ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু ও বাংলাদেশের একটি সীমান্তবর্তী গ্রামের প্রতিক্রিয়া

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 30 Oct 2018, 02:38 PM
Updated : 30 Oct 2018, 02:38 PM

সাদাকালো টেলিভিশনে কি ঠিকভাবে আগুন বোঝা যায়? তবুও আমরা অনেক মানুষ বসে ছিলাম টেলিভিশনের সামনে। আমাদের মিঞাবাজার লতিফুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে।স্কুলের শিক্ষকদের বসার রুম, যাকে আমরা লাইব্রেরি রুম বলতাম, সেখানের সাদাকালো টেলিভিশনটি মাঠে নিয়ে আসা হয়েছে। সামনে শিক্ষকরা আর এলাকার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি। আর পেছনে আমরা ছাত্ররা এবং এলাকার সাধারণ মানুষ। রয়েছেন বাজার করতে আসা কিছু মানুষও।

গোটা মাঠ জুড়ে সবার মুখে গাম্ভীর্য। আমরা বসেছি ইন্দিরা গান্ধীর শেষকৃত্যানুষ্ঠান দেখতে।আমরা যেখানে বসেছি সেখান থেকে ভারতীয় সীমান্ত মাত্র এক মাইল দূরে। ভারত এত কাছে, কিন্তু ঘটনা এত নিকটের নয়। পাড়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়ার মত গুজগুজানি কিংবা ফিসফিসানি নেই। সবার চোখ টেলিভিশনের মাধ্যমে সুদূর দিল্লীর দিকে।বাংলাদেশের স্বাধীনতার তের বছর পরও বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে ইন্দিরা গান্ধী কতটা জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়।

তখন বন্দুকের জোরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসে আছেন স্বৈরশাসক লে জে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনিও ইন্দিরাজীর শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠানে হাজির। অনেকটা সেই কারণেই হয়তো তৎকালে 'সাহেব বিবি গোলাম এর বাক্স' বলে পরিচিত বিটিভি ইন্দিরা গান্ধী'র শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠান সরাসরি প্রচার করেছিল।

রাজীব গান্ধীর মুখাগ্নি করা দিয়ে ইন্দিরাজীর শেষ বিদায়ের শুরু। দাউ দাউ অগ্নি শিখা এই মহাপ্রাণের শরীরকে অনন্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি। মাঝে মাঝে রাজীব গান্ধীকে দেখা যাচ্ছে। মায়ের বহ্নিমান চিতার চারপাশে ঘুরছেন। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকেও দু'একবার দেখা গেল। দিনটি ছিল ৩ নভেম্বর, ১৯৮৪। শেষকৃত্যের স্থানটি ছিল মহত্মা গান্ধীর  স্মৃতি সমাধিস্থল 'রাজঘাট' এর কাছে 'শক্তিস্থল' বলে একটি জায়গা। শেষ বিদায়ের আগে ইন্দিরার মরদেহ একটি কামানবাহী শকটে করে ঘুরে এসেছে 'তিনমূর্তি ভবন', যেখানে ইন্দিরা  জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন পিতা নেহরুর সান্নিধ্য এবং সেবায়।

টিভি দেখে আমরা এক ঘোর নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। পরদিন বাজারের একমাত্র পত্রিকার দোকানে ঝোলানো পত্রিকায় দেখলাম প্রধান সংবাদ ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে। তার ফুলে ছাওয়া মৃতদেহের একটি ছবি। কিন্তু কি আশ্চর্য যে আমার মনে হলো তার মুখ হাস্যোজ্জ্বল। একজন মানুষ মৃত্যুর সময় হাসতে পারেন অসীম সাহসী হলে অথবা হত্যাকারীদের ছেলেমানুষিকে ক্ষমার চোখে দেখলে। মিসেস গান্ধী হয়তো তাই করেছিলেন।

ইন্দিরা গান্ধী নিহত হয়েছিলেন তার শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে। দিনটি ছিল ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪। সকাল নয়টার দিকে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং বিকেল দুইটার দিকে তিনি মারা যান।সাব ইনসপেক্টর বিয়ন্ত সিং এবং কনস্টেবল সতবন্ত সিং তার উপর গুলি চালায় তাদের সার্ভিস রিভলবার এবং স্টেনগান থেকে। বিয়ন্ত সিং রিভলবার থেকে পাঁচ রাউন্ড গুলি করে প্রধানমন্ত্রীর তলপেটে।  সতবন্ত সিং তার স্টেনগানের ম্যাগাজিন খালি করে অনেকগুলো গুলি করে ইন্দিরাজীকে। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হননা একদমই কাছে থাকা  ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান। এই বিষয়টি সবসময়ই একটি বিরাট প্রশ্ন থেকে গেছে। ধাওয়ান নিজের পক্ষে যতই সাফাই গান না কেন!

যতদূর জানা যায়, সাব ইন্সপেক্টর বিয়ন্ত সিং এবং কনস্টেবল সতবন্ত সিং এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় কিছুদিন আগেই হয়ে যাওয়া 'অপারেশান ব্লু স্টার' এর প্রতিক্রিয়ায়। পাঞ্জাবের অমৃতসরে শিখদের পবিত্র স্বর্ণমন্দিয়ে অভিযান চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সেখানে সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছিলেন শিখ নেতা এবং  শিখদের ভাষায় 'সন্ত' জার্নাইল সিং ভিন্দ্রাওয়ালে এবং তার অনুসারীরা। তারা ছিলেন 'খালিস্তান' নামে স্বাধীন শিখভূমির প্রবক্তা।তাদের হাত থেকে স্বর্ণমন্দির মুক্ত করতে চলে অভিযান।  নিহত হয় ভিন্দ্রাওয়ালেসহ অনেক শিখ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য।

মিসেস গান্ধী উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছিলেন পাঞ্জাবে উগ্রপন্থা বিকাশ লাভ করছে। সেখানে বসবাসরত হিন্দু সংখ্যালঘু নাগরিক এবং ভিন্নমতাবলম্বী শিখরা আক্রান্ত। একজন পত্রিকার সম্পাদককে উন্মুক্ত রাস্তায় হত্যা করে উগ্রপন্থী শিখরা। রাস্তায় বাস থামিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদেরকে নামিয়ে নির্দয়ভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করে শিখ চরমপন্থীরা। আর এসবের কেন্দ্রে একটি নামই উঠে আসে, জার্নাইল সিং ভিন্দ্রাওয়ালে। তিনি একজন অতি ধর্মীয় শুদ্ধতায় বিশ্বাসী শিখ এবং 'খালিস্তান' নামে স্বাধীন শিখভূমির প্রবক্তা।

পাঞ্জাবে তখনও মুখ্যমন্ত্রী দরবারা সিং এর নেতৃত্বে কংগ্রেসের শাসন ছিল। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইন্দিরা সরকার মুখ্যমন্ত্রীকে অপসারণ করে সেখানে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করে। রাষ্ট্রপতিও ছিলেন একজন শিখ। তিনি জ্ঞানী জৈল সিং।

১৯৮৪ এর জুন মাসে 'অপারেশন ব্লু স্টার' এর অনুমতি দেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা। অনেকেই বলে থাকেন সামরিক পরিকল্পনাবিদরা প্রধানমন্ত্রীকে অপারেশনের ভয়াবহতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেননি। তারা কিছুটা আড়াল রেখেই প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছিলেন।  ইন্দিরাজী শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। অনেক প্রাণহানির সম্ভাবনা তাকে জানানো হলে তিনি হয়তো এই অপারেশন এর অনুমতি দিতেন না। শান্তিপূর্ণ কোনও বিকল্পের কথা ভাবতেন।কিন্তু 'ডিপ স্টেট' অনেক সময় অনেক কিছু নিজেদের মত করে সমাধা করে, যেখানে রাজনীতিবিদদের কিছু করার থাকেনা।

আবার অনেকে মনে করেন, ছোটছেলে সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তার অনেক সিদ্ধান্তই মানসম্মত হচ্ছিল না। 'অপারেশন ব্লু স্টার' এর অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও সেই বিষণ্ণতা, অস্থিরতা এবং অমনোযোগিতার প্রভাব ছিল।

বিমান চালনা এবং উড়ালপ্রিয় সঞ্জয় গান্ধী ইন্দিরার নিজ হাতে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে গড়ে উঠছিলেন। উনিশ শ আশি   সালে মায়ের ক্ষমতায় ফিরে আসার পেছনে তার বিরাট ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে পাস করে আসা এমপি-দের একটা বড় অংশকে বাছাই করেছিলেন সঞ্জয় গান্ধী। মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে ১৯৮০ সালের ২৩ জুন নিজের শখের বিমান চালাতে গিয়ে সঞ্জয় বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। ইন্দিরা গান্ধী দু'বার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেই ভগ্ন বিমানের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে ছিলেন। যেন এই ভগ্নস্তূপের  মধ্যে কোথাও তিনি সঞ্জয়কে খুঁজছেন।

সামরিক পরিকল্পনাবিদরা  প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছিলেন যে এই 'অপারেশন ব্লু স্টার' দুই ঘণ্টার মধ্যে শেষ হবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন এবং ভয়াবহ। প্রায় এক সপ্তাহ (১জুন থেকে ৮জুন) এই অপারেশন চলে। অপারেশন চলাকালে পাঞ্জাবে 'মিডিয়া ব্ল্যাকআউট' থাকায় তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা যায়নি। পরবর্তীতে  জানা যায় যে, অন্তত টানা চারদিন ভিন্দ্রাওয়ালের অনুসারীদের সাথে সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র সংঘর্ষ চলে। সরকারী হিসাব মতে, তিরাশি জন ভারতীয় সেনা এবং চারশ বিরানব্বই জন সিভিলিয়ান নিহত হন। অসরকারি তথ্য মোতাবেক মারা যায় কয়েক হাজার শিখ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েক শ  সদস্য। প্রচণ্ড কাঠামোগত ক্ষতি হয় স্বর্ণমন্দিরের, শিখরা যাকে ডাকেন 'হরমিন্দর সাহিব' বলে।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় পবিত্র 'আকাল তখত' এর, যা মোগল  রাজ সিংহাসন থেকেও এক ফুট উঁচু ভুমিতে তৈরি করা। যেখান থেকে যেকোনও বার্তা ঘোষিত হলে তা সকল শিখের জন্য মান্য করা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। সেই পবিত্র 'আকাল তখত' বা  মহাকালের আসনের ক্ষতি হয় সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক থেকে নিক্ষিপ্ত কামানের গোলায়। পবিত্র 'আকাল তখত' অপমানের প্রতিশোধ নিতেই এই হত্যাকাণ্ড চালায় দুই দেহরক্ষী, এমনটিই প্রাথমিকভাবে জানা যায়।

'অপারেশন ব্লু স্টার'-এর পর ইন্দিরাজীকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল যে তিনি যেন তার নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্য থেকে শিখদের সরিয়ে দেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী বিষয়টি আমলে নেননি। শিখরা তার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলুক, এটা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা চাননি।

ইন্দিরাজী তার ১নং সফদর জং রোডের বাড়ি থেকে ভেতরের রাস্তা দিয়ে ১নং আকবর রোডে তার অফিসে যাচ্ছিলেন। পেছনে ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান এবং আরও কয়েকজন স্টাফ। ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভ এর সাথে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা ছিল তার অফিসে। উস্তিনভ আয়ারল্যান্ডের একটি  প্রযোজনা সংস্থার পক্ষ থেকে এসেছিলেন। এই প্রযোজনা সংস্থাটি বিশ্বনেতাদের উপর একটি টেলিভিশন সিরিজ তৈরি করছিল।

ইন্দিরাজীর পরনে ছিল হাল্কা গোলাপি রঙের শাড়ি। ক্যামেরার সামনে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য কিছুটা মেকআপও নিয়েছিলেন তিনি। তার মাথায় ছাতা ধরে ছিলেন কনস্টেবল নারায়ণ সিং। কিন্তু তিনি ছিলেন কিছুটা অন্যমনস্ক। আগের দিন রাহুল এবং প্রিয়াঙ্কাকে স্কুলে নেওয়ার কারটি দুর্ঘটনায় পড়েছিল। তাই তিনি কিছুটা চিন্তিত ছিলেন। পথে তিনি তার একজন টি- অ্যাটেনডেন্টকে চায়ের ট্রলি ঠেলে নিয়ে যেতে দেখেন। তিনি তাকে আরেকটু ভাল এক সেট কাপ পিরিচ নিয়ে যেতে বলেন অতিথির জন্য।

কিন্তু অফিসে পৌঁছার আগেই প্রধানমন্ত্রীর ১নং সফদর জং রোডের বাসভবনের পেছনের গেইটের কাছেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। বর্তমানে সেখানে একটি কাঁচের স্থাপনা ভাস্কর্যের মাধ্যমে ইন্দিরা হত্যাকাণ্ডের আবহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেকোনও সংবেদনশীল মানুষ সেখানে দাঁড়ালে কেঁপে উঠবেন।

রাজীব ছিলেন তখন পশ্চিমবঙ্গে। তিনি দলীয় কাজে সেখানে ছিলেন। রামনগরে প্রথম জনসভায় বক্তৃতা করার পর তিনি কাঁথিতে দ্বিতীয় জনসভায় ছিলেন। সেখানে পুলিশ এর ওয়্যারলেস মারফত প্রণব মুখার্জি সাড়ে ৯টায় এ মেসেজ পান যে 'ইন্দিরা গান্ধী  গুলিবিদ্ধ। দ্রুত দিল্লী ফিরে আসুন'। প্রণব মুখার্জি বক্তৃতারত রাজীব গান্ধীকে ঘটনা জানিয়ে চিরকূট দেন এবং বাকি সব কাজ স্থগিত করে দিল্লী ফেরার জন্য পরামর্শ দেন।

জনসভা থেকে রাজীব পার্টির দেওয়া অ্যাম্বাসেডর গাড়ি বাদ দিয়ে কংগ্রেস নেতা গনি খান চৌধুরীর অনুরোধে তার মার্সিডিজে চড়ে বসেন। কারণ এতে দ্রুত পৌঁছানো যাবে। তিনি ড্রাইভারের পাশে বসে বিবিসি সংবাদ শোনার চেষ্টা করছিলেন। রাজীব গাড়িতে থাকা তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীকে জিজ্ঞেস করছিলেন যে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীরা যে বুলেট ব্যবহার করে তা কি খুব শক্তিশালী? নিরাপত্তা রক্ষী 'হ্যাঁ' সূচক জবাব দিলে তিনি পেছনের সিটে বসা  প্রণব মুখার্জি এবং গনি খান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠেন, "এই বুলেটই কি তাঁর প্রাপ্য ছিল!"

গাড়ি করে কোলাঘাট পাওয়ার স্টেশন পৌঁছে সেখানকার হেলি প্যাড থেকে একটি হেলিকপ্টারে করে কোলকাতা এয়ারপোর্ট এসে পৌঁছান তিনি। একটি সাধারণ ফ্লাইট বাতিল করে একটি বিশেষ  ফ্লাইটে রাজীবসহ আরও করেকজন রাজনৈতিক ব্যক্তির দিল্লী যাবার ব্যবস্থা করা হয়। বিমানটি কোলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে উড়াল দেয় বেলা ১ টা নাগাদ। বোয়িং ৭৩৭ এর সেই ফ্লাইটে মোট দশজন বিশেষ যাত্রী ছিলেন। রাজীব ছাড়াও তাঁদের মধ্যে ছিলেন, প্রণব মুখার্জি, গনি খান চৌধুরী, লোকসভার স্পীকার বলরাম ঝাকার, লোকসভা সেক্রেটারি জেনারেল সুভাষ কাশ্যপ, রাজ্যসভা সেক্রেটারি জেনারেল এস আগরওয়াল,পশ্চিমবঙ্গের গভর্ণর উমা শংকর দীক্ষিত এবং তার পুত্রবধূ শিলা দীক্ষিত।

রাজীব অস্থিরভাবে বিমানের আইল ধরে হাঁটছিলেন আর বারবারই ককপিটে গিয়ে গ্রাউন্ড থেকে কোনও খবর আছে কি না জানতে চাইছিলেন। অর্থাৎ মায়ের কথা জানতে চাচ্ছিলেন। বিমান চলার কিছুক্ষণ পরই রাজীব তার সহযাত্রীদের বলে উঠেন– সব শেষ।রাজীব শোকে স্তব্ধ, অন্যরা চুপ আর অঝোর ধারায় কাঁদছেন প্রণব মুখার্জি। রাজীব যখন বেলা প্রায় তিনটায় পৌঁছলেন তখন সত্যিই সব শেষ।

ইন্দিরাজী যখন গুলিবিদ্ধ হন তখন প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরের  অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেচারা ড্রাইভার একটু দূরে টং দোকানে পান খেতে গিয়েছিল। সে কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবেনি যে তাকে আহত প্রধানমন্ত্রীকে বহন করতে হবে। সোনিয়া গান্ধী অন্য একটি জীপে করে তার মাম্মীকে অল ইন্ডিয়া ইন্সিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে যান। ইন্দিরাজীর মাথা ছিল সোনিয়া গান্ধীর কোলে।

তুলনামূলক কাছেই ছিল 'রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতাল'। কিন্তু ইন্দিরাজীর সমস্ত মেডিক্যাল রেকর্ড ছিল AIIMS এ। এছাড়া জরুরী পরিস্থিতিতে তাকে সেখানেই নেওয়ার নিরাপত্তা নির্দেশনা আছে। তাই চার কিলোমিটার দূরে AIIMS এ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। অফিস যাওয়ার সময় বলে রাস্তা একটু ব্যস্ত থাকার পরও কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁরা সেখানে পৌঁছে যান। কিন্তু ডাক্তারদের শত চেষ্টায়ও তাকে বাঁচানো যায়নি। তার রক্তের গ্রুপ ছিল ও নেগেটিভ। AIIMS এর সংগ্রহে জরুরী প্রয়োজনে মিসেস গান্ধীর গ্রুপের তিন ব্যাগ রক্ত সবসময় রক্ষিত থাকতো। সেখানে  চল্লিশ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পরও প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে তিনি মারা যান।

ইন্দিরা গান্ধীর দিকে আততায়ীরা মোট তেত্রিশ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। ত্রিশ রাউন্ড গুলি তাকে বিদ্ধ করে। তেইশটি গুলি তার শরীর বিদ্ধ করে বের হয়ে যায়। আর সাতটি রয়ে যায় শরীরের ভিতরে।

ইতিমধ্যে আমাদের গ্রামে গুজব রটে যায় যে সীমান্তের ওপারে বিএসএফ ক্যাম্পে একজন শিখ সৈন্যকে হত্যা করেছে তাঁর সহকর্মী অন্য বিএসএফ সদস্যরা। ঘটনার সত্যাসত্য তখন যাচাই করা যায়নি। কিন্তু অনেক পরে আরও বড় হয়ে জেনেছি যে, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরের তিনদিন দিল্লীতে শিখ-বিরোধী দাঙ্গায় প্রায় চার হাজার শিখকে মেরে ফেলা হয়েছিল। সারা ভারত মিলে দাঙ্গায় নিহত শিখের সংখ্যা প্রায় আট হাজার। এর প্রতিক্রিয়ায় রাজীব গান্ধী বলেছিলেন, "বড় গাছ ধসে পড়লে মাটি একটু কাঁপবেই।" রাজীবের চরম আবেগতাড়িত, অগ্রহণযোগ্য এবং ঘৃণা ছড়ানো একটি উক্তি, যা তার সাথে মানানসই নয়।

অনেক দিন পর বাজারে শংকর দা'র সেলুনে চুল কাটার জন্য  বসে আছি। দেয়ালে সাঁটা রয়েছে পুরনো খবরের কাগজ। হঠাৎ নজরে পড়ল একটি খবর-"ইন্দিরা আম্মার জন্য অমিতাভের কান্না"। অমিতাভকে আমরা গ্রামের ছেলেরা পড়তাম 'আমিভাত'।  এত সুন্দর একখানি নাম আমাদের ব্রাত্য জীবনে খুব পরিচিত ছিলনা। তাই উচ্চারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ।অনেক পরে জেনেছি অমিতাভ বচ্চন ছিলেন রাজীব গান্ধীর বন্ধু। কংগ্রেস এর নীতিনির্ধারনী নেতাদের পরামর্শের পরও মূলতঃ অমিতাভের পরামর্শেই রাজীব দলের দায়িত্ব নেন এবং প্রধানমন্ত্রিত্বও গ্রহণ করেন।

অমিতাভ বচ্চনের বিরুদ্ধেও শিখ সম্প্রদায়ের কেউ কেউ ঘৃণা এবং দাঙ্গার উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ তোলেন। শিখদের অনেকেই বলেছেন ইন্দিরা গান্ধী যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে  হাসপাতালে, তখন অল ইন্ডিয়া ইন্সিটিউট অব  মেডিকেল সায়েন্স হাসপাতালের ক্যাম্পাসে জনতার উদ্দেশ্যে অমিতাভকে চিৎকার করতে শোনা যায় "খুন কা বদলা খুন সে লেঙ্গে"।অর্থাৎ "রক্তের বদলা রক্তেই নেব"।

অমিতাভ বচ্চন বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। দাঙ্গা উস্কে দেওয়ার অভিযোগে অমিতাভের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার আদালতে। লস অ্যাঞ্জেলস এর একটি আদালত অমিতাভের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে সমন জারি করেছে।

স্বাধীনতার পর পর ইন্দিরা আমাদের জীবনে একজন প্রাত্যহিক আলোচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যুদ্ধের কথা আসলেই তার কথা আসতো। তার মহানুভবতা, তার সহযোগিতা কৃতজ্ঞতার সাথে উচ্চারিত হতো। তাই হয়তো তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান টিভিতে দেখতে এত মানুষের ভিড় হয়েছিল।

মৃত্যুর ঠিক আগের দিন উড়িষ্যায় এক জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, "আজ আমি বেঁচে আছি। কাল আমি নাও থাকতে পারি। আমি অনেকদিন বেঁচে আছি। আমি আমার দেশের মানুষদের সেবা করতে পেরেছি, এটা আমার জন্য অনেক বড় সান্ত্বনা। আমি যদি মারা যাই, আমার রক্তের প্রতিটি ফোঁটা ভারতকে শক্তিশালী করবে।"

এটাই ছিল তার শেষ ভাষণ। ভারতের মানুষের সামনে তার কণ্ঠের শেষ অনুরণন। তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি মারা যেতে পারেন! মৃত্যু কি গোপনে রক্তের সাথে কথা বলে!

অনেক বছর পর আমি আবারো প্রবলভাবে নাড়া খেয়ে যাই যখন বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় সুস্মিতা সেনকে একজন বিচারক প্রশ্ন করেন, তার একটি ইচ্ছা পূর্ণ করার ক্ষমতা থাকলে তিনি কি করতেন? সুস্মিতা নির্দ্বিধায় জবাব দেন- আততায়ীর গুলিতে নিহত ইন্দিরা গান্ধীকে ফিরিয়ে আনা।

আহা এ যেন আমাদের সকলের ইচ্ছা। সুস্মিতা যদি সত্যিই  পারতেন ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনীকে ফিরিয়ে আনতে!