জামাল খাশুগজি হত্যা: সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ও ক্রাউন প্রিন্সের ভবিষ্যৎ

বিজন সরকার
Published : 24 Oct 2018, 02:12 PM
Updated : 24 Oct 2018, 02:12 PM

সৌদি আরব স্বীকার করেছে যে, সাংবাদিক জামাল খাশুগজিকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সৌদি আরবের কনসুলেট অফিসে। খাশুগজি কনসুলেটে গিয়েছিলেন ২ অক্টোবর। তুরস্কের তদন্তকারীর সূত্রে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, তা হলো কনসুলেটে যাওয়ার পরপরই তাকে হত্যা করা হয়।

খাশুগজি কনসুলেট গিয়েছিলেন নিজের বিয়ের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় দলিল পত্রের জন্য। তিনি কনসুলেটে প্রথম গিয়েছিলেন সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখে। তখন তাকে বলা হয়েছিল অক্টোবরের ২ তারিখ আসতে। ২ তারিখ তিনি তার তুর্কি-বাগদত্তাকে সাথে নিয়েছিলেন। খাশুগজি যখন কনসুলেটের ভিতরে গেলেন তখন বাইরে অপেক্ষারত ছিলেন বাগদত্তা।

কনসুলেটে প্রবেশের পর তিনি নিখোঁজ হন। সৌদি আরব দাবি করে আসছিল, যে খাশুগজি প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে কনসুলেট থেকে চলে গেছেন। কনসুলেটে খাশুগজির প্রবেশের ভিডিওচিত্র দেখা গেলেও বের হওয়ার ভিডিওচিত্র দেখা যায়নি।

১৮ দিন ধরে সৌদি আরব দাবি করে আসছিল, খাশুগজি কনসুলেটের পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে গেছেন। কিন্তু তার কোনো প্রমাণ দেশটি দিতে পারেনি।

তবে তুরস্কের তদন্তকারী দল একটি ভিডিও ফুটেজ হাতে পেয়েছে। সেখানে দেখা গেছে খাশুগজির মতো দেখতে একজন লোক কনসুলেটের পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে গেছেন। তার পরনে খাশুগজির ট্রাউজার, ব্লেজার ও সানগ্লাস। কেবল জুতাজোড়ায় অমিল ছিল। তুরস্ক গোয়েন্দারা পেছন দিক থেকে বের হয়ে যাওয়া মানুষটির তথ্য প্রকাশ করল। নাম মুস্তাফা আল-মাদানি। সৌদি আরব থেকে মিশনের দিন আগত ১৫ সদস্যের হিট স্কোয়াডের একজন। তার মুখের দাঁড়িগুলোও লাগানো। আল-মাদানীকে আনাই হয়েছিল নকল খাশুগজি বানানোর জন্য।

খাশুগজির হত্যা নিয়ে সারা বিশ্বে যখন তোলপাড়, প্রায় আঠার দিন পরে সৌদি আরব স্বীকার করল যে খাশুগজি কনসুলেটে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন তিনি। এমন হাস্যকর স্বীকারোক্তি নিয়ে সারা বিশ্ব আবারো ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৬০ বছরের বয়সের একজন মানুষের সাথে হাতাহাতি করতে কেন সৌদি আরব থেকে ১৫ জন সামরিক সদস্যকে আনতে হবে? কেন একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ আনতে হয়েছে হাতাহাতির জন্য? কেনই বা হাতাহাতির জন্য হাড় কাটার করাত সৌদি আরব থেকে সেই ১৫ জন সামরিক সদস্য সাথে করে নিয়ে এলো?  এসব প্রশ্নের উত্তর সৌদি আরবের কীভাবে দেবে?

যাহোক, বাধ্য হয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফক্স নিউজের সাক্ষাৎকারে স্বীকার করে নেন- 'খাশুগজিকে কনসুলেটে হত্যা করা হয়েছে।' তবে তার লাশ কোথায় তা নাকি সৌদি আরব জানে না!

কিন্তু তুর্কি পুলিশ প্রথম থেকেই দাবি করে আসছে যে জামাল খাশুগজিকে কনসুলেটে প্রবেশের পরপরই হত্যা করা হয়। প্রথমে শরীরে ইনজেকশন দেওয়া হয়। পরে হাতে আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়। তারপরে মাথা শিরশ্ছেদ করে শরীরকে টুকরো টুকরো করা হয়।

সৌদি আরবের মনগড়া তদন্ত রিপোর্টের প্রতি তুরস্ক ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান সংসদে বলেছেন জামাল খাশুগজির হত্যা পরিকল্পিত। তিনি দাবি করেন, জামাল খাশুগজি কনসুলেটে প্রবেশ করার আগ থেকে কনসুলেটের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

পশ্চিমা গণমাধ্যম ও আল জাজিরা থেকে জানা যায়, খাশুগজিকে হত্যার পর সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্সের একান্ত সহকারীকে চারবার ফোন করে মিশনের আপডেইট জানানো হয়। এমনকি খাশুগজিকে হত্যার আগে সৌদি আরব থেকে রাজকীয় আদালতের প্রাক্তন গণমাধ্যম উপদেষ্টা স্কাইপে তাকে গালিগালাজ করেন। এক পর্যায়ে ১৫ সদস্যের টিমকে শিরশ্ছেদ করার নির্দেশ দেন। এমন একটি অডিও বার্তা তুরস্কের প্রেসিডেন্টের হাতে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ স্বত্ত্বেও তিনি তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।

খাশুগজি আগাগোড়া সৌদি শাসকের সমালোচক। প্রথম দিকে তিনি সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের সমর্থক ছিলেন। কেবল সমর্থক নয়, তিনি ছিলেন সৌদি আরব শাসক গোষ্ঠীর 'ইনসাইডার'। কিংবা বলা যায়, খাশুগজি ছিলেন সৌদি শাসক শ্রেণীর 'ব্ল্যাক-বক্স'।

যখনই ক্রাউন প্রিন্স দুর্নীতির অভিযোগে গণগ্রেপ্তার শুরু করলেন এবং অর্থের বিনিময়ে কথিত দুর্নীতিবাজদের ছেড়ে দিলেন, সাধারণ মানুষের বাক স্বাধীনতা হরণ করতে থাকলেন, সমালোচকদের কারাগারে পুরতে থাকলেন, তখনই শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতা শুরু করেছিলেন জামাল খাশুগজি। তিনি নিজের সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরেই দেশ ত্যাগ করেছিলেন। লিখতে থাকলেন ওয়াশিংটন পোস্টে।

খাশুগজি জানতেন কনসুলেট অফিসেও তার বিপদ হতে পারে। সেজন্য তিনি কনসুলেটে যাওয়ার আগে তুর্কি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, তুর্কি প্রেসিডেন্টের বন্ধু ছিলেন খাশুগজি।

খাশুগজির হত্যার নির্দেশ দাতা হিসাবে বারবার ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের নামটি সামনে আসছে। যে ক্রাউন প্রিন্স সৌদি আরব তেল-নির্ভরশীলতা কমিয়ে প্রযুক্তি ও সেবা খাত নির্ভর হওয়ার জন্য বাইরের বিনিয়োগ, বিশেষ করে পশ্চিমা দুনিয়ার সহযোগিতার, প্রার্থী সেই ক্রাউন প্রিন্সের বিরুদ্ধেই হত্যার নির্দেশদাতা ভূমিকার অভিযোগ।

এমতাবস্থায় পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্কের চরম টানাপড়েন চলছে। সেই তালিকায়  কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়ামসহ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সকল দেশ। হোয়াইট হাউজ বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া চেষ্টা করলেও ক্যাপিটাল হিল সৌদি আরবের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবেই বলে ধারনা করা হচ্ছে। রিপাবলিকান সদস্যরা ট্রাম্পকে এড়িয়েই সৌদি আরবকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার কথা বলছেন। এমতাবস্থায় সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোনদিকে যাবে সেটি নিয়েই আমরা বিশ্লেষণ করব।

সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটি কৌশলগত। যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে দুই দেশের সম্পর্কটিকে কৌশলগত হিসাবেই বিবেচনা করে। সেই সম্পর্কটি কেবল দুটি প্রশাসনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। দুই দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে সেই সম্পর্কটি স্থান পায়নি। না পাওয়ারই কথা। সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবিক বোধের জায়গা থেকে বিচার করলে দুইটি দেশের মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। সময়ের পরিক্রমায় সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে কৌশলগত সম্পর্কটির চরিত্রতে বড় ধরনের রূপান্তর ঘটেছে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটিকে আগে অণু-বিশ্লেষণ করি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির বড় চালিকা শক্তি ছিল সৌদি আরবের তেল। যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থেই বিশ্বের অন্যতম তেলসমৃদ্ধ দেশটির সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করে।

সৌদি আরবে প্রথম তেল পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালে। তবে তেল উত্তোলন করার জন্য দেশটি সত্তর দশক পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল ছিল। আধুনিক সৌদির প্রথম রূপকার বাদশাহ ফয়সল তেল উত্তোলনের জন্য দেশীয় কোম্পানি গঠন করেন। ঠিক তখন থেকেই সৌদি আরবের অর্থনীতি রকেট গতিতে ছুটতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই সৌদি আরবের বড় তেল ক্রেতা ছিল।

তবে আজকের বাস্তবতা ভিন্ন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব থেকে তাদের চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ তেল আমদানি করে। যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছে করলে এই ৫ শতাংশ নিজের তেলক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করতে পারবে কিংবা অন্যান্য তেল রপ্তানিকারক দেশ থেকে সংগ্রহ করতে পারবে। ফলে খাশুগজির হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানদের কঠোর প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরব তেল অবরোধের যে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছে এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুই হবে না।

তবে এটি সত্য যে বিশ্বের ২৫ শতাংশ তেলের মালিক সৌদি আরব তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে একটি অস্থিরতা তৈরি করতে পারবে। পরিবর্তনশীল বাস্তবতা হচ্ছে সেটি করে সৌদি আরব আরও সঙ্কটে পড়বে। দেশটি বর্তমানে যে রাজনৈতিক সঙ্কটে রয়েছে, তেলের দাম বাড়াতে গেলেই রাজনৈতিকভাবে আরও বিপদে পড়বে। সৌদি আরব রাজপরিবারের একগুঁয়েমি ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বড় দেশগুলি সৌদি আরবের বিপরীতে অবস্থান করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের উপর সৌদি আরব তেল নিষেধাজ্ঞার ঘটনা আগে ঘটেনি বিষয়টি তা হয়। ইসরায়েলের সাথে সৌদি আরবের যুদ্ধের সময় সৌদি আরব ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের উপর তেলের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। পশ্চিমাগোষ্ঠী তেলের জন্য অনেক দেন-দরবার করেছিল, তেমন লাভ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে জ্বালানির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তখন সৌদি আরবের বাদশাহ ছিলেন ফয়সল। যুক্তরাষ্ট্র সেনা নিয়োগ করে জোর করে জ্বালানি নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেওয়ার পড়ে সৌদি আরব জ্বালানি দিতে বাধ্য হয়।

যাহোক, আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আবারো সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল।

ওয়ান ইলেভেনের পর সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আবারও তলানিতে চলে যায়। যে ১৯ জন সন্ত্রাসী টুইন টাওয়ারসহ পেন্টাগনে হামলা করেছিল তাদের মধ্যে ১৫ জনই সৌদি আরবের নাগরিক। তখন সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনায় দাবি জোরালো হয়ে উঠেছিল।

দুটি কারণে দুই দেশের প্রশাসনের ভিতরে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়নি। প্রথমত: হামলাতে সৌদি আরবের প্রশাসনের কোনও মদদের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে প্রশাসনের ভিতরে কতিপয় লোকের সায় ছিল এমনটি পশ্চিমা গোয়েন্দাদের ধারণা। সেই সময়টিতে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত বুশ পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার কারণে সৌদি আরবের অনেক কিছুই ধামাচাপা দিতে পেরেছিল।

এবার আসুন দেখি সামরিক সম্পর্কের প্যারামিটারে কে কার জন্য অপরিহার্য।

এই প্যারামিটারটি বিবেচনায় নেওয়ার ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষাপটটি মূল্যায়ন করতে হবে। সৌদি আরবের চার দশক আগের অবস্থান এবং বর্তমান অবস্থান এক নয়। চার দশক আগে সৌদি আরব তেল বিক্রি করে নিজের সম্পদ তৈরি করেছে। মুসলিম বিশ্বে ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ধর্ম প্রচারের আড়ালে উগ্র ওহাবিজম রপ্তানি করেছে। এই ওহাবিজমই বিশ্বব্যাপী আধুনিক সন্ত্রাসবাদের মূল উৎস।

আধুনিক সন্ত্রাসবাদের আদর্শিক কেন্দ্র হিসাবেই সৌদি আরব স্থান করে নিয়েছে। সমাজতন্ত্রকে ধর্মের পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদেরকে যুদ্ধে লিপ্ত করার উৎসাহ দিয়েছে সেই ওহাবিজম।

মূলত মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের প্রভাব বাড়তে থাকে সত্তর দশক থেকেই। তখন সৌদি আরবের সামনে তেমন কোনও চ্যালেঞ্জ ছিল না। সেই সময়ে ইরাক-ইরান যুদ্ধে লিপ্ত থাকলেও, কেবল ওয়াহিবিজমে পেট্রো ডলার ব্যয় করা ছাড়া সৌদি আরবের সামনে তেমন কোনও চ্যালেঞ্জ ছিল না।

আজ সৌদি আরবের চরম শত্রু ইরান, মুসলিম বিশ্বে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্ক।

ইরান দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় ছিল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় ইরান ছয় জাতির সাথে চুক্তি করে। এই চুক্তির আওতায় ইরান কয়েক দশক ধরে চলে আসা সকল নিষেধাজ্ঞা থেকে বের হয়ে আসে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ছয় জাতির চুক্তি থেকে সরে গেলেও বাকি পাঁচটি দেশ সরে যায়নি। সৌদি আরবের চাপে ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশ তড়িঘড়ি করেই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসে। ইরানের প্রভাব ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা গত কয়েক বছর ধরে দ্রুতই বাড়ছে।

সিরিয়াতে সৌদি আরবের চেয়ে ইরানের প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অধিকন্তু ইরান সৌদি আরব ব্লকের অনেক রাষ্ট্রের সাথেই ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। যে কাতার সৌদি আরবের সতীর্থ হয়ে ব্যাটিং করত, সেই কাতার এখন চরম শত্রু; সেই কাতার এখন ইরানের বন্ধু।

মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব বিস্তার নিয়ে শক্তিশালী তুর্কির সাথেও সৌদি আরবের রয়েছে চরম ঠাণ্ডা লড়াই। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিস্ট শক্তিশালী দেশগুলি সৌদি আরবের কথিত সামরিক জোট নেই।

আবার সৌদি আরবের নিজের প্রতিবেশী ইয়েমেনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। ইয়েমেনে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। এখন পর্যন্ত দশ হাজারের উপরে বেসামরিক মানুষ মারা গেছেন। ইয়েমেনের যুদ্ধ থেকে বের হয়ে যাওয়ার কোনও রাস্তাও সৌদি আরবের জানা নেই।

এখানে ছোট করে বলে রাখি, ইয়েমেনের যুদ্ধে সৌদি আরবের শোচনীয় পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রতিমাসে ইয়েমেনের যুদ্ধে সৌদি আরবের প্রতিমাসে খরচ চার থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার।

এমতাবস্থায় এটি সহজেই বলা যায়, পাঁচ দশক আগের সৌদি ও বর্তমান সৌদি এক নয়। দেশটি এখন বহুমাত্রিক সমস্যায় রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি এখন সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি না করে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির চেয়ে সৌদি আরবের ক্ষতিই বেশি। সৌদি আরব ইচ্ছে করলেই এত অল্প সময় মধ্যে অন্য কোথাও থেকে শত বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনতে পারবে না।

তাছাড়া আমেরিকার অস্ত্রের মতো মানসম্পন্ন এবং আধুনিক অস্ত্র পাওয়াও যাবে না। সৌদি আরব চারপাশ থেকে যে সামরিক হুমকির মধ্যে রয়েছে, সে অবস্থায় দেশটির অস্ত্র ক্রয় করা ছাড়া বিকম্প পথ নেই। দেশটি যদি সামরিকভাবে শক্তিশালী না থাকে, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদেরই সামলাতে পারবে না।

এটি সত্য যে ট্রিপল 'থ্রি' কারণে সৌদি আরবকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার। তেহরান (Tehran), তেল-আবিব (Tel Aviv) ও টেরোরিজম (Terrorism) ।

ইসলামিক বিপ্লবের আগে ইরান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইরান যদি কেবল দুটি বিষয় মেনে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের সাথে কাজ করতে তেমন বাধা থাকবে না। এই দুটি বিষয় হল তেল-আবিবকে মেনে নেওয়া ও পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশের স্বপ্নটিকে খতম করা। যুক্তরাষ্ট্র ভূ-রাজনীতিতে বিকল্প কোনও অপশনকে একেবারেই  ধ্বংস করে দেয় না।

জামাল খাশুগজিকে হত্যার কারণে সৌদি রাজপরিবারের, বিশেষ করে ভবিষ্যৎ বাদশাহ বর্তমান ক্রাউন প্রিন্সের রাজনৈতিক অবস্থান খুবই বাজে হয়ে গেছে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানেরা প্রায় সমস্বরেই ক্রাউন প্রিন্সকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বলছে। ক্রাউন প্রিন্স সরে গেলে রাজ পরিবারে মধ্যে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্য বেসামাল হয়ে উঠতে পারে।

এমতাবস্থায় সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোনও জায়গায় গিয়ে ঠেকে, তা এই মুহূর্তে সঠিকভাবে নির্ধারণ করা আসলেই কঠিন। তবে ক্রাউন প্রিন্সের ভবিষ্যৎ যে বিপদগ্রস্ত তা স্পষ্ট করেই বলা যায়।