একজন শ্যামল কান্তির কান্না ও আইনের দেবীর অন্ধত্ব!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 26 Oct 2018, 11:14 AM
Updated : 26 Oct 2018, 11:14 AM

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল, আর নারায়ণগঞ্জের শ্যামল কান্তি চেয়েছিল অপমান আর লাঞ্ছনার বিচার। কবিতার অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। আর বাস্তবের শ্যামল কান্তি বিচার পায়নি!

হ্যাঁ বলছিলাম, নারায়ণগঞ্জের স্কুল শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তের কথা। জোট-ভোট, 'চরিত্রহীন' আর 'চরিত্রবান'-এর ডামাডোলে যার কথা আমরা ভুলে গেছি! ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে যাকে ২০১৬ সালের ১৩ মে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। ওই ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। পরে শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি। এ ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সাধারণ মানুষ তো বটেই মন্ত্রীরা পর্যন্ত সেলিম ওসমানের কঠোর সমালোচনা করেন।

এ ঘটনায় সেলিম ওসমান জড়িত কি না, সে বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তদন্তে সেলিম ওসমানের নাম উঠে আসে। অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা পাওয়ায় সেলিম ওসমান এবং অপুর বিরুদ্ধে জুডিশিয়াল প্রতিবেদন দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মতো উপাদান রয়েছে বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরাও আবেদন জানান। পক্ষান্তরে আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেন, শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে জনরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য ওই কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেলিম ওসমান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার কোনো উপাদান নাই বলে অব্যাহতি আবেদন জানানো হয়। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত সেলিম ওসমানকে অব্যাহতি দিয়ে অপর আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

অব্যাহতির বিষয়টি জানার পর নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত বলেছেন, সরকারের কাছে আমি সুষ্ঠু বিচার প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু আমি ন্যায়বিচার পাইনি।'

হতাশ-ক্ষুব্ধ শ্যামলকান্তি কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরও বলেছেন, 'সেলিম ওসমানের হাত তো লোহার মতো শক্ত। সে থাপ্পড় মারায় আমার কান ফেটে রক্ত বের হয়। আমি এখন কানে শুনতে পাই না। বিনা কারণে সে আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে। আজ তার বিচার পেলাম না। আমি এর বিচার ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দিলাম।'

কথা হলো, আমরা যদি সবাই সব বিচারের ভার 'ঈশ্বরের' হাতে ছেড়ে দিই তাহলে আর আইন-আদালত-বিচারকের প্রয়োজন কি?

এর আগে সেলিম ওসমান বিভিন্ন গণমাধ্যমে 'আল্লাহকে কটূক্তিকারীকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দিয়েছি' বলে দম্ভ প্রকাশ করেছিলেন। একজন এমপি অপ্রমাণিত কোনো অভিযোগে একজন শিক্ষকের ওপর হাত তুলতে পারেন কি? আর হাত তোলার পরও তিনি এমন বেকসুর খালাস পান কোন যুক্তিতে? সে কি কেবলই ক্ষমতাবান বলে?

উল্লেখ্য, শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের পর সে ঘটনা তদন্তের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সে কমিটি শিক্ষক শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার কোনো সত্যতা পায়নি। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটিও একই কথা বলেছিল।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এবং ভিডিওচিত্রে শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করানোর নির্দেশ দিতে দেখা যায় স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমানকে। সেলিম ওসমান সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির এমপি। তার ভাই শামীম ওসমান সরকারদলীয় এমপি এবং পরিবারটি দীর্ঘকাল ধরে সর্বোচ্চ ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট। সে জন্যই কি এমন দাপট দেখাতে পেরেছেন সেলিম ওসমান?

ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আইনের ঊর্ধ্বে থাকেন। দুর্বলরা বিচার পান না। শ্যামল কান্তিকে যারা প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করল, তাদের বিচার না হওয়াটা কি আইনের শাসন? এই কি গণতান্ত্রিক দেশ?

দুই.

একাত্তরে শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্র তানবীর হায়দার চৌধুরী আক্ষেপ করে 'শ্যামল কান্তি ভক্তের থেকে যাওয়া' শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলেন। ক্ষুব্ধ ও বেদনার্ত মন নিয়ে তানভীর লিখেছিলেন, 'কেন শ্যামল কান্তি ভক্ত রয়ে গেলেন? তিনি কি বুঝে উঠতে পারেননি যে যাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন, তারা কতটা প্রভাবশালী? তাদের ক্ষমতার নাগাল কত দূর?….উনি ঠিক সেই কারণেই শহর ছাড়েননি, যে কারণে ১৯৭১ সালে দেশ ছেড়ে যেতে পারেননি মুনীর চৌধুরী। সমূহ বিপদ জেনেও দেশেই থেকে গেছেন শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, ড. আলীম চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীসহ আরও অনেকে।'

তিনি আরও লিখেছেন, 'এই দেশে রমেল চাকমারা বেঘোরে মারা পড়বেন, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের উৎসব হবে, লেখকদের প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হবে, স্টক মার্কেট আর ব্যাংক থেকে জনগণের টাকা যথেচ্ছ লুটপাট হবে, শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করিয়েও পুরো সাধ না মেটাতে পেরে জেল খাটানো হবে। আর আমরা ভাববো, এ-ও তো মন্দের ভালো। আর যা হোক, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ তো অন্তত টিকে আছে। দেশ তো আমাদের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ!'

যিনি নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছেন, প্রকাশ্যে একজন প্রধান শিক্ষকের গায়ে হাত তুলেছেন, শত শত মানুষের সামনে কান ধরে ওঠবস করিয়েছেন, অপমান-লাঞ্ছনা-হয়রানি করেছেন, তার কোনো বিচার ও শাস্তি হবে না? তিনি কি ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থেকে যাবেন? উল্টো শ্যামল কান্তি লজ্জা-অপমান-হয়রানি-ভয় আর মিথ্যে মামলা নিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করবেন?

তিন

আমাদের দেশে আইন-আদালত-বিচার এসব নিয়ে কোনো রকম আলোচনা বা মন্তব্য করাটা অত্যন্ত ঝঁকিপূর্ণ। বিষয়টি জটিল এবং স্পর্শকাতর। সুলেখক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত নিজে বিচারক ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ছোট আদালত মানে হচ্ছে ছোটা এবং ছোটা। ছুটতে ছুটতে কালো ঘাম বেরিয়ে যাবে। তা সেই ছোট আদালতের পরে সেজ, মেজ কতো আদালত, বড় আদালতে পৌঁছে মামলার নিষ্পত্তি হতে হতে একটা জীবন বরবাদ হয়ে যায়। মামলার ঘাড়ে মামলা, আপিলের পিঠে আপিল। একবার এ-পক্ষ জেতে, ও-পক্ষ জেতে আরেকবার। ততোদিন সর্বনাশ হয়ে যায়। হয় অর্থনাশ, কর্মনাশ, ধর্মনাশ। এসব কথা অবশ্য আমরা সবাই জানি। আমরা আরো জানি যে মামলা করে কোনো লাভ হয় না। উত্তেজনা বাড়ে, রক্তচাপ বাড়ে, রক্তে শর্করা বাড়ে, হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়। এদিকে টাকা-পয়সা, ধনদৌলত, বাড়ি-জমি সব যায় মামলার গহ্বরে। গ্রামে-গঞ্জে এখনো কেউ কারো ওপরে ক্রুদ্ধ হলে অভিসম্পাত করেন- 'তোর ঘরে যেন মামলা ঢোকে।' ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন, এর চাইতে বড় অভিশাপ হয় না। তারপরও অবশ্য মামলা থেমে নেই। রাস্তাঘাটে যানজট, শিক্ষাকেন্দ্রে সেশনজটের চাইতে আদালতে মামলাজট এখনো অনেক বেশি!

চার.

'আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে'-এই আপ্ত বাক্যের কোনো ভিত্তি আমাদের দেশে অন্তত বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। আসলে আইন কখনোই তার নিজস্ব গতিতে চলে না। কারণ আইন নিজে 'চলতে' পারে না। আইনকে 'চালাতে' হয়। আইনকে 'চালান' একদল ক্ষমতাবান মানুষ। এই মানুষরা আবার অনেক ক্ষেত্রে পরিচালিত হন যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের দ্বারা। ফলে আমাদের দেশের আইন 'নিজে চলার' চাইতে 'চালানোর' ওপরই নির্ভরশীল বেশি।

যে নিজে 'চলতে' পারে না, যাকে 'চালাতে' হয়, সে 'কর্তার' ইচ্ছেয় 'কর্ম' করবে, এটাই স্বাভাবিক। আর কর্তার 'ইচ্ছে'কে যে পরিবর্তন করা সম্ভব একথা কে না জানে? 'তুষ্ট' করতে পারলে ঈশ্বরও ভক্তের অনুকূলেই 'রায়' দেন। কাজেই আইন নিজ গতিতে আপন নিয়মে সুষ্ঠুভাবে কখনোই চলে না। বাংলাদেশের মতো ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও লোভের 'দেবতার দেশে' তো নয়ই। কবির ভাষায়- এখানে বিচারের বাণী নীরবে নির্ভতে কাঁদে। এখানে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবই শুধু দেখা যায় না, একই আইনের প্রয়োগ একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতেও দেখা যায়। কখনো বা সম্পূর্ণ বিপরীত। এর কারণও অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রতীচ্য ধারণা অনুযায়ী আইনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী অন্ধ। তার চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা। যদিও তার হাতে তুলাদণ্ড রয়েছে, কিন্তু দেবীর চোখ বাঁধা বলে নিজের অসমতা অনেক সময় দেখতে পারেন না!

আমাদের দেশে 'আইনের দেবী'কে 'অন্ধ' করে রাখা হয়েছে। আর এই 'অন্ধ দেবী'কেই আমরা যুগ যুগ ধরে অন্ধভাবে পূজা করে এসেছি। কিন্তু এই 'দেবী'র বিচার বা বিবেচনার প্রসাদ পেয়ে সবাই সমানভাবে তুষ্ট হতে পারিনি। ইদানিং এ 'দেবী' সম্পর্কে 'পক্ষপাত' ও 'দলবাজি'র অভিযোগও জোরে-শোরেই উচ্চারিত হচ্ছে। মনে মনে তাই অনেকেই এই 'দেবী'র প্রতি বিরূপ। কিন্তু 'দেবী'র 'কোপানলে' পড়ার ভয়ে তা কেউ প্রকাশও করতে পারেন না। 'দেবীর' অবশ্য এটা বুঝতে না পারার কোনো কারণ নেই। তার মানে, আইনের 'অন্ধ দেবী'র সঙ্গে আমাদের একটা দূরত্ব কিন্তু রয়েছেই।

দেবীর চোখের 'কালো কাপড়টা' না খোলা পর্যন্ত আসলে এ বিরোধ মিমাংসার কোনো সহজ পথ নেই। আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, দেবী 'অন্ধভাবে' নয়, বরং 'চোখ মেলে' সব দেখুক। কালো পর্দা সরে যাক, দেবী দেখবার স্বাধীনতা অর্জন করুক। দেখে-শুনে-বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক। আমরাও দেবীর চোখ দুটিকে দেখি। প্রয়োজনে চোখে চোখ রেখে কথা বলি!