বাংলাদেশের দ্বাদশ সমস্যা

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 23 Oct 2018, 12:29 PM
Updated : 23 Oct 2018, 12:29 PM

সমস্যার অন্ত নেই বাংলাদেশে। কোনও একটা সমাধানে পৌঁছাতে হলে সমস্যাগুলোকে আগে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের সার্বিক অনুন্নতির মূলে আমি কমবেশি বারোটি সমস্যা চিহ্নিত করেছি। তবে সমস্যার সংখ্যা নিশ্চয় বারোর অনেক বেশি, হাজার বারো হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

প্রথম (প্রধান অর্থে নয়!) ধরনের সমস্যার নাম 'সিএনজি'। যে সিএনজি. ত্রিচক্রযানের মূল দাম ছিল (ধরা যাক), ৩ লাখ টাকা, মধ্যস্বত্বভোগী রাজনীতিক বা অন্যান্যদের বখরা দিতে গিয়ে সে সিএনজি যানের দাম দাঁড়ালো (ধরা যাক) ৯ লাখ টাকা (যারা সত্যিকারের অঙ্কগুলো জানেন তারা শুধরে দিন!)। এর ফলে দৈনিক জমা যেখানে হবার কথা ছিল (ধরা যাক) ৬০০ টাকা, সেখানে মালিক জমা দাবি করে (ধরা যাক) ১০০০ টাকা। এর পর তেল খরচ, খাওয়া খরচ মিটিয়ে তারপর যদি কিছু চালকের থাকে। জ্যাম লেগে আটকে থাকার ভয়ে সিএনজি ড্রাইভাররা সব রাস্তায়, সব দিকে যায় না, কারণ সেক্ষেত্রে তার জমা উঠবে না। সে মিটারে যায় না, অথবা গেলেও মিটারের অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে। কারণ, অন্যথায় ঢাকার বাজারে তার পোষায় না। মালিকদেরও কিছু করার নেই, কারণ তাকে ঋণের উপর সুদ দিতে হয়, বিনিয়োগ করে লাভ করতে হয়। চালকদেরও কিছু করার নেই, কারণ গাড়ির চেয়ে চালক বেশি। একজন না চালালে দশ জন চালাতে ছুটে আসবে। সুতরাং কারও কিছু করার নেই, গোলকধাঁধাঁয় আটকে যায় সব কিছু, যদিও বখরা, জ্যাম, বেশি জমা… ইত্যাদি যাবতীয় অব্যবস্থার মাশুল গুণতে হয় মধ্যবিত্ত জনগণকেই, বেশি ভাড়া দিয়ে অথবা অসহায়, নির্বাহন হয়ে ভিড়ের রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে।

দ্বিতীয় ধরনের সমস্যার নাম দেয়া যাক 'ইউক্যালিপটাস'। আশির দশকে বিশ্বব্যাংক নাকি বনবিভাগের হাতে জোর করে ধরিয়ে দিয়েছিল কোটি কোটি টাকার ঋণ বা অনুদান এবং সেই সাথে কোটি কোটি ইউক্যালিপটাস/আকাশমণি গাছের চারা।  হ্যাঁ, দেশি আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু গাছ নয়, ইউক্যালিপটাসের চারা দিয়ে বাংলাদেশ ভরে দিতে হবে। বাঙালিরাও সানন্দে এই গাছকে বরণ করেছিল, কারণ ইউক্যালিপটাস তাড়াতাড়ি বাড়ে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক বা বাংলাদেশের বনবিভাগ জানতো বা জানতো না যে এ গাছ মাটি, জল, পরিবেশ ও প্রাণিজগতের জন্যে ভীষণ ক্ষতিকর।

প্রায় একই ধরনের একটি সমস্যা 'টিউবওয়েল'। বাঙালি আগে পুকুরের পানি খেতো। আমি চট্টগ্রামের কুমিরা স্কুলে পড়ার সময় তেষ্টা পেলে স্কুলের মসজিদের পুকুরে গিয়ে অঞ্জলিভরে জল খেয়েছি। কিন্তু ষাটের দশক থেকেই পানিবাহিত রোগ, যেমন কলেরা বা ডায়রিয়া থেকে মুক্তি দিতে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হলো নলকূপ বা টিউবওয়েল, যা এখন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। বাঙালি টিউবওয়েলকে সানন্দে বরণ করে নিল এর সুফল জেনে। গত ত্রিশ বছর ধরে পুকুরের পানি কেউ খায় না বললেই চলে। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে গভীর-অগভীর নলকূপ দিয়ে তোলা ভূগর্ভস্থ পানি খেয়ে কলেরার সংক্রমণ থেকে তো বাঁচা গেলো, কিন্তু শরীরে ঢুকে পড়লো প্রয়োজনাতিরিক্ত খনিজ, যার মধ্যে একটি হচ্ছে নীরব ঘাতক আর্সেনিক। এখন বাঙালি যে 'ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলাও!' বলবে তারও কোনও উপায় নেই। এটি অনেকটা ইউক্যালিপটাস টাইপ সমস্যা, তবে ঈষৎ পার্থক্য আছে। বিশ্বব্যাংক ইউক্যালিপটাসের চারা কেন দিয়েছিল, আমরা জানি না, বিশ্বব্যাংকও হয়তো জানতো না। টিউবওয়েলের পানি কেন খেতে হবে – সেটা দাতা এবং গ্রহিতা উভয় গোষ্ঠীই জানতো, জানানোর জন্যে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু খেলে কী ক্ষতি হবে, তা দাতারাও হয়তো জানতো না (যদিও তেনাদের বিশেষজ্ঞরা কনসালটেন্সি ফি ঠিকই বাগিয়ে নিয়েছিল!), আর গ্রহীতারাতো জানার প্রশ্নই আসে না। ইউক্যালিপটাস নামক বালাই নিরবে ছড়িয়ে গেছে, টিউবওয়েল ছড়িয়েছে সরবে।

তৃতীয় ধরনের সমস্যার নাম দেওয়া যেতে পারে 'মশা ও কামান সমস্যা'। কামান দেগে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মশা মারা যেতেই পারে, কিন্তু সেটা হবে কামানের শক্তির অপচয়।উদাহরণস্বরূপ, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, যোগাযোগমন্ত্রী কিংবা মেয়র অত্যন্ত বড় এবং ব্যস্ত কিছু পদের নাম। একজন যোগাযোগ-মন্ত্রীকে কেন মফস্বলের রেলস্টেশনে গিয়ে বুকিং ক্লার্ককে তার দুর্নীতির জন্যে থাপ্পড় দিতে হবে? একজন মেয়রকে কেন ট্রাকস্ট্যান্ড সরানোর জন্যে সশরীরে উপস্থিত থেকে ইটের আঘাত কপাল পেতে নিতে হবে? তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে ফয়সালা করতেও কেন একজন প্রধানমন্ত্রীর মত নিতে হবে? প্রধান বিচারপতিকেই বা কেন সব বিষয়ে কথা বলতে হবে? একজন মেয়র বা মন্ত্রী যখন সস্তা জনপ্রিয়তা শিকারে জনারণ্যে ছুটে যান, তখন তার অফিসের একটি অংশও নিশ্চয়ই তার অনুগামী হয়। তখন কী অফিসের কাজে ব্যাঘাত ঘটে না? তদুপরি উচ্চপদস্থদের অহেতুক ছোটাছুটি শহরে যানজটের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি কাজ- নিম্ন, অতি নিম্নপদস্থের গণ্ডদেশে থাপ্পরের মতো অতি সামান্য আঘাত দেবার জন্যেও (যদি দেওয়াটা অপরিচার্য হয়!) নির্দিষ্ট লোক থাকা উচিত এবং যার যা কাজ, শুধু সে কাজটিই তার করা উচিত। উচ্চপদস্থরা শুধু দেখবেন, নিম্নপদস্থরা তাদের নিজ নিজ কাজ ঠিকঠাক মতো করছে কিনা। শহরের সড়কদ্বীপের গাছে মিউনিসিপ্যালিটির মালি পানি দেয় না, কারণ তার সুপারভাইজার নিজের কাজটি করতে তাকে বাধ্য করে না। একজন মেয়র বা মন্ত্রীকে যখন বহুতল নিচের কোনো কাজে সশরীরে ছুটে যেতে হয় এবং মশা মারতে কামানের এবম্বিধ ব্যবহার নিয়ে নাগরিকদের মনে যখন কোনো প্রশ্নেরই উদয় হয় না, তখন বুঝতে হবে, সেই সমাজের মনন ও প্রশাসন এখনও অপরিণত অবস্থায় রয়েছে।

চতুর্থ ধরনের সমস্যার নাম দেওয়া যাক 'ডাক্তার-ফার্মাসিস্ট দুষ্টচক্র'। একেকটি ওষুধ কোম্পানি একেকজন ডাক্তারকে দামী উপহার দিচ্ছে, যাতে তিনি সেই কোম্পানির ওষুধই শুধু ব্যবস্থাপত্রে লিখেন। বলপেন থেকে শুরু করে মেয়ের বাসরঘর সাজানো- কী না হতে পারে সেই উপহার! সুতরাং বিশেষ একটি ওষুধ রোগীর জন্যে অত্যাবশ্যকীয় হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট পরিমাণ ওষুধ ডাক্তার সাহেবকে বিক্রি করে দিতেই হবে, আর রোগী সাহেবকে সেগুলো গিলতেই হবে। প্যাথলজির ক্ষেত্রেও এই সমস্যা আছে। এমন টেস্ট দেয়া হচ্ছে, যেগুলো হয়তো অপরিহার্য নয়। এর ফলে বেচারা রোগীর পকেট এবং শরীর উভয়েরই সাড়ে বারোটা বেজে যাচ্ছে। পরিণামে ক্ষতি হচ্ছে পরিবার, সমাজ ও জাতির। এই ধরনের অশুভচক্র বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র বিরাজমান।

পঞ্চম ধরনের সমস্যার নাম 'ঘোড়ার জলপান'। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে: ঘোড়াকে আপনি পানির কাছে নিয়ে আসতে পারেন, কিন্তু জলপান করতে বাধ্য করতে পারেন না। 'যত সুবিধাই আমাকে দেওয়া হোক, আমি আমার দায়িত্ব পালন করবো না, এবার আপনি যা খুশি করেন!' উদাহরণ: আশা করা হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বই পড়বেন, গবেষণা করবেন এবং কর্তৃপক্ষ এর জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে (অন্ততপক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে) প্রতিমাসে গবেষণা ও বইকেনার জন্যে শিক্ষকদের খুব সামান্য অর্থ দেয়া হয়। এই অর্থে গবেষণা হয়তো করা যায় না, কিন্তু বই কিনে পড়া তো যায়। বই কিনেন ক'জন শিক্ষক? কিনলেও পড়েন ক'জন? সামান্য অর্থে গবেষণা করা যায় না, এ কথাটাও কি পুরোপুরি ঠিক? সব গবেষণায় কি লাখ লাখ টাকা দরকার? প্রশ্নটি করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী, সম্ভবত ষাটের দশকে, তার কোনো একটি রচনায়।

ষষ্ঠ ধরনের সমস্যার নাম 'ফ্লাইওভার'। ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। না ভাবিয়া, দুম করে কোনো কাজ করে বসার নাম অবিমৃশ্যকারিতা যা বাঙালি চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন ধরা যাক, যানজট নিরসনের জন্যে ফ্লাইওভার বানানো হলো, কিন্তু  নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার পর দেখা গেল, যানজট তো কমেইনি, বরং আরও বেড়েছে। অথবা দেখা গেলো, সদ্যনির্মিত ফ্লাইওভারটি বাংলাদেশের মতো রাইটহ্যান্ড ড্রাইভ নয়, বরং  আমেরিকার মতো লেফটহ্যান্ড ড্রাইভের উপযোগী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুতল সমাজবিজ্ঞানভবন নির্মাণের পর দেখা গেল, ভবনটি বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপযুক্ত নয়। এ রকম শত শত উদাহরণ আছে আমাদের চারপাশে, যাতে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ ও সময়ের খামাখা অপচয় হচ্ছে।

সপ্তম ধরনের সমস্যার নাম 'চতুর্দশ লুই'। এই ফরাসি রাজা বলতেন: 'আমিই রাষ্ট্র!' অর্থাৎ উনি যা কিছু করেন, তাইই আইন। কারও কাছে লুইকে জবাবদিহি করতে হয় না। কিন্তু কোনো একজন ব্যক্তি, তিনি যেই হোন না কেন, তার অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির একটা সীমা আছে। সুতরাং একজন ব্যক্তির পক্ষে জীবন ও জগতের সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারা কার্যত অসম্ভব। কিন্তু চতুর্দশ লুইয়েরা এই অসম্ভব কাজটি করতে যান এবং পরিণামে ক্ষতি করেন নিজের, সমাজের ও রাষ্ট্রের। বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা একেকজন চতুর্দশ লুই। তারা কারও কোনো মতামতের তোয়াক্কা না করে বা অন্যের মতকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে, অগণতান্ত্রিকভাবে, নিজের ইচ্ছাতেই বেশির ভাগ কাজ করেন। আমাদের সবার মধ্যেই যেহেতু চতুর্দশ লুই হবার 'প্রবৃত্তি' কমবেশি রয়েছে, সেহেতু মস্তিষ্কের 'নিবৃত্তি' অংশটিকে ক্রিয়াশীল না করতে পারলে ব্যষ্টি ও সমষ্টি উভয়ের সমূহ বিপদ হতে পারে এবং বিপদ প্রায়শই হয়ে থাকে।

অষ্টম ধরনের সমস্যার নাম দেওয়া যাক 'FRCMS' (Fellow of the Royal Commission of Medicine  and Surgery)। ধরা যাক, বাংলাদেশে এই জাতীয় উচ্চতর একটি ডিগ্রি না থাকলে MBBS ডাক্তারদের প্রমোশন হয় না, ফি বাড়ে না। সুতরাং ডাক্তাররা এই ডিগ্রি পেতে আদাজল খেয়ে লাগেন। অধ্যাপক-ডাক্তারেরা যারা এই ডিগ্রি দিয়ে থাকেন, তারা ভাবেন, সবাই যদি FRCMS হয়ে যায়, তবে আমাদের আর দাম থাকে কোথায়! সুতরাং তারা পারতপক্ষে কাউকে পাস করাতে চান না। এমনও হয় যে ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে কোনো রোগের নাম উচ্চারণ না করতে পারার মতো তুচ্ছ ব্যর্থতার জন্যে পরীক্ষার্থীকে অপমান করা হয়। ফেল করাটা উপরি পাওয়া। বহু সাধনা স্বত্ত্বেও কয়েকবার FRCMS -ফেইল করে সাধারণ ডাক্তারদের অনেকে হতাশ হয়ে চিকিৎসা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যান, অথবা বিদেশে গিয়ে বাসন মাজার কাজ নেন।

নবম ধরনের সমস্যার নাম 'সার্জন- শিক্ষানবীশ'। ডাক্তারদের মতো মিস্টার অর্থাৎ সার্জনেরাও ছাত্রদের কাজ শেখাতে চান না, পাছে তার নিজের বাজার কমে যায়। অপারেশন দেখে যার শেখার কথা, সেই শিক্ষানবীশ ডাক্তারকে অপারেশন থিয়েটারে ডাকা হয় না। ডাকা হয় এমন কিছু অতি নিম্নপদস্থ কর্মচারিকে, যাদের কম টাকা দিয়ে পার পাওয়া যায় এবং যারা অপারেশনের কাজটা শিখে ফেললে বিশেষজ্ঞ সার্জনদের পসার কমে যাবার ভয় নেই। দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং চৌকস শল্যচিকিৎসক সৃষ্টি না হওয়ার জন্যে অধ্যাপক-চিকিৎসকদের বিরূপ আচরণ অনেকখানি দায়ী বলে জানিয়েছেন একাধিক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী-চিকিৎসক।

এই অবস্থার ফলে দেশে ডাক্তার ও সার্জন-সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতম হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা প্রতি মিনিটে পাঁচটি রোগী দেখার পরেও প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে গভীর রাত পর্যন্ত রোগীর ভিড় লেগে থাকে। ডাক্তারের ন্যূনতম মনোযোগ না পেয়ে বিরক্ত রোগীরা সুচিকিৎসা নামক সোনার হরিণের সন্ধানে চলে যান সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, সাধ্যে না কুলালে ভারতে। এর ফলে জনগণের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায় দেশের বাইরে।

বাংলাদেশের দশম সমস্যার নাম 'ভয়'। কীসের ভয়? কীসের নয়? কে, কোথায়, কী মনে করে, কোন ক্ষতি করে বসবে, কখন কার কোন অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, সেই ভয়ে সবাই অস্থির। সাংবাদিক ভয়ে লেখে না, সম্পাদক ভয়ে ছাপে না, পুলিশ ভয়ে অপরাধী ধরে না, জনগণ ভয়ে চুপ করে থাকে। ধরা যাক, চোখের সামনে ঘুষোঘুষি (অর্থাৎ ঘুষ দেয়া-নেয়া) হচ্ছে, আমরা চোখ ফিরিয়ে নিই। প্রতিবাদ করাটা একটা অভ্যাস (চতুর্দশ লুইরা হয়তো বলবেন: 'বদভ্যাস')। যে কোনো অভ্যাসের মতো এটাও ছোটোবেলা থেকে অর্জন করতে হয়। যে কোনও অভ্যাসের মতো প্রতিবাদ করার অভ্যাস আপনি হারিয়েও ফেলতে পারেন। যেখানে প্রতিবাদ করলে বিন্দুমাত্র ভয়ের কারণ নেই, সেখানেও আমরা প্রতিবাদ করি না। সরকার প্রধান থেকে শুরু করে দুধের শিশু, সবাই ভয়ে থাকে: কখন কী হয়ে যায়! হয়নি যে তাও তো নয়: ০৮/১৫, ০৫/০৫, ০৮/২১… গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো: 'গুম গুম চাঁদ, গুম গুম তারা, এই মাধবী রাত!' জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসে যেমন লেখা ছিল: 'বিগ ব্রাদার আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন!',  বাংলাদেশেও তেমনি কোনো এক অদৃশ্য বড় ভাইয়ের ভয়ে সবাই কেমন যেন তটস্থ।

বাংলাদেশের একাদশতম সমস্যার নাম 'সাঈদ খোকনের ডাস্টবিন'। বছর কয়েক আগে মেয়র সাঈদ খোকন ঢাকা দক্ষিণের রাস্তায় রাস্তায় ডাস্টবিন লাগিয়েছেন। একটা গোলাকার ঝুলন্ত সিলিন্ডার এবং তার উপর একটি চাষীদের মাথালের মতো ঢাকনা। ঢাকার রাস্তায় লক্ষ্য করলে দেখবেন, এই ডাস্টবিনগুলোর কী দুরাবস্থা। কোনটির কোমড় ভেঙে কিংবা বেঁকে গেছে, কোনোটির নিম্নদেশ নেই, কোনটির শুধু মাথালটি আছে, কোনটির মধ্যে বসে পানওয়ালা তার ব্যবসা চালাচ্ছে। শহরে ডাস্টবিন স্থাপন ভালো উদ্যোগ, সন্দেহ নেই, কিন্তু ডাস্টবিন দেখভাল করার ব্যবস্থাও রাখতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো উদ্যোগেরই, ইংরেজিতে যাকে বলে, কোনো ফলো-আপ হয় না। ফলে উদ্যোগগুলো আক্ষরিক অর্থে মাঠে মারা যায়।

বাংলাদেশের দ্বাদশতম সমস্যা হচ্ছে 'বিজ্ঞানমনষ্কতার অভাব'। গড় বাঙালিমন বিজ্ঞানচর্চার জন্যে এখনও প্রস্তত নয়। বাঙালি গাছের জন্যে বন দেখে না। ডিটেইলে আটকে থাকে, ডিটেইল নিয়ে তর্ক করে, ডিটেলকে ছাপিয়ে উঠে সাধারণীকরণ বা জেনারালাইজেশন করতে পারে না। হাজারটা ডিটেলের পেছনে বিরাজমান সাধারণ আপাত সত্যটি কী, সেটা বের করার চেষ্টা করাই বিজ্ঞান। এটা করতে জানা বা করতে চাওয়ার নাম বিজ্ঞানমনষ্কতা। বাংলাদেশের স্কুলেও সম্ভবত শেখানো হয় না, কীভাবে গাছ বাদ দিয়ে বনের দিকে তাকাতে হয়।

পুনশ্চ: ব্রয়লার (অথবা সব) মুরগিকে হরমোন বা অ্যান্টিবায়োটিক কিছু একটা খাওয়ানো হয়, সেই মুরগি খেয়ে মানবশরীরে শুনেছি, কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়, কিন্তু তবুও মুরগি খাওয়া বন্ধ করার উপায় নেই। এই সমস্যাটির নাম কী? এটা যে প্রকৃতপক্ষে 'টিউবওয়েল' টাইপ সমস্যা, সেটা আমার পাঠকেরা কি বুঝতে পারবেন?  মুরগিকে কী খাওয়ানো হয়, কি খাওয়ানো হয় না… এইসব অপ্রয়োজনীয় ডিটেইল নিয়েই হয়তো কোমর বেঁধে তর্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত নির্বিশেষে আমার পাঠকেরা। সব মিলিয়ে ব্যর্থ লেখকদের (অর্থাৎ যার লেখা পাঠক পড়েও বোঝে না!) তালিকায় আমার নামটিও যোগ হতে পারে, বা ইতিমধ্যে হয় তো হয়ে গেছে ভেবে ঈষৎ বিষণ্ণ বোধ করছি।