আমাদের অর্থনীতি, আমাদের ধনকুবের

বিনয় দত্ত
Published : 30 Oct 2018, 03:53 PM
Updated : 30 Oct 2018, 03:53 PM

১.

ঢাকার দোহার উপজেলার উত্তর জয়পাড়া মিয়াপাড়া এলাকার মো. বাচ্চু ও সাথী আক্তারের দুই মাসের সন্তানের নাম মো.সায়েম। অর্থের অভাব তাদের সংসারে লেগেই ছিল। দুই মাসের সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য সাথী বাচ্চুকে দুধ আনতে বলেছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যায় বাচ্চু দুধ না নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। কারণ দিনমজুরের কাজ করে দুধের টাকা জোগাড় করতে পারেনি বাচ্চু। দুধ না পেয়ে সাথী প্রতিবেশিদের কাছে ধরনা দেন। যে করেই হোক বাচ্চাকে তো খাওয়াতে হবে। প্রতিবেশিরাও সহযোগিতা করলেন না। রাগে ক্ষোভে সাথী রাত ৮টার দিকে দুই মাসের সন্তানকে লবণ খাইয়ে দেন। লবণ খাওয়ানোর পর সায়েমের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সাথী নিজেই তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। পরবর্তীতে দায়িত্বরত চিকিৎসক শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন।

এটি এমন একটি ঘটনা যেটি অনেকের চোখে পড়েনি। এতো বড় বড় ইস্যুর ফাঁকে ঘটনাটি হয়তো কেউই দেখেনি। কিন্তু ঘটনাটি আমাকে কতটা আলোড়িত করেছে তা আমি বলে বুঝাতে পারবো না। একটি দুই মাসের বাচ্চাকে তার জন্মদাত্রী মা দুই খাওয়াতে না পেরে মুখে লবণ দিয়ে দিয়েছে। একজন মা কতটা অসহায় হলে এই কাজটা করেন। দারিদ্র একজন মাকে কতটা অসহায় করে তুললে এই চিত্র আমাদের সামনে ধরা দেয়? আর প্রতিবেশিরাও কেমন? একটি বাচ্চার জন্য তারা সহযোগিতা করল না? হতে পারে এর আড়ালে অন্যকিছু আছে কিন্তু সাথী তো একটা দুইমাসের বাচ্চার জন্য হাত পেতেছিল। নিজের বা বাচ্চুর খাবারের জন্য নয়।

সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮' অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশ চীনকে হারিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে হারিয়ে বাংলাদেশের এই অর্জন নিঃসন্দেহেই আনন্দের!

এই সংবাদটি আমাকে বেশ আনন্দ দিয়েছে। যেই দেশের নারীরা বিশ হাজার মজুরির জন্য মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমায় এবং সেখানে ভয়ানক নির্যাতন ও শ্লীলতাহানীর শিকার হয়ে ফিরে আসে, যে দেশে প্রবাসী শ্রমিকরা দিনরাত এক করে দেশে টাকা পাঠায় এবং কখনো কখনো তারা টাকার জন্য দেশে আসতে পারে না, সেই দেশের অতি ধনীর তালিকায় আমাদের ধনকুবেররা শীর্ষে অবস্থান করছে, আহ্‌ কি শান্তি! রিপোর্ট অনুযায়ী যাদের সম্পদ ৩ কোটি ডলার বা তার চেয়ে বেশি তাদেরকেই অতি ধনী বলা হয়েছে।

অতি ধনী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই অর্থাৎ বিশ্বে যত ধনী দেশ রয়েছে সেই তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। কিন্তু ব্যক্তি বিশেষে অতি ধনীর তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে। অর্থাৎ এইসব ধনীর প্রত্যেকেই ব্যক্তি বিশেষে ধনী এদের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ বা ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জন দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নয় বরং দ্রুত সময়ের মধ্যে।

আমার প্রশ্ন হলো, কী এমন আলাদিনের চেরাগ বা জাদুমন্ত্র তারা জানেন, যার মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে এইসব ধনী, অতি ধনী বা ধনকুবের বনে গিয়েছেন? সেই প্রক্রিয়ার খবর আমার জানা নেই। তবে এই তথ্যের পর সবাই যা আঁচ করছেন তা হলো, রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে এরা দ্রুত সময়ের মধ্যে এরা অতি ধনী হয়েছেন। তার মানে রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে কিছু মানুষ নিজেদের অবস্থান এতোই শক্তপোক্ত করেছেন যে, তারা ধনকুবের হতে বাধ্য হয়েছেন। এরচেয়ে শান্তির খবর আর কি হতে পারে।

২.

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন বলছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া অর্থ ধনকুবেরদের নিজেদেরই, কিন্তু সেই ব্যক্তি বা সেই ধনকুবের যে প্রক্রিয়ায় এই অর্থ অর্জন করেছেন তা কি সঠিক ছিল? যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে এই অর্থ দিয়ে আমাদের অর্থমন্ত্রী প্রায় দুই অর্থবছরের বাজেট তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু তা তো হলো না। সেই অর্থ বিদেশে নিরাপদে পৌঁছে গিয়েছে।

প্রতি বছর এতো এতো অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায় অথচ অর্থপাচার রোধে আমাদের ভূমিকা ভয়ানক হতাশাজনক। তারাই অর্থ পাচার করেন যাদের অর্থের আধিক্য অনেক বেশি থাকে, যাদের অর্থের উৎস সঠিক নয় অর্থাৎ যে প্রক্রিয়ায় তিনি অর্থ আয় করেছেন সেই প্রক্রিয়াটি সঠিক নয় এবং সেই ধনী দেশ ছেড়ে অন্য দেশে স্থায়ীভাবে আবাস গড়ার পরিকল্পনা করে রেখেছেন।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান 'অর্গান স্টেইনলি' তাদের জরিপে বলছে, অর্থ পাচারে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে আছে চীন। বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪ এ। ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান আছে দশের মধ্যে। মূলত বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদরা দেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিদেশে 'সেকেন্ড হোম' করেছেন। এদের মধ্যে কেউ অর্থ পাচার করেন গোটা পরিবার নিয়ে দেশ ত্যাগ করার জন্য, কেউ আবার নিজে অথবা সন্তানের নিরাপদে রাখার জন্য দেশ ত্যাগ করেন, কেউ আবার পুরো পরিবার পাঠিয়ে দিয়ে সন্তান বা নিজে দেশে থেকে ব্যবসার দেখভাল করেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের দারিদ্র্যহার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ দেশে এখনও দারিদ্র আছে। এই দারিদ্রের কারণেই দুই মাসের শিশু সন্তানের মুখে খাবার জোটে না। তার প্রাণ দারিদ্রতা কেড়ে নেয়। ধীরে ধীরে হয়তো দেশ থেকে দারিদ্রতা আক্ষরিকভাবে না হলেও কাগজে কলমে হয়তো উধাও হয়ে যাবে। একদিকে কাগজে কলমে দারিদ্রতা উধাও হবে অন্যদিকে বাস্তবিকভাবে ধনকুবেরের সংখ্যা বাড়বে।

৩.

যেকোনও ব্যক্তি একক প্রচেষ্টায় বা অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ধনী হতেই পারেন। তাতে কারো দ্বিমত থাকতে পারে বলে আমার মনে হয়না কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবে শুধু একশ্রেণির মানুষ অতি দ্রুত সময়ে ধনকুবের হওয়ার পরে দেশের টাকা বাইরে পাচার করবে এইটা বোধহয় বেশিই আপত্তিকর। বরং ক্ষেত্রবিশেষে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো নড়বড়ে করে দেওয়ার জন্য এদের ভূমিকা কম দায়ী নয়।

যে দেশে তরুণ মেধাবীরা দেশ ছেড়ে চলে যাবে শুধু অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে, যে দেশে দক্ষ মেধাশক্তির অভাবে বাংলাদেশে বিদেশি কর্মকর্তারা ২০০ কোটি ডলার পারিশ্রমিক হিসেবে নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে, সেই দেশে অতিধনীরা নিজেদের সকল উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে ফেলে তবে দেশে থাকে কি?

চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, নেপাল, থাইল্যান্ড বা জাপানের মতো দেশগুলো নিজেদের দক্ষ মেধাশক্তি তৈরি করে অন্য দেশ থেকে আয় করছে আর আমরা শ্রমশক্তি দিয়ে অন্য দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি। একটু ভালো করে ভেবে দেখুন কারা এগিয়ে? ওরা নাকি আমরা?

তার উপর আবার আমাদের দেশের ধনকুবেররা রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে যা উপার্জন করছে তাও বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে তাহলে আমাদের দেশের উন্নতি হবে কি করে? যদি ধনকুবেররা আয় করে দেশের কাজে বিনিয়োগ করতো, দেশের মেধাশক্তি তৈরিতে সহায়তা করতো তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ঘুরে যেত। সরকারের উচিত ধনকুবেরদের দেশে বিনিয়োগে বাধ্য করা এবং অর্থপাচার রোধ করা। তবেই দেশের অর্থনীতি আরো চাঙ্গা হবে।