আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: ‘নগদ একটি ডাক বিভাগের সেবা’ এবং কিছু মৌলিক নীতিগত প্রশ্ন

খন্দকার সাখাওয়াত আলী
Published : 30 Oct 2018, 07:01 PM
Updated : 30 Oct 2018, 07:01 PM

বাংলাদেশ পোস্টাল অ্যাক্ট অনুসারে 'নগদ' কার্যক্রমটি ইতোমধ্যে সারাদেশে এই সেবা দেয়ার জন্য এজেন্ট নিয়োগ করছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ডাক বিভাগ তাদের এই নতুন আর্থিক সেবা আউটসোর্স করেছে। আউটসোর্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটির নাম থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস), ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে এই সেবা আসছে। ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (ডিএফএস) নামে 'নগদ' ডাক বিভাগের হয়ে একই ধরনের সেবা দেবে। যা নতুন নামের আড়ালে মূলত: একই ধরনের সেবা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে, এমএফএসের মাধ্যমে একজন গ্রাহক দিনে সর্বোচ্চ পনের হাজার টাকা ক্যাশ ইন ও দশ হাজার টাকা ক্যাশ আউট করতে পারে। অন্যদিকে নগদ দিনে আড়াই লাখ ক্যাশ ইন ও আড়াই লাখ টাকা ক্যাশ আউট করতে পারবে। কাজেই এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা ডাক বিভাগের ডিএফএস-এর নামে এমএফএস সেবা চালু করার বিষয়টি অসম প্রতিযোগিতা চালু হবে বলে মনে করেছেন। আর্থিক খাতের রেগুলেটর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকও ব্যাপারটা সর্ম্পকে উদ্বিগ্ন। আর এক দেশে আর্থিক খাতের একক রেগুলেশনের বাইরে একাধিক রেগুলেশন থাকার কোন সুযোগ নেই। এই পটভূমিতে 'নগদ' কার্যক্রম ঘিরে মানি লন্ডারিং ও টেররিস্ট ফিন্যান্সিংয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ প্রবন্ধে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টির ব্যাপারে কতিপয় মৌলিক নীতিগত প্রশ্ন আলোচিত হবে।

১. কেন এই লেখা?

আর্থিক খাতের সাথে প্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি নির্ভর সম্ভাবনা। ইতোমধ্যে এমএফএসের মাধ্যমে আর্থিক অনর্ভুক্তির ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে। দেখা দিচ্ছে নতুন সব সম্ভাবনার পাশাপাশি নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিশ্বের সাথে সমানতালে পা ফেলে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে বাংলাদেশের অগ্রগতি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চোখে পড়ার মত। বিদেশিরাও আমাদের অগ্রগতির ব্যাপারে ক্রমশই আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং এরই মধ্যে দেশে বড় ধরনের বিনিয়োগ আনতে সক্ষম হয়েছে।

আমার বিবেচনায়, ইতোমধ্যে আমরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রশ্নে তৃতীয় প্রজন্মের স্তরে প্রবেশ করেছি। ক্ষুদ্রঋণ ছিল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রথম প্রজন্ম। দ্বিতীয় প্রজন্মের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কৌশল ও মাধ্যম হল এমএফএস। এর পর এখন আমরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির তৃতীয় প্রজন্মের পথে হাঁটছি এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে, । তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাংকের ক্ষুদ্র আকারের প্রতিকৃত ধরনের সেবা।

দ্বিতীয় প্রজন্মের ক্ষেত্রে এমএফএস-এর সাফল্য উল্লেখযোগ্য। ইতোমধ্যে এমএফএসের প্রভাব, প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল সমাজের নানাস্তরের মানুষের মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। শুরুটা এমএফএস-এর গাইডলাইনের মাধ্যমে আরম্ভ হলেও, আট বৎসরের মাথায় সকল স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সম্প্রতি এমএফএস রেগুলেশান চূড়ান্ত করা গেছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক বোর্ড (অগাস্ট,২০১৮) ইতোমধ্যে তা অনুমোদন করেছে। যার ভিত্তিতে এ খাতের উন্নয়ন শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর সুযোগ তৈরি করা গেছে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের সেবাগুলো পরিচালিত হচ্ছে ব্যাংকের আওতায়। এই অর্জন ও সাফল্যের পেছনে রেগুলেটর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবশ্যই তার ক্ষেত্র বিশেষে কিছু সীমাবদ্ধতাসহ অভিনন্দন জানাবো।

আমাদের এতসব সাফল্যের পরও ঝুঁকির কমতি নেই। বিষয়টি সত্যিই ভাবিয়ে তোলে যখন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণায় সম্প্রতি বলা হচ্ছে, মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং। পত্রিকার এই হেড লাইনের পাশাপাশি যখন দেখতে পাই, 'নগদ' নামে বিকাশ ও রকেট এর মতো একটি সেবা ডাক বিভাগ চালু করতে যাচ্ছে যা সম্পূর্ণটাই এমএফএস ধরনের।

বিআইবিএমের এই গবেষণা পর্যবেক্ষণে আমাদের উদ্বেগ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, যখন সেবাটি একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কাছে আউট সোর্সিং করা হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রচার প্রচারণায় বিষয়টি 'ডাক বিভাগের একটি সেবা' কথাটি পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। এমএফএস এর মত এজেন্টদের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাবার কথা প্রচার করছে। বিষয়টি একজন গবেষক হিসেবে বোঝার লক্ষ্যে ও সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি ও এমএফএস খাতের উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, তারই নীতিগত একটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।

২. বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও ডাক সেবা
ডাক সেবা গোটা পৃথিবী জুড়ে অত্যন্ত পুরাতন একটি নাগরিক সেবা। আইনি কাঠামোর আওতায় প্রথম ১৬৩৫ সালে ইংল্যান্ডে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানের জন্য ডাক বিভাগ চালু হয়। পোস্ট অফিস ঐতিহাসিকভাবে দুই ধরনের নাগরিক সেবা গোড়া থেকেই বিশ্বময় ও আমাদের দেশে দিয়ে আসছে। প্রথমত, চিঠিপত্র আদান-প্রদান, পোস্ট অফিস বক্স, সরকারী স্টাম্প, পোস্ট অর্ডার অর্থাৎ ছোট ছোট পণ্য আনা নেওয়া ও স্টেশনারি কেনাবেচা ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত কাজটি করতো সড়ক কর সংগ্রহ ও আর্থিক সেবা প্রদান। সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, চলতি হিসাব, পোস্ট অফিস সার্টিফিকেট ও মানি অর্ডার করার কাজটি করতো।

প্রাচীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডাক বিভাগ একদিকে যেমন ক্রমাগতভাবে তার গুরুত্ব হারিয়েছে। অন্যদিকে তৃণমূল পর্যায়ে তার অবকাঠামোগত সুবিধাটি নতুনভাবে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টাগুলোকে সাধুবাদ জানাই। তবে বলাই বাহুল্য, এমন সব কর্মকাণ্ড ডাক বিভাগ কর্তৃক পরিচালনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হবে। বিশেষত বর্তমান বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিময় পৃথিবীতে। বাংলাদেশের ডাক বিভাগের প্রয়োজনীয় সেই সক্ষমতা ও দক্ষতা রয়েছে কিনা, থাকলে কতটুকু তার একটি নিরপেক্ষ একটি মূল্যায়ণ হওয়া দরকার এবং সেবাটি যখন তৃতীয় পক্ষের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, তখন ঝুঁকির মাত্রা বাড়ছে, তাও কর্তৃপক্ষকে যাচাই করে দেখতে হবে।

৩. বাংলাদেশ পোস্টাল অ্যাক্ট ২০১০
আমাদের এই উপমহাদেশে, পোস্ট অফিস আইন প্রথম হয় ১৮৬৮ সালে। পরবর্তীতে প্রথম এই আইন সময়োপযোগী বা আধুনিকায়ন করা হয় ১৮৬৯ সালে। যা পোস্ট অফিস অ্যাক্ট ১৮৯৮ নামে পরিচিত। দীর্ঘসময়ের ব্যবধানে ২০১০ সালে পূর্বতর আইনটিতে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়। পরিবর্তনকৃত ইস্যুগুলো নিচে তুলে ধরা হলো (১৮৯৮ সালের ৬ নং ভলিউমের ৪অ ধারার সংশোধনী- জানুয়ারী ২৮, ২০১০);

পোস্ট অফিসে মূলত জনস্বার্থ ও উন্নয়নে নিম্নোক্ত ডাক ও আর্থিক সেবার সুযোগ রাখা হয়েছে-

ক. জনগণকে দ্রুত সেবা পৌঁছে দিতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সেবায় পরিবর্তন, পুর্নবিন্যাস, নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং নতুন সেবার প্রচলন করতে পারে।

খ. চুক্তি এবং শর্ত সাপেক্ষে যে কোনও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কিংবা কোম্পানির নিকট সরঞ্জামাদি পৌঁছে দিতে এজেন্ট নিয়োগ করতে পারে।

গ. চুক্তি এবং শর্ত সাপেক্ষে যে কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কিংবা কোম্পানির নিকট পোস্ট অফিসের প্রাঙ্গন, কাউন্টার এবং অন্যান্য সেবা ভাড়া দিতে পারে।

ঘ. এই ধারার আওতায় বৈধ যেকোনও ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিতে পারে কিংবা এর নিজস্ব সেবার মানোন্নয়নে যে কোন বাণিজ্যিক সুবিধা ক্রয় করতে পারে।

ঙ. উপযুক্ত পোস্ট শপ, ই-কমার্স, অ্যাড্রেস ডেটাবেস কিংবা ডেটাবেসের মতো নতুন ব্যবসায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে কিংবা ব্যবসায়িক স্বার্থে অন্যান্য জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক সংস্থার সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন বিনিময় করতে পারে।

চ. পূর্বে উল্লেখিত সেবাসমূহ দিতে ব্যক্তি পর্যায়ে বা অন্যান্য কোম্পানির সাথে রেমিট্যান্স ট্রান্সফার সার্ভিসেস, ব্যাংকিং সেবা ও পোস্টাল জীবন বীমা সেবা প্রদান করতে পারবে।

উপরোক্ত ছয়টি ধারার কর্ম পরিধি আপাত দৃষ্টিতে ব্যাপক ও বিশাল। এই আইনের মাধ্যমে ডাক বিভাগ তাদের কর্মপরিধির মধ্যে তিনটি বড় ডাক, আর্থিক ও বীমা খাতে কাজের সুযোগ রেখেছে এবং ঐতিহাসিকভাবে এমন সব দায়িত্বও তারা পালন করেও আসছে। আইনের ধারাসমূহকে বিশ্লেষণ করলে আমরা নিন্মোক্ত পর্যবেক্ষণগুলো দেখতে পাই;

প্রথমত: ডাক সেবা পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি প্রচলন ও প্রয়োগের সুযোগ তাদের রয়েছে। এই সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হলে, দেশি ও বিদেশিদের ব্যাপকভাবে জানিয়ে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে অথবা যারা ইতোমধ্যে এখাতে তাদের সেবার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে তাদের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে, জনস্বার্থে এ সেবাটিকে সার্বিক পদ্ধতিগতভাবে ঝুঁকি মুক্ত করে পরিকল্পনাকৃত সেবাটি আরো নিখুঁত করা।

দ্বিতীয়ত: ব্যক্তিখাতের সাথে ডাক বিভাগের কাজের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে অবশ্যই বিষয়গুলো সম্পূর্ণভাবে বাজার শক্তির উপর নির্ভরশীল। কাজেই সেই বাজার শক্তিশালী ও পরিক্ষীত নিয়ন্ত্রন পদ্ধতির মধ্যে না এনে ছেড়ে দিয়ে কেমন হয় দেখার সুযোগ আর্থিক খাতে কাম্য নয়।

তৃতীয়ত: ব্যক্তি খাতের কোন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে ডাক বিভাগের অফিস প্রাঙ্গনে কাউন্টার ও সেবা ভাড়া দিতে পারে। অর্থাৎ সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়ে তারা ব্যক্তিখাতের সাথে ব্যবসা করার সুযোগ রেখেছে। অর্থাৎ দেশের আইন অনুযায়ী, বৈধ যে কোনও ব্যবসায়িক উদ্যোগ এবং সেবার মানোন্নয়নে যে কোন ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা ক্রয়ের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ করে। তবে অবশ্যই তা রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক স্বার্থে প্রতিযোগিতামূলক ও স্বচ্ছ হতে হবে।

চতুর্থত: ব্যক্তি পর্যায়ে সেবা দিতে অন্য ব্যক্তি খাতের সাথে যুক্ত হয়ে, ব্যাংকিং সেবা, রেমিট্যান্স ট্রান্সফার সার্ভিস, পোস্টাল জীবন বীমা ও অন্যান্য আর্থিক সেবা (পোস্টাল অর্ডার), সঞ্চয় সার্টিফিকেট, ইলেকট্রনিক মানি অর্ডার সার্ভিস ও পোস্টাল ক্যাশ কার্ড ইত্যাদি প্রদান করার সুযোগ রয়েছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে আরেক ধাপ আগাবার লক্ষ্যে ডাক বিভাগ কেন্দ্রিয় সেবা ও কার্যকর বিজিনেস কেইস স্টাডি গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ডাক বিভাগকে এই সমস্ত সকল জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানের সুযোগ দেওয়া হলেও বিগত আট বৎসরের, ডাক বিভাগ এই আইনি অনুমোদনকে কাজে লাগিয়ে জনস্বার্থে আদৌ কী কোনও কার্যক্রম ও অর্থবহ ডাক, আর্থিক ও বীমা সেবা ছড়িয়ে দিতে কতটুকু পেরেছে? এই না পারার কারণগুলো বোঝার পাশাপাশি, সাম্প্রতিককালের ডাক বিভাগের দুটি উদ্যোগকে জনস্বার্থের সংবেদনশীলতায় ও সাংগঠনিক সক্ষমতার বিচার মূল্যায়ণ করার প্রচেষ্টা নেব।

৪. 'লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়'
পোস্ট অফিস আমাদের নাগরিক জীবনে সাম্প্রতিককালে প্রায় অনুচ্চারিত। অথচ ঔপনিবেশিক ভারতে এক সময় ডাক বিভাগ ছিল সবচেয়ে নির্ভরশীল ও অপরিহার্য সেবা। নব্বইয়ের দশকে বাজার উদারীকরণের যুগে ব্যক্তিখাতে যোগাযোগ ও ডাক খাতে সেবা নিয়ে উপস্থিত হবার পর প্রাত্যাহিক জীবনে তাও যা সামনে ডাক সেবার প্রয়োজন হয় তা আমরা নিচ্ছি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে। এই বাস্তবতায় ব্যক্তিখাতের সাথে ব্যবসার একটি কৌশল আমরা দেখি এবং তা কতখানি সফল হবে তা নির্ভর করবে ডাক বিভাগের দক্ষতার উপর।

সাম্প্রতিককালে 'নগদ' বাজারে আসাকে কেন্দ্র করে পত্র-পত্রিকায় নানা প্রশ্ন ও আলোচনা উঠে এসেছে। এই পটভূমিতে, সামর্থের বিবেচনায় ডাক বিভাগ এ ধরনের আর্থিক সেবায় যুক্ত হওয়া কতখানি যৌক্তিক। 'নগদ' ব্র্যান্ডকে পরিচিত করতে গিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস নিয়ে এসেছে 'থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড'। প্রসঙ্গত, সাংবাদিকরা ডাক বিভাগের মহাপরিচালককে (ডিজি) এই সেবার আইনি কাঠামোর কথা জানতে চাইলে তিনি নগদের কাউন্টার থেকে বিষয়টা জেনে নিতে বলেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একটি ডাক বিভাগের সেবা হিসাবে যেহেতু এর পরিচয় করানো হচ্ছে, সেহেতেু, ডাক বিভাগের ডিজিকেই এ প্রশ্নে উত্তর আজ ও আগামীতে দিতে হবে।

এবার আসা যাক, নগদ কী কী সেবা নিয়ে আসছে? তাদের নিজেদের ভাষ্য অনুসারে তারা পাঁচ ধরনের সেবা দেবে গ্রাহকদের। প্রথমত, টাকা জমা করা যাবে; দ্বিতীয়ত, নগদ উদ্যোক্তা পয়েন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করা যাবে; তৃতীয়ত, টাকা পাঠানো যাবে যেকোনও মোবাইল নম্বরে; চতুর্থত, মোবাইল ব্যালেন্স রিচার্জ করা যাবে; পঞ্চমত ও শেষ, গ্রাহকদের সুবিধার্থে ভবিষ্যতে আরো অনেক সার্ভিস আসবে।

বোঝাই যাচ্ছে, প্রযুক্তিগত প্লাটফর্ম হিসাবে এক্ষেত্রে এমএফএসের মতো মোবাইল ফোনকে ব্যবহার করা হবে। নগদ তাদের প্রচারপত্রে ব্যবহারের রীতি সম্পর্কে তাদের ভাষ্য অনুসারে চারটি মাধ্যমে এই সেবা ব্যবহার করা যাবে। এ চারটি প্রযুক্তি মাধ্যম বা উপায়গুলো যথাক্রমে- ইউএসএসডি, অ্যাপ, কিউআরকোড ও কার্ড (অর্থাৎ নগদ কার্ড)।

'নগদ' এর আইনি ও ব্যবসায়িক পরিচিতির ভিত্তিটা হলো- বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি এর মাধ্যমে মুনাফা ভাগাভাগির ভিত্তিতে এই সেবা পরিচালিত হবে। যেহেতু এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতার বাইরে একটি সেবা, তাই এই সেবার মূল চ্যালেঞ্জ হলে, রেগুলেটারি কাঠামোর অনুপস্থিতিতে এমএফএস-ধরনের সেবা হওয়া স্বত্ত্বেও যে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা এমএফএস ব্যবস্থায় রয়েছে, এখানে তা রাখা হবে না। কাজেই যে কোনও ধরনের অনিয়মের রক্ষাকবচের নির্ভরশীলতা এ ব্যবস্থায় নেই।

তবে এ পর্যায়ে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, 'নগদ' এর আগে একই ডাক বিভাগের আওতায় 'ডাক টাকা' নামের একটি আর্থিক সেবার কথা গণমাধ্যমের বদৌলতে জানা যায়। যার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর আইটি উপদেষ্টা। ডাক টাকার অবস্থানটি স্পষ্ট যে এটি ডাক বিভাগের সেবাকে আধুনিকায়ন ও ডিজিটালাইজেশনের লক্ষ নিয়ে এগোচ্ছে। ডাক টাকার সঙ্গে নগদের পার্থক্য হচ্ছে, ডাক টাকার সেবা পোস্ট অফিস অঙ্গনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নগদ তার সেবা পোস্ট অফিস অঙ্গনের বাইরে এমএফএস-এর মত দেশের আনাচে-কানাচে ছোট ছোট দোকান পর্যন্ত এজেন্টদের মাধ্যমে করার পরিকল্পনা করছে। নগদের এই ডাক ঘরের এসে আর্থিক সেবা দেবার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের শঙ্কার কথা গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি।

কারণ প্রচলিত নীতিমালার চেয়ে বেশি পরিমাণে লেনদেনের সীমা নিয়ে 'নগদ' তার যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে, যা বিগত আট বৎসর ধরে গড়ে ওঠা এমএফএস খাতের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ার জন্য যথেষ্ঠ। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এই সেবায় মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি দেখছেন। আর তার প্রতিষেধক হিসেবে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নগদের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে। ডাক বিভাগ সরকারের একটি বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান হিসাবে, কখনই সরকারে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মূল অর্জনের ব্যাপারে নিশ্চয়ই কোনও ক্ষতিকর বা নেতিবাচক ভূমিকায় নেবেন না। বাংলাদেশ বিশ্বের ১৫৭টি ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটসহ যে এগ্রিমেন্ট গ্রুপের অংশ, তাদের মানদণ্ডে নগদ এর ভূমিকা কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা ভেবে দেখতে হবে।

বাংলাদেশ পোস্টাল অ্যাক্টকে মাথায় রেখে ডাক বিভাগের এই আর্থিক সেবা বাজারে আনার আগে নীতি নির্ধারকদের পরবর্তীতে অংশটি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে অনুরোধ করবো। অন্যথায় লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

৫. নীতি নির্ধারকদের জন্য কতিপয় প্রশ্ন
প্রবন্ধের এই অংশে 'নগদ' এর সেবাকে ঘিরে আমার কতিপয় নীতিগত প্রশ্ন নীতি- নির্ধারকদের বিবেচনার জন্য তুলে ধরবো:

এক. 'নগদ' যদি এমএফএস এর মত সেবা চালু করতে চায় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কেন লাইসেন্সের জন্য আবেদন করছে না? 'নগদ' বলছে তারা এমএফএস সেবা করেন না, বরং তারা ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (ডিএফএস) করেন। কিন্তু, এমএফএস এবং ডিএফএসের মধ্যে তো আদৌ কোনও পার্থক্য নেই।

দুই. বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের ডাক বিভাগ নিজ নিজ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যাংকের জন্য আবেদন করে। কিন্তু উভয় দেশের অর্থ-মন্ত্রণালয় তাদের সেই অনুমোদন দেয়নি। ভারত পরবর্তীতে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রনাধীন পেমেন্ট ব্যাংক মডেলের ডাক বিভাগকে পেমেন্ট ব্যাংক চালু করার অনুমতি দেয়। যেখানে ডাক ঘরের ভিতরে, ডাক বিভাগের কর্মী এই সেবা দিয়ে থাকেন। এই পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে ডাক বিভাগ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এমএফএস ধরনের সেবা প্রদানে কতটুকু সামর্থ্য রাখে? নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিষয়টি বিচারের দাবি রাখে।

তিন. যে কোনও দেশে যেখানে আর্থিক রেগুলেটর কেবলমাত্র একটি, এবং বাংলাদেশে ক্ষেত্রে এই রেগুলেটর অবশ্য কেবল বাংলাদেশ ব্যাংক। এমএফএস কিংবা এমএফএস ধর্মী আর্থিক সেবাখাত কি অসম প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে দুটি কেন্দ্র দ্বারা পরিচালিত হবে? আর এ ধরনের প্রচেষ্টা কী এমএফএস খাতের সাফল্য ও সম্ভবনাকে নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয়? বিষয়টি ভাববার প্রয়োজন আছে।

চার. 'নগদ' বিষয়টি আলোচনার মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে তা হলো, এ ধরনের সেবা প্রচলনের আগে গভীরভাবে এর নানা খুঁটিনাটি দিকগুলো আরো গভীরভাবে ভাববার প্রয়োজন আছে কিনা? সেই সাথে যে বিষয়টি আমাদের সামনে এসেছে তা হলো, ডাক বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের কাজটি কে করবে?

পাঁচ. পোস্ট অফিস আইনের মাধ্যমে কি ডাক বিভাগের বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামো ও দক্ষতার উপর নির্ভর করে মানি লন্ডারিং ও টেররিস্ট ফাইন্যান্সিং রোধ করার প্রস্তুতি ও সামর্থ্য আছে কিনা? না থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ) কিভাবে তাদের সহায়তা করতে পারে।

ছয়. বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএফআইইউ ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানের যে এমএফএস-এর রেগুলেটরি শৃঙ্খলা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, এবং এর সাথে আর্থিক স্বচ্ছতার মানদণ্ডে একটি ভালো অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কি অর্জিত সাফল্যে ও শৃঙ্খলা ভাঙ্গতে হাতে ধরে পথ করে দেবে? যদি তা দেইও, তবে তা রাষ্ট্রীয় ও জনস্বার্থ উপেক্ষা করেছে কার স্বার্থে।

সাত. বাংলাদেশের যে কোনও নাগরিক কোনও ধরনের আর্থিক অনিয়মের শিকার হলে, তা নিরসনের শেষ ভরসা স্থল হবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক রেগুলেটর হিসেবে, ডাক বিভাগের 'নগদ'-এর ব্যাপারে সম্পৃক্ত না হবার সুযোগ কতটুকু! [বিষয়টি বিস্তারিত বোঝার জন্য দেখুন, Bangladesh Bank Order,1972, Incorporating all amendments there to upto March,2003,7.A(e),p-5]

আর্থিক সুশাসনের প্রশ্নে নীতি-নির্ধারকদের আমার এই কতিপয় প্রশ্নমালা বিবেচনায় নিতে অনুরোধ করবো। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাবার সুযোগ খুবই কম, আর্থিক সুশাসন ও জাতীয় নিরপক্তার প্রশ্নে।

৬. আইনি সমন্বয়ের প্রশ্ন
এ বিষয়ক সমগ্র আলোচনার সারাংশ করলে আমরা তিনটি বিষয় দেখি, যা নীতি-নির্ধারকদের সিদ্ধান্তের সাথে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত। সমন্বয় বিষয়ক ক্ষেত্রসমূহ নিচে তুলে ধরা হলো-

প্রথমত: ইতোমধ্যে বিষয়টি আমি বলেছি, ডাক বিভাগ তার আইনের আওতায় এমএফএস ধরনের আর্থিক সেবা যদি চালু করে তা হলে ডাক বিভাগের এই আর্থিক সেবার রেগুলেটর কে? প্রসঙ্গত, সংবাদকর্মীরা ডাক বিভাগের মহাপরিচালককে 'নগদে'র রেগুলেটরি সংস্থা কে?- এ জাতীয় প্রশ্ন করলে তিনি তার যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফএইইউ) এ ব্যাপারে দায়িত্ব নিয়ে, সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকদের এ প্রকৃত পরিস্থিতিটি জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনও পক্ষেরই নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই।

দ্বিতীয়ত: এমএফএস এর প্রচলিত নীতিমালার চেয়ে বেশি পরিমাণে আর্থিক লেনদেনের কারণে বাজার পর্যায়ে যে অসম প্রতিযোগিতা দেখা দেবে, তার ফলে মানি লন্ডারিং ও টেরোরিস্ট ফাইন্যান্সিং এর যে ঝুঁকি তৈরি হবে এর সামগ্রিকভাবে দেখভাল করার দায়িত্ব কার? কিন্তু আরো সুনির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন করলে আর্থিক সুশাসন তত্ত্বাবধানের দায়িত্বের ব্যাপারে সামগ্রিক আলোচনা থেকে যে বিষয়টি উঠে আসে তা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক, ডাক বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাঝে এ বিষয়ক আইনি সমন্বয়ে বেশ কিছু মৌলিক ব্যবধান আছে। আইনি এই ফারাকগুলো বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সমন্বয় করা জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হল এ বিষয়টি সমন্বয় করার দায়িত্ব কার? তাই কিভাবে আমরা এ সমস্যার সমাধান খুঁজবে তা ভাবতে হবে।

তৃতীয়ত: ডাক বিভাগকে যদি স্বাধীনভাবে এমএফএস ধরনের সেবা দেবার সুযোগ দেওয়া হয় তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক মুদ্রানীতিতে তার প্রতিফলন দেখা যাবে কিভাবে? এটি Bangladesh Bank Order 7A (e) ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থি যে কথা আগেও বলেছি। এক্ষেত্রে ডাক বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক সকল আইন ও নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে নতুন কোনও মডেলের মাধ্যমে, এই ধরনের সেবা দেওয়ার বিষয়টি অধিকতর যুক্তিযুক্ত কিনা?

এই তিন প্রশ্নের যথাযথ সমন্বয় ছাড়া এই সেবা চালু করা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। না তা ভালো হবে ডাক বিভাগের জন্য কিংবা তার অংশীদারদের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ-এর ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় এমএফএস খাতে যে শৃঙ্খলার ধারা তৈরি হয়েছে তা প্রথম দিন থেকেই ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে মাইক্রো-মেজো অর্থনীতির উপর। যার প্রভাব পড়বে সমাজের নিম্নস্তর থেকে শুরু করে সকল স্তরের জনগোষ্ঠীর উপর।

এই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে দ্রুত সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয়ের কাজে হাত দিতে হবে।

৭. সমন্বয় বিষয়ক তিনটি প্রশ্ন
ডাক বিভাগ 'নগদ' নামের এমএফএস ধরনের আর্থিক সেবাকে ঘিরে যেসব প্রশ্নগুলো উঠে আসছে তার ভিত্তিতে একটি সমন্বয়ের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা আজ দৃশ্যমান। এই সমন্বয়ের প্রশ্নের সাথে অর্থ মন্ত্রণালয়, ডাক বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা জরুরী। সম্প্রতি ভারতও ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতি আর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাকেও আমরা এ বিষয়ে নিতে পারি। বিষয়টি বাস্তবভিত্তিক সমাধানের লক্ষ্যে, সমন্বয় বিষয়ক তিনটি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকদের বিবেচনার জন্য নিচে তুলে ধরা হল:

এক. দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিকটি বিবেচনায় রেখে নির্বাচনের আগে কোনও ভাবেই এ ধরনের এ কার্যক্রম এমন সব ঝুঁকিসহ বাজারে যেন না আসে।

দুই. অর্থ মন্ত্রণালয় (আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ), বাংলাদেশ ব্যাংক, ডাক বিভাগ, বিএফআইইউ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করে দেওয়া। যারা নিম্নোক্ত টিওআর- এর ভিত্তিতে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে সমন্বয়ে দিকগুলো গভীরভাবে বিবেচনা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী রূপকল্প বা পথরেখা যেন নির্দেশনা থাকে।

তিন. এই কমিটির যে কাজ করবে, তার টিওআরের সম্ভাব্য তিনটি ইস্যু বা বিষয়;

ক. এমএফএস বিষয়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনের সাথে ডাক বিভাগের আইনের সমন্বয় করা। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে বিএফআইউর সহযোগিতা নেওয়া

খ. বাজারে যে অসম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে সমতা আনা এবং সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করা। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য অর্জনে ডাক বিভাগ ও তাদের সেবা যেন দ্রুত বাজারে আসতে পারে এবং এমএফএস-এর মূল অপারেটরদের কাছ থেকে এ বিষয়ে শোনার উদ্যোগ রাখা।

গ. বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইতোমধ্যে ব্যাংক লেইড মডেলে এমএফএস গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে ডাক বিভাগের এই সেবার ইন্টারঅপারেটাবিলিটি সুবিধা তৈরির পথের সুযোগটি ভাবতে হবে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ব্যাংক মডেল ও ডাক বিভাগের সাথে এমএফএস অপারেটরদের নিয়ে হাইব্রিড মডেল গড়ে তোলার সম্ভাব্যতা যাচাই করা। সেই সাথে এমএফএস-এর ক্যাশ ইন ও ক্যাশ আউট আর্থিক সীমাটি দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতার বিষয়টি বিবেচনা করা। এই আর্থিক সীমা যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা দরকার। এমএফএস বিষয় এই সিদ্বান্তটি অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজন্ব সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত হবে।

৮. শেষ কথা
শেষ কথা হিসেবে কেবল বলবো, আমার প্রবন্ধটি দুটো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে লেখা। প্রথমত, সঠিক প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে বাজারের সেবাটি আসার আগে দেশের অর্থনীতি ও জনস্বার্থে সেবাটিকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নীতি-নির্ধারকদের সহায়তা করা।

দ্বিতীয়ত, সম্ভাব্য সমাধানের একটি যুক্তিসঙ্গত ও শক্তিশালী সমাধান খুঁজে পেতে চিন্তা জোগানো। আশা করি, আমার সুপারিশগুলো জনস্বার্থে নীতি-নির্ধারকদের নজরে পড়বে এবং তারা বিষয়টির ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন।