সংলাপে খালেদার মুক্তিতে জোর দেয়নি বিএনপি নেতারা

স্বদেশ রায়
Published : 2 Nov 2018, 12:00 PM
Updated : 2 Nov 2018, 12:00 PM

সংলাপে বিএনপি নেতাদের মধ্যে বেশি কথা বলেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মওদুদ আহমেদ, খন্দকার মোশাররফ ও জমিরউদ্দিন সরকার। তারা কেউই খালেদার মুক্তির বিষয়টি নিয়ে তেমন জোর দিয়ে কথা বলতে পারেননি। তারা নিচু গলায় কথাটা তোলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বেশ স্পষ্ট করে বলেন, বিষয়টি আদালতের। এখানে তার কিছু করার নেই।

তারাও তার বিপক্ষে কোনও যুক্তি হাজির করতে পারেননি। বিশেষ করে এখানে মওদুদ আহমেদ ও জমিরউদ্দিন সরকারের খুব কিছু বলার নেই। কারণ, তারা দুজনেরই বেগম জিয়ার আইনজীবী ছিলেন। আইনজীবী হিসেবে তাদের যে বক্তব্য তা তারা কোর্টে দিয়েছেন। এখানে তাদের নতুন করে কিছু বলার ছিলনা। তাছাড়া একটা বিষয় হলো, কোর্টে বিশেষ করে ফৌজদারী মামলায় যুক্তির খাতিরে যুক্তি দেয়া যায়, কিন্তু সংলাপের টেবিলে বসে প্রকৃত সত্য বা যুক্তিযুক্ত কথা ছাড়া কেবল মাত্র আদালতে দেওয়া যুক্তির খাতিরে যুক্তি দেয়া যায় না।

এছাড়াও জমির উদ্দিন সরকারের রাজনীতির অতীত আছে, স্পিকার ছিলেন, সব মিলিয়ে তার পক্ষে সংলাপের টেবিলে বসে কোন অযৌক্তিক কথা বলা সম্ভব নয়। অন্যদিকে দেখা যায়, রাজনীতির ময়দানে মওদুদ আহমেদ যে বক্তব্যই দিন না কেন, আর নানান সময়ে নানান দল করুন না কেন, তিনি তার লেখা বই মোটামুটি সত্য এর কাছাকাছি রাখতে চান। যে কারণে দেশের প্রায় সকলে বলেন, বইয়ের লেখক মওদুদ আহমেদ আর রাজনীতির মওদুদ আহমেদ সম্পূর্ন ভিন্ন ব্যক্তি।

তাই সংলাপের মওদুদ আহমেদ আর রাজনীতির মাঠের মওদুদ আহমেদ যে ভিন্ন ব্যক্তি হবেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাকি থাকেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও খোন্দকার মোশাররফ হোসেন। বাস্তবে শেখ হাসিনার মত ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে, শেখ হাসিনার স্পষ্ট ও সত্য কথার উত্তরে এই দুজনের পক্ষে সম্ভব নয় মাঠে ঘাটে যে কথা বলেন সেটা শেখ হাসিনাকে বলা। তারা সেটা পারেননি।

যে কারণে সংলাপে যারা অংশ গ্রহন করেছিলেন তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেগম জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আদৌ গুরুত্ব পায়নি সংলাপে। আর পাবারও কোনও কারণ ছিলো না। যেহেতু ড. কামাল হোসেন বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে খালেদার মুক্তির বিষয়টি বিএনপি ও মান্নার ঘাড়ে ঠেলে দিয়েছেন। অবশ্য মান্নার ঘাড়ে ঠেলে দেবার আগে তিনি মান্নাকে ভিন্নভাবে চিহ্নিত করেও নিয়েছেন। জোট গঠনের পরের দিন সাংবাদিকরা যখন মাহমুদুর রহমান মান্না সম্পর্কে ড. কামাল হোসেনকে বলেন, মান্না তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাকে কীভাবে আপনি আপনার সঙ্গে রাখেন?

তার উত্তরে ড. কামাল বলেছিলেন, এটা যদি সত্যি হয় তাহলে তো মান্নার আমাদের সঙ্গে থাকার কথা নয়। ড. কামাল যে সস্ত্রাসের বিষয়ে দুধে ধোওয়া তা নয়। তিনি মোস্তফা মহসিন মন্টু, মান্না প্রমুখকে সঙ্গে রাখেন আবার নিজে সন্ত্রাস বিরোধী থাকেন। তার এ অবস্থানটা বাস্তবে শরৎ চন্দ্রের শ্রীকান্তের একটি বিশেষ চরিত্র টগর বোষ্টমীর মত। টগর বোষ্টমী জাতে বৈষ্ণব, ঘর ছেড়েছেন একজন নাপিতের সঙ্গে। এ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করলে টগর উত্তর দেয়, মিনসের সঙ্গে সতের বছর ঘর করলে কী হয় তাকে কোনদিন হেঁসেলে ( কিচেনে) ঢুকতে দেয়নি।

কামাল হোসেনের সন্ত্রাস বিরোধী অবস্থানটা অনেকটা টগর বোষ্টমির হেঁসেলের মত। টগর বোষ্টমী যেমন তার ভিন্ন কাস্টের স্বামীকে হেঁসেলে ঢুকতে না দিয়ে তার সঙ্গে সংসার করে বৈষ্ণব কাস্টটি বাঁচিয়ে রেখেছে। কামাল হোসেনও তেমনি চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে দল করে, জোট করে আবার তাদেরকে হেঁসেলের বাইরে রাখার চেষ্টা করেন। যাহোক, তিনি শুধু যে বিএনপি ও মান্নার ওপর খালেদার মুক্তির দাবি তোলার দায়িত্ব ঠেলে দেন তা নয়, সংলাপে যাবার আগে তার কাজের ভেতর দিয়ে তিনি প্রমান করেন, সংলাপে আর যাই হোক বেগম জিয়ার মুক্তির দাবি তিনি তুলবেন না।

তার প্রমাণ সিলেট ও চট্টগ্রামের জনসভায় তিনি তার বক্তৃতায় খালেদার মুক্তির চাননি। সিলেটে বক্তব্য রেখে যখন তিনি ফিরে আসেন তখন বিএনপি নেতারা তাকে বলেন, খালেদার মুক্তির দাবি জানাতে। তিনি তখন উত্তর দেন, ওর মুক্তির দাবি সাত দফায় আছে। চট্টগ্রামের জনসভার বক্তৃতায়ও তিনি খালেদার মুক্তির দাবি করেননি। বক্তব্য শেষ করলে মোস্তফা মহসিন মন্টু তাকে খালেদার মুক্তির কথা মনে করিয়ে দেন, তিনি বলেন ওর মুক্তি দাবি করার কি আছে, ওর ক্ষেত্রে তো বলতে হবে- মুক্তি হোক। ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যের বা বাক্যের অর্থ খুঁজে পাওয়া আসলে খুব কঠিন বিষয়। কারণ, উনি সব সময়ই দ্রৌপদী পাবার অর্জুনের মত লক্ষ্য ভেদ করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ তাকান একদিকে, তির ছোঁড়েন অন্যদিকে। তারপরে, তার লক্ষ্যভেদ যারা অনেক দিন থেকে দেখছে তারা এবারও বুঝতে পারেন সংলাপে খালেদার মুক্তির দাবি করবেন না ড. কামাল হোসেন।

তাছাড়া সংলাপে যাবার আগের দিন তিনি সেটা আরো পরিষ্কার করে দেন। মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদার মুক্তির দাবি ছাড়া সংলাপ অর্থহীন হবে। অন্যদিকে ড.কামাল হোসেন বলেন, দলীয় বিষয়ের থেকে জাতীয় বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে।

তাই সংলাপের আগেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, এ সংলাপে খালেদার মুক্তির বিষয়টি আদৌ গুরুত্ব পাবে না। তারপরেও অনেকে মনে করেছিলেন, বিএনপি নেতারা খালেদার মুক্তির বিষয়টিতে অনেক বেশি জোর দেবেন। কিন্তু তারা সেখানে তাদের পরিমিতি বোধের পরিচয় দিয়েছেন। তারা যে শুধু পরিমিতি বোধের পরিচয় দিয়েছেন তা নয়, তারা মেনে নিয়েছেন, দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সঙ্গে, সুষ্ঠু নির্বাণের সঙ্গে খালেদার মুক্তির বিষয়টি যোগ হতে পারে না। শুধু এখানেই শেষ নয়,তারেক রহমানের বিষয় কোন কথা উচ্চবাচ্য না করে, তারা এটাও প্রমাণ করেছেন কোন ভদ্রস্থ স্থানে বা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপের মত এতটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তারেক রহমানের নাম নেয়া উচিত নয়।

ড. কামাল হোসেন সংলাপের জন্যে চিঠি লেখার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেখ হাসিনা সংলাপে রাজি হয়ে যান। বলা যেতে পারে, অনেকটা এককভাবেই তিনি সংলাপে বসার সিদ্ধান্ত নেন। তার এ মতের সঙ্গে তার সিনিয়র নেতারাও একমত হন। দ্রুতই তাই সংলাপ হয়। এখন হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, ঝড়ের গতিতে সংলাপে বসলেও শেখ হাসিনা মিথ্যে অপবাদ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন। তার লাভের ঝুড়িও কম নয়।

তবে সার্বিক সব হিসেবে না গিয়েও অন্তত এটুকু হিসেব করা যায়, এতদিন খালেদার প্রতিটি মামলায় সাজা হবার পরে বিএনপি নেতারা বলছিলেন, এ রায় রাজনৈতিকভাবে দেয়া হচ্ছে। দেশের মানুষ অনেকইে মনে করছিলেন, শেখ হাসিনা হয়তো তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্যে খালেদাকে সাজা দিচ্ছেন। তিনি প্রভাব খাঁটিয়ে আদালতকে ব্যবহার করছেন। কিন্তু এই সংলাপের পরে নিশ্চয়ই আর দেশবাসীর মনে এই ধোঁয়াশা থাকবে না। কারণ, বিএনপি নেতারা রাজনৈতিক সংলাপে অর্থাৎ তাদের ভাষায় দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে সুষ্ঠু করতে ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যে সংলাপ করেছেন ওই সংলাপে তারা নিজেরাই বেগম জিয়ার মুক্তির বিষয়টিতে জোর দেননি।

অর্থাৎ তারা মেনে নিয়েছেন বিষয়টি আদালতের ও দুর্নীতির। এটাকে রাজনীতির মধ্যে টানার কোনও দরকার নেই। যেমন তারা যতই মুখে তারেক রহমানকে তাদের নেতা বলুক না কেন, সংলাপে তার নাম উচ্চারণ করেননি। কারণ তারা জানেন,সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রসঙ্গে আলোচনার সময়ে তারেক রহমান কোনও বিষয় হতে পারে না। তাই এতদিন তারা যে খালেদা ও তারেকের সাজার বিষয়গুলো রাজনৈতিক ও শেখ হাসিনার ইচ্ছেতে হচ্ছে বলে প্রচার করছিলেন- সংলাপের ভেতর দিয়ে তার পরিসমাপ্তি হলো।

শেখ হাসিনা ঝড়ের গতিতে সংলাপে বসে অন্তত আর কিছু না হোক, বিএনপি নেতাদের এই মিথ্যে অপবাদ থেকে মুক্তি পেলেন। পাশাপশি দেশবাসীও এখন নিশ্চিত হতে পারবে খালেদার সাজা কোনও রাজনৈতিক বিষয় নয়। এটা পুরোপুরি একটি দুর্নীতির বিষয়।