরকার ছোট না করা উন্নয়নের জন্য ভালো হবে। সরকার মন্ত্রিপরিষদের সচিবকে অবসরে না পাঠিয়ে বহাল রেখেছেন, এটাও ভালো সিদ্ধান্ত।

বিলুপ্তপ্রায় বিরোধীদলগুলোর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন করার ক্ষমতা নেই। তারা নির্বাচনে যাক বা না যাক, তাতে সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক নীতিমালা পরিবর্তনের ঝুঁকি খুব কম. এই কারণে এই নির্বাচন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তেমনা  প্রভাব ফেলবে মনে হয় না।